দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা জীবনবাজি করে নেমেছিলেন সশস্ত্র লড়াইয়ে, স্বাধীন বাংলাদেশে সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উপহার হিসাবে সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটার বন্দোবস্ত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর ওই কোটার সুযোগ বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদেরও পাওয়ার বন্দোবস্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ছাড়াও অনগ্রসরদের জন্য ছিল আরও কিছু কোটা। কিন্তু ২০১৮ সালে কোটার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের এক আন্দোলনে সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকরিতে কোনও কোটাই থাকবে না। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাদ পড়ায় সেই সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের কয়েকজন। তাতে হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহালের রায় দিলে নতুন করে শুরু হয়েছে আন্দোলন।আন্দোলনকারীরা মুক্তিযোদ্ধা কোটা এতটা রাখার বিরোধিতা করছে। তাদের যুক্তি, মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের তো স্বাধীনতা যুদ্ধে কোনও ভূমিকা ছিল না, সুতরাং তাদের সুযোগ দেওয়া নিষ্প্রয়োজন। অন্যদিকে এই কোটা বহাল রাখারর দাবি যারা করছেন, তারা বলছেন, অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরিবার এখনও পিছিয়ে আছে, সমাজে এখনও প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। ফলে তাদের সামনে আনার জন্য এই কোটার এখনও প্রয়োজন রয়েছে। এই নিয়ে যখন বিতর্ক চলছে, তখন দেখে নেওয়া যাক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বীর যোদ্ধাদের কীভাবে সম্মান জানানো হয়।
প্রাচীনকালে যুদ্ধে শহীদদের কপালে নুড়ি পাথর রেখে শ্রদ্ধা জানানোর প্রথা ছিল। একইসঙ্গে কবিতা-গাথা থেকে শুরু করে শিল্প-সাহিত্যের নানা শাখায় শহীদ ও বীর যোদ্ধাদের স্মরণীয় ও মহিমান্বিত করে রাখায় প্রয়াস দেখা যায়।
মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশে দেশে বীর যোদ্ধা ও যুদ্ধে শহীদদের সম্মান এবং তাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার প্রচলন ব্যাপকভাবে শুরু হয়। এই সুবিধাগুলো বীর যোদ্ধাদের আত্মনির্ভরশীল এবং সম্মানজনক জীবনযাপনে সহায়তা করবে বলে মনে করা হয়।
এ বিষয়ে সংবিধান-মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষক আবুল খায়ের সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সবচেয়ে বড় রণক্ষেত্র ছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। জার্মানির নাৎসি বাহিনীর আক্রমণের ফলে এই রণক্ষেত্র সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
“এই বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নে ২ কোটি ৮০ লাখের বেশি মানুষ প্রাণ দিয়েছে। এই যুদ্ধকে বলা হয় ‘গ্রেট পেট্রোয়েটিক ওয়ার’। মহান দেশপ্রেম নিয়ে যুদ্ধ। যারা সোভিয়েত ইউনিয়নের রণক্ষেত্রে এই যুদ্ধ করেছেন, নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন এবং যারা অজানা শহীদ, তাদের জাতীয় বীরের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।”
সোভিয়েত ইউনিয়ন পরে রাশিয়াসহ মোট ১৫টি প্রজাতন্ত্রে বিভক্ত হয়ে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নে যারা জাতীয় বীরের মর্যাদা পেয়েছে, তাদের এখনও বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। তাদের পরিবারও এই সুবিধা পেয়ে থাকে বলে জানান খায়ের।
“এখনও রাশিয়ায় জাতীয় বীরদের বাড়ির সামনে স্মারক উৎকীর্ণ করা আছে। কোনও সৈনিক এই বাড়ির সামনে দিয়ে গেলে এই স্মারককে অভিবাদন জানিয়ে যায়। এটা একটি সংস্কৃতি হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এমন সংস্কৃতিও আছে এখন ওই দেশে যে দিনের একটি সময় বিউগল বেজে ওঠে। ওই সময় উপস্থিত সবাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে নীরবতা পালন করে।”
একইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করা বীর যোদ্ধাদের সুবিধা ও সম্মান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুদ্ধের সময় দেশটি বীর যোদ্ধাদের বেতন বাড়ানো হয়েছিল। বিশেষ অবদান রাখায় অনেক যোদ্ধাদের বোনাসও দেওয়া হয়, যা যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আবার জীবন শুরু করতে সহায়তা করেছে।
এছাড়া আর্থিক নিরাপত্তা দিতে যুদ্ধে আহত-নিহত যোদ্ধাদের পরিবারকে জীবন বীমার সুবিধা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার। আহত যোদ্ধাদের অনেকেই পেয়েছিল ‘ডিজেবিলিটি বেনিফিট’।
‘ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব ভেটেরানস অ্যাফেয়ার্স’র ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, ‘জিআই বিল’ নামে একটি আইনের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর যোদ্ধাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনে আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয়।
একইসঙ্গে নতুন নতুন দক্ষতা অর্জনে কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারিভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বীর যোদ্ধাদের অনেককে চাকরির সুযোগও দেওয়া হয়েছে।
দেশটির অনেক বীর যোদ্ধাদের দেওয়া হয়েছিল বিনামূল্যে জমি। দেওয়া হয়েছে স্বল্প সুদের গৃহঋণ। এর মাধ্যমে যেন বাড়ি নির্মাণ ও খামার গড়তে পারে এই যোদ্ধারা।
এই বীর যোদ্ধাদের চিকিৎসা পরিষেবা দিয়ে থাকে ভেটেরানস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নামে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। যুদ্ধের পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটি এই সেবা দিচ্ছে।
‘ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব ভেটেরানস অ্যাফেয়ার্স’ ওয়েবসাইট থেকে আরও জানা যায়, মোট ১১টি বিষয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের বীর যোদ্ধা ও পরিবারের সদস্যদের সেবা ও সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে আবুল খায়ের বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সম্মিলিত মিত্রবাহিনীর হয়ে অংশগ্রহণ করছে। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের জন্য দেশটির প্রতিরক্ষা বিভাগ ও ভেটেরানস বিভাগ ভাতাসহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকে।”
ভাতার মতো না হলেও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী বিপ্লবী ও বীর যোদ্ধাদের জন্য ১৯৭২ সাল থেকে ‘পেনশন স্কিম’ চালু রয়েছে।
দেশটি স্বরাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, দেশটিতে গত শতকের সত্তরের দশকের শুরুতে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়।
‘স্বতন্ত্র সৈনিক সম্মান যোজনা (Swatantrata Sainik Samman Yojana)’ শীর্ষক মাসিক এই পেনশন স্কিম ভারতীয় মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের নির্ভরশীল পরিবারকে আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা দিতে সহায়তা করে।
ভারতের ২৫তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ১৯৭২ সালে দরিদ্র স্বাধীনতা সংগ্রামী-যোদ্ধা ও তাদের পরিবারের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করে দেশটির সরকার। ১৯৮০ সালে দেশটির সব স্বাধীনতা যোদ্ধাদের জন্য এই পেনশন স্কিমটি বরাদ্দ করা হয়।
২০১৭ সালে দেশটির দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সময়কাল শেষ হওয়ার পরও এই স্কিমটির ধারাবাহিকতা রক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়ে এর নামকরণ হয় ‘স্বতন্ত্র সৈনিক সম্মান যোজনা’। ২০২১ সালে এই পেনশন স্কিমটির মেয়াদ ২০২৫-২৬ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
ভারতের ‘স্বতন্ত্র সৈনিক সম্মান যোজনা’ শীর্ষক এই পেনশন স্কিমের সুবিধাভোগীরা হলেন— জীবিত স্বাধীনতা যোদ্ধা, শহীদ স্বাধীনতা যোদ্ধার মা, বাবা, বিধবা স্ত্রী, বিপত্নীক, অবিবাহিত কন্যা (সর্বোচ্চ তিনজন)।
স্বাধীনতা যোদ্ধা বা তার স্ত্রী’র পেনশন হিসাবে অবস্থা ভেদে দেওয়া হয় ৩৫,৩৬০ থেকে ৪০,৮০০ রুপি। এছাড়া স্বাধীনতা যোদ্ধার অবর্তমানে শর্তসাপেক্ষে নির্ধারিত পেনশনের অর্ধেক পেয়ে থাকেন অবিবাহিত কন্যা বা জীবিত মা-বাবা।
আর্থিক এই সুবিধা ছাড়াও ভারতের স্বাধীনতা যোদ্ধারা পেয়ে থাকেন আজীবন ফ্রি রেলওয়ে পাস, কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকা ফ্রি চিকিৎসা সেবা এবং ল্যান্ড টেলিফোনের সংযোগ। পেট্রোল পাম্প ও গ্যাস স্টেশনের বরাদ্দের সংরক্ষিত ৪ শতাংশ থেকে সুবিধা নিতে পারবেন স্বাধীনতা সংগ্রামী-যোদ্ধা।
এছাড়া দিল্লিতে সাধারণ আবাসিক ভবনের সুবিধাও নিতে পারেন এই যোদ্ধারা। রয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে থাকার সুবিধাও।
অন্যদিকে আন্দামানে বন্দি স্বাধীনতা যোদ্ধা বছরে একবার বিমানে বিনা ভাড়ায় আন্দামান বা নিকোবর দীপপুঞ্জে যাওয়ার সুবিধা পায়।
ভারত স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবী ও যোদ্ধাদের জন্য এমন উদ্যোগ প্রসঙ্গে আবুল খায়ের বলেন, “ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের নানাভাবে সুযোগ-সুবিধা ও সম্মান জানানো হয়েছে।
“বিশেষ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেসব ভারতীয় সৈন্যরা অংশগ্রহণ করেছেন, এদের মধ্যে অনেকে আহত হয়েছেন, নিহত হয়েছেন, অনেকেই নিখোঁজ হয়েছেন, তাদের ও তাদের পরিবারকে বিভিন্ন ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে ভারত সরকার।”