রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিতে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভ ঘিরে সহিংসতায় একজন সাংবাদিকসহ দুজন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক।
শুক্রবারের এই সহিংসতায় পর পুলিশ ধরপাকড় চালাচ্ছে বলে দেশটির সংবাদপত্রে খবর এসেছে। কাঠমান্ডু পোস্ট জানিয়েছে, রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার এই আন্দোলনের মূল নেতাসহ অর্ধ শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
নতুন করে সংঘর্ষ এড়াতে কাঠমান্ডুতে চলছে সেনা টহল; কয়েকটি এলাকায় কারফিউও জারি করা হয়েছে।
নেপালের এক সময়ের রাজা জ্ঞানেন্দ্র এই মাসের শুরুতে দেশে ফেরার পর থেকে চাঙা রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিতে জানিয়ে আসা গোষ্ঠীগুলো।
এই গোষ্ঠীর মূলে রয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি; তাদের সঙ্গে হিন্দু ধর্মীয় কিছু দলও যোগ দিয়েছে। তারা রাজতন্ত্র ফেরত আনার পাশাপাশি নেপালকে আগে মতো হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে দেখতে চাইছে।
অন্যদিকে নেপালের ক্ষমতাসীন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি এবং বিরোধী মাওবাদী দল এর বিরোধিতা করছে। এর মধ্যে মাওবাদী দলের নেতা পুষ্পকুমার দহাল প্রচণ্ড এক সমাবেশ থেকে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার পক্ষের গোষ্ঠীগুলোর উদ্দেশে কড়া হুঁশিয়ারি দেওয়ার পর তারা কাঠমান্ডুতে বিক্ষোভে নামে, তারপর শুরু হয় সংঘাত।
নেপালের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রাজতন্ত্রের পক্ষের বিক্ষোভকারীরা সরকারি নয়টি এবং ব্যক্তিগত ছয়টি গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। আগুন ধরিয়ে দেয় অন্তত ১৩টি ভবনে।
কাঠমান্ডু পোস্ট জানিয়েছে, পুলিশ বাধা দিতে গেলে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বেধে যায়।
তার মধ্যে আহত একজনকে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ২৯ বছর বয়সী ওই যুবকের নাম সাবিন মহারাজন। তিনি বিক্ষোভে ছিলেন।
সংঘাতের মধ্যে ভিডিও ধারণের সময় সুরেশ রাজক নামে একজন সংবাদকর্মী নিহত হন। তিনি এভিনিউজ টেলিভিশনে কাজ করতেন।
সুরেশ একটি ভবনের ছাদে দাঁড়িয়ে ভিডিও করছিলেন। বিক্ষোভকারীরা ভবনটিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। তিনি আর নামতে পারেননি বলে জানান টিভি স্টেশনটির মালিক ভাস্কর রাজ রাজকর্নিকার।
অনলাইন সংবাদপত্র হোয়াইটখবর এর সম্পাদক বলেন, “আমরা একটি পাঁচতলা ভবনে ছিলাম। সুরেশ ছিল পাশের চার তলা ভবনে। আগুন লাগানোর পর আমরা নেমে আসতে পারলেও তিনি পারেননি।”
সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ের পাশাপাশি নেপালের মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয়ও বিক্ষোভকারীদের হামলার মুখে পড়ে।
সংঘর্ষে নেপাল পুলিশের ৫৩ সদস্য এবং আর্মড পুলিশের ২২ সদস্য আহত হয় বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
সংঘর্ষের পর রাতেই কে পি শর্মা ওলি’র মন্ত্রিসভা জরুরি বৈঠক করে। ওই বৈঠক থেকে সহিংসতার জন্য রাজতন্ত্রকামীদের দায়ী করে এর নিন্দা জানানো হয়।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে পুলিশসহ সব নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানদের ডাকা হয় এবং সহিংসতা ঠেকানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
কাঠমান্ডুর বানেশ্বর-তিনকুনে এলাকায় কারফিউ জারি করে নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র চাব্বি রিজল রাজতন্ত্রের দাবিতে এই সহিংসতাকে অপরাধমূল তৎপরতা হিসাবে দেখার কথা জানান। তিনি এরজন্য বিক্ষোভকারীদের দায়ী করেন।
নেপালের সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো সুকেশ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছে। এই নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে তারা। মানবাধিকার কমিশনও হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছে।
এদিকে পুলিশ জানিয়েছে, সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে ৫১ জনকে শুক্রবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নাশকতাকারী সবাইকে ধরতে অভিযান চলছে।
রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্রী পার্টির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান রবীন্দ্র মিশ্র, সাধারণ সম্পাদক ধাওয়াল সামসের রানা গ্রেপ্তার হয়েছে।
গ্রেপ্তার করা হয়েছে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিতে সক্রিয় সওগাত নেপাল, শেফার্ড লিম্বু, সন্তোষ তামাংকেও।
বিক্ষোভের ডাক দেওয়া নবরাজ সুবেদিকে গৃহবন্দি করা হয়েছে। তাদের আরেক নেতা দুর্গা প্রাসাইকে গ্রেপ্তারের জন্য খোঁজা হচ্ছে। দুর্গা প্রাসাই রাজা জ্ঞানেন্দ্রর ঘনিষ্ঠজন হিসাবে পরিচিত।
সহিংস বিক্ষোভ দমনে সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
এদিকে নেতাদের গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়েছে প্রজাতন্ত্রী পার্টি। দলের প্রচার সম্পাদক উদ্ধব রাজ বেতুয়াল বলেছেন, সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে তাদের নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গৃহিবন্দি নবরাজ সুবেদি রবিবারও বিক্ষোভের ডাক দিয়েছেন। তিনি সোশাল মিডিয়ায় এক পোস্টে বলেন, “আমাদের বিক্ষোভ চলবে।”
রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনে জ্ঞানেন্দ্র ২০০৬ সালে ক্ষমতাচ্যুত হন। এরপর ২০০৮ সালের মে মাসে নতুন সংবিধান গ্রহণ করে গণতান্ত্রিক নেপাল প্রতিষ্ঠিত হয়। তখনই নেপালকে ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জ্ঞানেন্দ্র সাধারণ নাগরিক হিসাবে থাকছেন। সরকারি কোনও সুবিধাও তিনি পান না।
অনেক বছর বিদেশে থাকার পর মার্চের শুরুতে জ্ঞানেন্দ্র নেপালে ফেরার পর বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত হয় হাজারো মানুষ। তারা রাজতন্ত্র ফেরত আনার দাবিতে স্লোগান দিচ্ছিল। সেই সঙ্গে দাবি তোলে নেপালকে আবার হিন্দু রাষ্ট্র ঘোষণার।