Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৭ মে, ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যেভাবে ইইউর টার্গেট

Ursula
[publishpress_authors_box]

চলছে বাণিজ্যযুদ্ধ। এর মধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) তার সবচেয়ে শক্তিশালী বাণিজ্যিক পদক্ষেপ প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ ও ইউরোপের বিরুদ্ধে তার শুল্ক যুদ্ধ বন্ধ না হলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর উপর শুল্ক আরোপ করতে পারে ইইউ।

ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডের লিয়েন ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ট্রাম্পের ৯০ দিনের অতিরিক্ত শুল্ক স্থগিতকালীন সময়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে একটি “সম্পূর্ণ ভারসাম্যপূর্ণ” চুক্তি করার জন্য ইইউ চেষ্টা চালাবে।

তবে কমিশন প্রেসিডেন্ট সতর্ক করে বলেছেন, আলোচনা ব্যর্থ হলে তিনি ট্রান্সআটলান্টিক বাণিজ্য যুদ্ধকে পরিষেবা খাতে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করার জন্য প্রস্তুত রয়েছেন। এর মধ্যে ডিজিটাল বিজ্ঞাপন রাজস্বের উপর কর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। আর এমনটা হলে মেটা, গুগল ও ফেইসবুকের মতো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

ফন ডের লিয়েন বলেন, “আমরা পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এসব ব্যবস্থার মধ্যে ইইউর নতুন ‘অ্যান্টি-কোয়ার্সন’ আইনের ব্যবহারও থাকতে পারে, যা পরিষেবা রপ্তানিতে আঘাত হানতে সক্ষম। আলোচনা সন্তোষজনক না হলে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার মতো অনেক বিকল্প ইইউর হাতে আছে।”

তিনি জানিয়েছেন, ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সেবাখাতে শুল্ক আরোপের বিষয়টি বিবেচনায় রয়েছে। তবে ঠিক কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা নির্ভর করবে ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলোচনার ফলাফলের ওপর। তিনি ডিজিটাল পরিষেবার বিজ্ঞাপন আয়ের ওপর শুল্ক আরোপের বিষয়টি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন।

এই ধরনের শুল্ক পুরো ইইউর অভ্যন্তরীণ বাজারে একযোগে প্রযোজ্য হবে। এটি আলাদা করে সদস্য রাষ্ট্রগুলো যেসব ডিজিটাল বিক্রয় কর আরোপ করে, তার থেকে আলাদা।

ইইউর নির্বাহী প্রধানের মতে, ট্রাম্পের শুরু করা বাণিজ্যযুদ্ধ বৈশ্বিক বাণিজ্যে একটি বড় পরিবর্তন এনেছে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের এক মোড় পরিবর্তনের সময়। বিশ্ব আর কখনো আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারবে না। এই পরিস্থিতিতে কেউই জয়ী নয়, সবাই ক্ষতিগ্রস্ত।

তিনি শেয়ার ও বন্ড বাজারে অস্থিরতার কথা উল্লেখ করে বলেন, “আজ আমরা বিশৃঙ্খলার মূল্য দেখছি… আমাদের এই অনিশ্চয়তার চড়া মূল্য দিতে হবে।”

যুক্তরাষ্ট্র ইইউর স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর গত মাসে শুল্ক আরোপ করে। এর জবাবে ইইউ যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ২১ বিলিয়ন ইউরো মূল্যের পণ্যের ওপর পাল্টা ব্যবস্থা নিতে চেয়েছিল। এর মধ্যে মুরগির মাংস, কমলার রস ও প্রমোদতরি (ইয়ট) অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনায় নিয়ে ইউরোপীয় কমিশন বৃহস্পতিবার এই পাল্টা ব্যবস্থা আপাতত স্থগিত করে।

ফন ডের লিয়েন ইইউর ২৭টি সদস্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাণিজ্যনীতি দেখভাল করেন। তিনি বলেন—কমিশন আগেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তখন ট্রাম্প প্রশাসন জানায়, ২ এপ্রিল ঘোষণার আগে অপেক্ষা করতে হবে। ওই ঘোষণায় ট্রাম্প ইইউর ওপর ২০ শতাংশ “পাল্টা শুল্ক” আরোপ করেন।

লিয়েন শিল্প পণ্যের ওপর “জিরো ফর জিরো” শুল্ক চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছেন। অর্থাৎ দুই পক্ষই একে অপরের শিল্প পণ্যে শুল্ক আরোপ করবে না। তবে এই প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রে খুব একটা সাড়া পায়নি। কারণ সেখানে কর্মকর্তারা অভিযোগ করছেন—ইইউ বিভিন্ন শুল্কহীন বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। যেমন মূল্য সংযোজন কর ও পণ্যের মান নিয়ে কঠোর নিয়ম।

ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের মান ও নীতিমালার কিছু অংশ একত্রিত করার বিষয়ে আলোচনা করতে প্রস্তুত লিয়েন। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, এর ফলে সীমিত ফলাফলই আসতে পারে।

তিনি বলেন, “আমার মনে হয়, ব্যবসা সহজ করতে হলে কোথায় আমাদের মান ও নীতিমালা মেলানো যায়, তা দেখা দরকার। আমি সে বিষয়ে আলোচনা করতে রাজি। তবে আমাদের বেশি আশা করা উচিত নয়। কারণ অনেক সময় বিভিন্ন মানের পেছনে থাকে জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির পার্থক্য।”

তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ইইউর ডিজিটাল কনটেন্ট এবং বাজারে প্রভাব বিস্তার সংক্রান্ত যেসব নীতিমালা রয়েছে, সেগুলো পরিবর্তন করার প্রশ্নই ওঠে না। অথচ ট্রাম্প প্রশাসন এসব নীতিকে যুক্তরাষ্ট্রের বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ওপর কার্যত কর হিসেবে দেখে। একইভাবে, ইইউর ভ্যাট নিয়েও কোনো আলোচনা হবে না।

তিনি বলেন, ভ্যাট যুক্তরাষ্ট্রের বিক্রয় করের মতোই। এই নীতিগুলো আমাদের সার্বভৌম সিদ্ধান্ত, এগুলো আলোচনা-চুক্তির অংশ নয়। আলোচনায় সমাধান না আসলে যুক্তরাষ্ট্রের স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর আরোপিত শুল্কের জবাবে ইইউ যে পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছিল, তা আবার চালু করা হবে।

এছাড়া ট্রাম্পের তথাকথিত “পাল্টা শুল্ক”-এর জবাবে ইইউ নতুন কিছু প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। এর লক্ষ্য হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল সেবা খাতের উদ্বৃত্ত। ট্রাম্প কেবল পণ্যের বাণিজ্য ঘাটতির দিকেই নজর দেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী রপ্তানিকৃত সেবা বিবেচনায় নেন না।

সাক্ষাৎকারে লিয়েন বলেন, “যেসব কোম্পানি সেবা দেয়, তারা ইউরোপীয় বাজারে ভালো ব্যবসা করছে। আর ৮০ শতাংশ সেবাই আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তাই আমরা আলোচনার মাধ্যমে এমন সমাধান চাই, যেটা আমাদের সবার জন্য ভালো হয়।”

ইইউ সেবা খাত ছাড়াও অন্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েও ভাবছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে স্ক্র্যাপ লোহা রপ্তানির ওপর কর আরোপ করা হতে পারে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের স্টিল কারখানাগুলোর মধ্যে ইউরোপীয় স্ক্র্যাপ লোহার চাহিদা অনেক বেশি।

বৈশ্বিক বাণিজ্য যুদ্ধের সম্ভাব্য প্রভাব প্রসঙ্গে ফন ডের লিয়েন বলেন, ইইউ যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের মুখে পড়া চীনা পণ্য ইউরোপে পুনঃরপ্তানিকে সহ্য করবে না। ব্রাসেলস একটি নতুন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে চীনা আমদানি বৃদ্ধি শনাক্ত করলে তারা সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেবে। 

লিয়েন গত সপ্তাহে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনায় এই বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। লি কিয়াং জবাব দিয়েছিলেন, “এই ঝুঁকি নেই, কারণ চীন নিজ দেশে ভোক্তা চাহিদা বাড়ানোর চেষ্টা করবে।”

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার ফলাফল যাই হোক না কেন, ট্রাম্পের নীতি বিশ্ব বাণিজ্য সম্পর্ককে আমূল বদলে দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন লিয়েন। এটি ইইউকে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা জোরদার করতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

ফন ডের লিয়েন বলেন, “বিশ্বের অনেক দেশেরই আগ্রহ তৈরি হয়েছে আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার। যাতে বাণিজ্য ব্যবস্থায় ভারসাম্য আনা যায় এবং প্রকৃত মুক্ত বাণিজ্য নিশ্চিত হয়—যেখানে প্রতিযোগিতা হবে পণ্যের গুণগত মানের ভিত্তিতে, শুল্কের ভিত্তিতে নয়।”

যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ উভয়েই স্বীকার করে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম চীনের জন্য সমতাভিত্তিক বাণিজ্য ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। চীন তার কিছু উৎপাদন খাতকে ভর্তুকি দিয়ে বিশ্ব বাজার প্লাবিত করছে। 

এই বাণিজ্য যুদ্ধ এখন ডব্লিউটিওকে “আধুনিকীকরণ, সংস্কার ও স্থিতিশীল করার” বিষয়ে আলোচনা করতে উৎসাহিত করেছে। লিয়েন বলেন, “কিন্তু জোর দিতে হবে আধুনিকীকরণ ও সংস্কারের উপর। বর্তমান ব্যবস্থাকে অপরিবর্তিত রাখা যাবে না, কারণ অনেক সমস্যা বিদ্যমান। একটি ভালো সংকটকে কখনও নষ্ট করা উচিত নয়।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত