সামরিক অভিযানের হিসাবে হামলাটি জটিল হলেও এতে চমক ছিল। টানা ১৮ মাস প্রস্তুতি নিয়েই তবে বিস্তৃত পরিসরের হামলাটি করা হয়েছে। ঘটনাটি রাশিয়ায় চালানো ইউক্রেনের সাম্প্রতিক ড্রোন হামলা নিয়ে।
গত ১ জুন ইউক্রেন একযোগে ১০০টির বেশি ড্রোন দিয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরে বেশ কিছু বিমান ঘাঁটিতে হামলা চালায়। এসব বিমান ঘাঁটিতে পারমাণবিক হামলার সক্ষমতা সম্পন্ন দূরপাল্লার বোমারু বিমান রাখা হয়।
ইউক্রেনের জেনারেলরা এই হামলার নাম দিয়েছে ‘স্পাইডার ওয়েব’। হামলা শুরু হতেই এর ব্যাপকতা বোঝা যায়। রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায়। উত্তর মেরুর কাছের মুরমানস্ক অঞ্চল থেকে শুরু করে পূর্বে আমুর অঞ্চল পর্যন্ত বিস্ফোরণ ঘটে। এই দূরত্ব ইউক্রেন থেকে প্রায় ৮ হাজার কিলোমিটার।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, মোট পাঁচটি অঞ্চলে এই হামলা হয়- মুরমানস্ক, ইরকুতস্ক, ইভানোভো, রিয়াজান ও আমুর। তবে তারা দাবি করে, শুধু মুরমানস্ক ও ইরকুতস্কেই বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্য জায়গাগুলোতে তারা ড্রোনগুলো প্রতিহত করেছে।
হামলার কিছুক্ষণ পরেই ইউক্রেনের নিরাপত্তা সংস্থার (এসবিইউ) প্রধান ভাসিল মালিউক একটি স্যাটেলাইট ম্যাপ দেখছেন— এমন ছবি প্রকাশ পায়। সেই ম্যাপে রাশিয়ার উল্লেখিত বিমানঘাঁটিগুলো স্পষ্টভাবে চিহ্নিত ছিল।
অপারেশনের বিস্তারিত
ভাসিল মালিউক জানান, ড্রোনগুলো কাঠের তৈরি ঘরের ভেতরে লুকিয়ে রাখা হয়। এই ঘরগুলো ট্রাকের পেছনে বসানো হয় এবং উপরে রিমোটচালিত ছাদ দেওয়া হয়, যাতে বাইরের কেউ বুঝতে না পারে।
ট্রাকগুলো চালিয়ে বিমান ঘাঁটির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হয়। চালকেরা বুঝতেই পারেননি তারা কী বহন করছেন। এরপর ড্রোনগুলো লক্ষ্যবস্তুতে পাঠানো হয়।
অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, একটি ট্রাকের ছাদ খুলে গিয়ে সেখান থেকে ড্রোন বের হচ্ছে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম রিয়া নভোস্তিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এক ট্রাকচালক বলেন, তারা বুঝতে পেরে পেছন থেকে উড়তে থাকা ড্রোনগুলোর দিকে পাথর ছুড়ে মারেন।
তিনি বলেন, “ড্রোনগুলো ট্রাকের পেছনে ছিল। আমরা পাথর ছুড়ছিলাম, যাতে তারা উড়তে না পারে, নিচে পড়ে থাকে।”
রুশ টেলিগ্রাম চ্যানেল ‘বাজা’ রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত বলে পরিচিত। সেখানে জানানো হয়— এসব ট্রাকচালক দাবি করেন, তারা কাঠের কেবিন পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কাজ পেয়েছিলেন।
তাদের অনেকেই বলেন, পরবর্তীতে ফোনে নির্দেশ দেওয়া হয় কোথায় ট্রাক পার্ক করতে হবে। যখন তারা ট্রাক পার্ক করেন, তখন তাদের চোখের সামনে ড্রোন উড়তে শুরু করে।
হামলাটি শেষ হওয়ার পর ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সোশাল মিডিয়ায় এক পোস্টে বলেন, এই হামলায় মোট ১১৭টি ড্রোন ব্যবহৃত হয়েছে। এটির প্রস্তুতি নিতে সময় লেগেছে এক বছর, ছয় মাস ও নয় দিন।
তিনি বলেন, হামলার একটি লক্ষ্যবস্তু ছিল রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবির একটি কার্যালয়ের একদম পাশেই।
রাশিয়া জানিয়েছে, তারা এই হামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজনকে আটক করেছে। তবে জেলেনস্কি জানান, যারা ইউক্রেনের হয়ে এই কাজে সাহায্য করেছেন, তাদের রাশিয়া থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে এবং এখন তারা নিরাপদে আছেন।
এরই মধ্যে ইরকুতস্ক অঞ্চলের উস্ত-কুত শহরের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ টেলিগ্রামে একটি পোস্ট দিয়েছিল (যা পরে মুছে ফেলা হয়)। সেখানে বলা হয়, বেলায়া বিমান ঘাঁটিতে হামলার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একজন ৩৭ বছর বয়সী ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তিকে খোঁজা হচ্ছে।
ড্রোন সম্পর্কিত তথ্য
এসবিইউ এরই মধ্যে ড্রোনগুলোর ছবি প্রকাশ করেছে। ছবিতে দেখা যায়, ডজনখানেক ছোট, কালো রঙের ড্রোন কাঠের ঘরের মধ্যে গুছিয়ে রাখা আছে।
রুশ সামরিক ব্লগাররা দাবি করেন, ছবির লোকেশন ছিল চেলিয়াবিনস্ক অঞ্চলের একটি গুদাম।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ড্রোন বিশেষজ্ঞ ড. স্টিভ রাইট বিবিসিকে বলেন, এই ড্রোনগুলো সাধারণ কোয়াডকপ্টার। তবে এগুলো ভারী বোমা বহনে সক্ষম।
তিনি বলেন, এই হামলাকে ‘অসাধারণ’ করেছে দুটি বিষয়— ড্রোনগুলো রাশিয়ার ভেতরে চোরাই পথে ঢোকানো হয়েছে এবং সেগুলো দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে স্যাটেলাইট বা ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে।
এদিকে জেলেনস্কি বলেন, প্রতিটি ড্রোনের পেছনে একজন করে পাইলট ছিল।
আর ড. রাইট বলেন, এই ড্রোনগুলো সম্ভবত জিপিএস ব্যবহার করে পথ চলেছে। রাশিয়ার স্থানীয় জ্যামিং ব্যবস্থা অতিক্রম করতে হয়তো কিছু ড্রোনকে হাতে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
কিয়েভ এখনও ড্রোনগুলোর উৎপত্তিস্থল জানায়নি। তবে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইউক্রেন নিজেই দক্ষতার সঙ্গে ড্রোন তৈরি করছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই অভিযানে ব্যবহৃত ড্রোনগুলো দেশেই তৈরি।
লক্ষ্যবস্তু ও ক্ষয়ক্ষতি
জেলেনস্কি তার প্রতিদিনের ভিডিও বার্তায় বলেন, “রাশিয়া এই অভিযানে বড় ধরনের ক্ষতি স্বীকার করেছে এবং তা একেবারে ন্যায্য।”
ইউক্রেনের দাবি অনুযায়ী, ৪১টি কৌশলগত বোমারু বিমান আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে এবং এর মধ্যে কমপক্ষে ১৩টি পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে।
রাশিয়া এখনও এরকম ক্ষতির কথা স্বীকার করেনি। তারা শুধু বলেছে, কিছু বিমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিবিসি যাচাই করে দেখা ভিডিওতে মুরমানস্কের ওলেনেগোর্স্ক বিমানঘাঁটি ও ইরকুতস্কের বেলায়া বিমানঘাঁটিতে ক্ষতিগ্রস্ত বিমান দেখা যায়। বিমানগুলো হলো— টিইউ-৯৫, টিইউ-২২ এবং টিইউ-১৬০ মডেলের। এইসব বিমান মিসাইল বহনে সক্ষম এবং রাশিয়ার সামরিক কৌশলের অন্যতম অংশ।
এসব বিমান এখন আর উৎপাদন করা হয় না। তাই এগুলো মেরামত কঠিন হবে এবং প্রতিস্থাপন প্রায় অসম্ভব।
ক্যাপেলা স্পেস নামে একটি সংস্থা স্যাটেলাইট ছবি প্রকাশ করেছে, যাতে বেলায়া ঘাঁটিতে অন্তত চারটি বিমান ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে।
এই তথ্য ইউক্রেনের ড্রোন ফুটেজের সঙ্গেও মিল রয়েছে। সেখানে দেখা যায় একটি টিইউ-৯৫ বিমানকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে।
এসব হামলার পেছনে যুক্তি ব্যাখ্যা করে এসবিইউ প্রধান ভাসিল মালিউক বলেন, “যুদ্ধের আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, আমরা বৈধ লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করেছি। কারণ এই বিমানগুলো আমাদের শান্তিপূর্ণ শহরগুলোতে বোমা ফেলছিল।”
একাধিক আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত সপ্তাহেই রাশিয়ার টিইউ-৯৫ বোমারু বিমান থেকে ইউক্রেনের ওপর বড় পরিসরের কেএইচ-১০১ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছে।
প্রতিটি টিইউ-৯৫ বিমান একত্রে আটটি গাইডেড ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে। প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্রে ৪০০ কেজি (প্রায় ৮৮২ পাউন্ড) ওজনের বিস্ফোরক বসানো থাকে।
এই হামলায় রাশিয়ার এ-৫০ নামের সামরিক গোয়েন্দা বিমানও লক্ষ্যবস্তু ছিল বলে জানা গেছে। বিমানগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এগুলো ইউক্রেনের ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করতে এবং পাল্টা হামলা চালাতে রাশিয়াকে সহায়তা করে।
রাশিয়ার কাছে কতটি এ-৫০ বিমান আছে, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। তবে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা প্রধান কিরিলো বুদানোভ বলেছিলেন, রাশিয়ার হাতে মাত্র আটটি এ-৫০ বিমান আছে।
তাই এসব বিমানের যেকোনও ক্ষতি বা ধ্বংস মস্কোর জন্য বড় ধাক্কা হতে পারে।
এসবিইউ সোশাল মিডিয়ায় জানায়, ‘স্পাইডার ওয়েব’ অভিযানে রাশিয়ার প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে।
রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এই হামলা নিয়ে কোনও আলোচনা করেনি। রবিবার রাতে দেশটির টিভি অনুষ্ঠানগুলো শুধু আঞ্চলিক প্রশাসনের বিবৃতি পড়েই শেষ করে। সোমবার সকাল হতেই এই হামলার খবর সংবাদ থেকে পুরোপুরি গায়েব হয়ে যায়।
এই হামলার পর ইউক্রেনজুড়ে আনন্দ প্রকাশ করা হয়। অনেকেই একে ‘টাইটানিক’ বা অসাধারণ অভিযান বলে প্রশংসা করে।
জেলেনস্কি টেলিগ্রামে লেখেন, “সব কিছু এই মুহূর্তে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু এটি এমন এক ইউক্রেনীয় পদক্ষেপ, যা ইতিহাসের বইয়ে লেখা থাকবে— এতে কোনও সন্দেহ নেই।”
তথ্যসূত্র : বিবিসি