সম্প্রতি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দশ বছরের একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়েছে। এই চুক্তিকে এখন পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এক ঐতিহাসিক অগ্রযাত্রা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কারণ ১০ বছর মেয়াদি এই প্রতিরক্ষা চুক্তি শুধু এই দুই দেশের মধ্যেই প্রথম দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি নয়, বরং ওয়াশিংটনের সঙ্গে অন্য কোনও দেশেরও এ ধরনের প্রথম চুক্তি।
এই চুক্তিকে বিশ্ব প্রতিরক্ষা সহযোগিতার এক “গেম-চেঞ্জিং” মুহূর্ত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বাস্তবসম্মত গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য একটি যৌথ টাস্ক ফোর্স গঠন, প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং ভারতের মাটিতে উন্নত সামরিক প্রযুক্তির যৌথ উৎপাদন।
কুয়ালালামপুরে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী পিট হেগসেথ আর ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের মধ্যে এক বৈঠকের পর এই চুক্তির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

রাজনাথ সিং সোশাল মিডিয়া এক্সে লিখেছেন, “কৌশলগত দিক থেকে আমরা যেভাবে আরও বেশি করে কাছাকাছি আসছি, তারই ইঙ্গিত এই চুক্তি। অংশীদারিত্বের এক নতুন দশক শুরু হলো। আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে প্রতিরক্ষা খাত গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হয়ে থাকবে। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে যাতে একটি উন্মুক্ত, স্বচ্ছ এবং নিয়মনীতি মেনে চলা এলাকা হিসাবে নিশ্চিত করা যায়, তার জন্য আমাদের অংশীদারিত্ব খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
এই চুক্তি কীভাবে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃহত্তর আঞ্চলিক পরিসরের জন্য কৌশলগত প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে।
চুক্তির মূল ধারা
এই চুক্তি দুই দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে বাস্তবসম্মত সময়ে তথ্য বিনিময়ের সুযোগ দেবে। আর একে কার্যকরী সমন্বয় জোরদারের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি যৌথ টাস্ক ফোর্স গঠিত হবে, যা দুই দেশের নৌবাহিনীকে বিশ্বের অন্যতম কৌশলগত সামুদ্রিক করিডরে সমন্বিত টহল পরিচালনায় সক্ষম করবে।
চুক্তির অন্যতম মূল দিক হলো প্রযুক্তি হস্তান্তর। এর আওতায় উভয় দেশ যৌথভাবে জেট ইঞ্জিন উন্নয়ন এবং হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করবে। তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক হচ্ছে ভারতের মাটিতে জেট ইঞ্জিন ও ড্রোন উৎপাদন। এটি “মেইক ইন ইন্ডিয়া” উদ্যোগের জন্য এক বড় মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ বলেন, এই চুক্তি “পারস্পরিক প্রয়োজনের” ভিত্তিতে গঠিত। দুই দেশের পরিবর্তনশীল প্রতিরক্ষা অগ্রাধিকার এবং যৌথ স্বার্থকে প্রতিফলিত করে এটি।
ভারতের দেশীয় যুদ্ধবিমান প্রকল্পে নতুন গতি
ভারতের নিজস্ব যুদ্ধবিমান প্রকল্পে এক গুরুত্বপূর্ণ গতি আনবে এই চুক্তি। যুক্তরাষ্ট্র রাজি হয়েছে এফ-৪১৪ জেট ইঞ্জিন যৌথভাবে ভারতে উৎপাদন করবে। এর ফলে ভারতের তেজস যুদ্ধবিমানকে শক্তি যোগাবে এবং দীর্ঘদিনের ইঞ্জিন সরবরাহ নির্ভরতার অবসান ঘটাবে।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, চুক্তিটি আগামী ১০ বছরের জন্য পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে সহযোগিতার একটি পূর্ণাঙ্গ রোডম্যাপ নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে থাকবে প্রপালশন সিস্টেম, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, এবং বিমানচালনা প্রযুক্তিতে উদ্ভাবন।
দশ বছরব্যাপী কৌশলগত নকশা
চুক্তির আওতায় স্ট্রাইকার সাঁজোয়া যানের উৎপাদন আগামী বছর থেকেই ভারতে শুরু হবে। স্ট্রাইকারকে প্রায়ই “ট্যাংক কিলার” বলা হয়। এটি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত অন্যতম উন্নত সাঁজোয়া যান।
২০২৭ সালের মধ্যে ভারত ৩১টি এমকিউ-৯ ড্রোন তৈরি শুরু করবে। এর মধ্যে থাকবে ১০টি অস্ত্রধারী ভ্যারিয়েন্ট, যেগুলো নির্ভুল ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে সক্ষম। একই বছর ভারতের ডিআরডিও ও যুক্তরাষ্ট্রের একটি সংস্থা যৌথভাবে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা শুরু করবে।
২০৩০ সালের মধ্যে দুই দেশ কেএন ইঞ্জিনের সহ-উন্নয়ন শুরু করবে। ২০৩৫ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ভারতে সম্পূর্ণ পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান প্রযুক্তি হস্তান্তর করবে। এই চুক্তি নিশ্চিত করছে যে, আগামী এক দশকে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক উদ্ভাবন ক্ষেত্রেই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে কাজ করবে।
শুল্ক সমস্যা ও বাণিজ্য চুক্তির পথ
চুক্তির কাঠামো আগেই প্রস্তুত ছিল। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সময়কার শুল্ক জটিলতা চূড়ান্ত স্বাক্ষর প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করে। এখন যুক্তরাষ্ট্র যখন উচ্চমানের সামরিক প্রযুক্তি ভাগাভাগিতে সম্মত হয়েছে, তখন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই চুক্তি একটি পূর্ণাঙ্গ ভারত–যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য চুক্তির পথ প্রশস্ত করতে পারে।
বাণিজ্য কাঠামোটি নভেম্বর মাসে চূড়ান্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন ট্রাম্পের এই প্রতিরক্ষা চুক্তির অনুমোদনই প্রমাণ করে ভারতের প্রতি আমেরিকার কৌশলগত আস্থা অনেক।
থিংক ট্যাংক ইউরেশিয়া গ্রুপের বিশ্লেষক প্রমিত পাল চৌধুরীর মতে, এই চুক্তিটি জুলাই-অগাস্ট মাসেই সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তবে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষ সমাপ্ত করা নিয়ে ট্রাম্পের একের পর এক মন্তব্যের কারণে ভারত বিরক্ত হওয়াতেই দেরি হয়েছে।

পাকিস্তানের একাকিত্ব
চুক্তিটি পাকিস্তানের নেতৃত্বের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। বিশেষ করে সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির ও প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের মধ্যে। তারা মনে করেছিলেন যে, সামরিক ঘাঁটি ও রেয়ার আর্থ মিনারেল সরবরাহের প্রস্তাব দিয়ে ইসলামাবাদ ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করবে।
কিন্তু ভারত–যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা চুক্তি পাকিস্তান–যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ববর্তী সব চুক্তিকে মাত্রা ও স্থায়িত্বে অনেকখানি ছাপিয়ে গেছে। পাকিস্তান–যুক্তরাষ্ট্র রেয়ার আর্থ মিনারেল চুক্তির মূল্য মাত্র ৫০০ মিলিয়ন ডলার। এর আবার কোনও নির্দিষ্ট মেয়াদ নেই। যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে তা বাতিলও করতে পারে। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে চুক্তিটি ১০ বছরের বাধ্যতামূলক অঙ্গীকার, যার প্রাথমিক বিনিয়োগ ১৩৫ বিলিয়ন ডলার।
যেখানে পাকিস্তান শুধুমাত্র তার এফ-১৬ বিমানগুলোর জন্য ক্ষেপণাস্ত্র পাবে, সেখানে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথভাবে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা তৈরি করবে। এটি নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যে গভীরতর কৌশলগত অংশীদারিত্বের স্পষ্ট ইঙ্গিত।
পাকিস্তান নিয়ে ট্রাম্পের অবস্থান অপরিবর্তিত
তবে এই পার্থক্য দেখাচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র এখন ভারতকে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত মিত্র হিসেবে দেখছে, আর পাকিস্তানকে কেবল সীমিত কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “পাকিস্তান ১৫ বছর ধরে আমেরিকার কাছ থেকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য পেয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে দিয়েছে কেবল মিথ্যা ও প্রতারণা। পাকিস্তানিরা ভাবে আমরা বোকা। কিন্তু এই আচরণ আর সহ্য করা হবে না।”
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ট্রাম্পের এই দৃষ্টিভঙ্গি এখনও অপরিবর্তিত। পাকিস্তান হয়তো স্বল্পমেয়াদি কৌশলগত উদ্দেশ্যে কাজে লাগতে পারে। কিন্তু ওয়াশিংটনের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনায় এখন আর তাকে বিশ্বস্ত অংশীদার হিসেবে দেখা হয় না।
প্রতিরক্ষা সহযোগিতার এক নতুন যুগ
ভারত–যুক্তরাষ্ট্র ১০ বছরের এই প্রতিরক্ষা চুক্তি দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এক নির্ধারণী মুহূর্ত, যা ভারতের প্রতিরক্ষা উৎপাদন সক্ষমতাকে শক্তিশালী করছে এবং ইন্দো-প্যাসিফিক নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি অঙ্গীকারকে প্রতিফলিত করছে।
তথ্যসূত্র : জি নিউজ, রয়টার্স, বিবিসি



