Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৫

প্রকৃতির ওপর অত্যাচারের ফলই কি পাচ্ছে বাংলাদেশ

এবার এপ্রিলে টানা তাপপ্রবাহ দেখেছে বাংলাদেশ।
এবার এপ্রিলে টানা তাপপ্রবাহ দেখেছে বাংলাদেশ।
[publishpress_authors_box]

গত দুই দশকে প্রায় ৯ শতাংশ সবুজ হারিয়েছে বাংলাদেশ; এর মধ্যেই গত এপ্রিলে রেকর্ড ভাঙা গরমের মধ্যে ৪৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত দেখতে হয়েছে; আর অতিরিক্ত ৫৭ দিন তীব্র তাপপ্রবাহ সইতে হয়েছে দেশের মানুষকে।

এই যে বিরূপ পরিস্থিতির মুখোমুখি এখন বাংলাদেশ; তা কি প্রকৃতির ওপর মানুষের অত্যাচারের ফল? সাম্প্রতিক এক গবেষণা তাই বলছে।

ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন, দ্য রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট ক্লাইমেট সেন্টার এবং ক্লাইমেট সেন্ট্রাল এর যৌথ এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মানবসৃষ্ট কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ফল আরও কিছু দেশের সঙ্গে বাংলাদেশও পাচ্ছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানবসৃষ্ট কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বছরে ৭৬ দিন তীব্র গরম সহ্য করতে হয়েছে বাংলাদেশের মানুষকে। জলবায়ু পরিবর্তনের এমন প্রভাব নেই যেসব দেশে, সেখানে এমন গরম ছিল মাত্র ১৯ দিন। সেই হিসাবে বাংলাদেশকে বাড়তি ৫৬ দশমিক ৬ দিন তাপপ্রবাহের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে ২ জুন পালিত হয় ‘হিট অ্যাকশন ডে’। এবছর দিবসটির আগে বিপজ্জনক তাপপ্রবাহে মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্লেষণ করতে এই গবেষণা চালানো হয়।

২০২৩ সালের ১৫ মে থেকে ২০২৪ সালের ১৫ মে পর্যন্ত সময়ের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে করা ওই বৈশ্বিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় গত ২৮ মে। তবে ঢাকা থেকে বাংলাদেশের অংশটি আলাদা করে প্রকাশ করা হয়েছে বৃহস্পতিবার।

গবেষকরা তথ্য বিশ্লেষণের সময় ২০২৩ সালকে পৃথিবীর উষ্ণতম বছর এবং টানা ১১ মাস (জুন ২০২৩-এপ্রিল ২০২৪) অভাবনীয় তাপমাত্রার তথ্য পান।

২০২৩ সালের জুলাইকে বিশ্বের উষ্ণতম মাস এবং সে জুলাইয়ের ৬ তারিখকে উষ্ণতম দিন হিসাবে দেখানো হয়েছে প্রতিবেদনে। এই হিসাব করা হয়েছে পৃথিবীতে তাপমাত্রার তথ্য সংরক্ষণের পর থেকে।

ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশনের নির্ণায়ক ব্যবহার করে করা ওই গবেষণায় দেখা যায়, গত এক বছরে ৭৬টি তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে ৯০টি দেশের ওপর দিয়ে। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকার সাভানা অঞ্চল ও দক্ষিণ আমেরিকার মতো ঘনবসতি এলাকার শত কোটি মানুষ।

বিশ্বের ৭৮ শতাংশ অর্থাৎ ৬৩০ কোটি মানুষ নিদেনপক্ষে ৩১ দিন এই সময়কালে চরম গরমের মুখোমুখি হয়। এই উত্তাপ অন্যান্য সময়ের থেকে অন্তত দুই গুণ বেশি বলে উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।

এই জনগোষ্ঠীকে ১৯৯১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে তাদের নিজেদের এলাকায় যে গরম ছিল, তার চেয়ে ৯০ শতাংশের বেশি গরম সইতে হয়েছে।

এই ১২ মাসে মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গড়ে বিশ্বের প্রায় সব স্থানের মানুষদের অতিরিক্ত ২৬ দিন চরম গরমে কাটাতে হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

তীব্র গরমে ঢাকার একটি পার্কে গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে আছেন শ্রমজীবী এক মানুষ। বাংলাদেশে একদিনে যেমন গরম বাড়ছে, অন্যদিকে কমছে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা। ছবি : হারুন-অর-রশীদ

মানবসৃষ্ট কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশকে যেমন অতিরিক্ত ৫৭ দিন মাত্রাতিরিক্ত গরম সইতে হয়েছে, তেমনি ভেনেজুয়েলাকে অতিরিক্ত ১২২ দিন, বলিভিয়াকে অতিরিক্ত ১০৮ দিন, ব্রুনেইকে অতিরিক্ত ১৩০ দিন, কলম্বিয়াকে অতিরিক্ত ১৩৯ দিন, কোস্টা রিকাকে অতিরিক্ত ১২৩ দিন, ইকুয়েডরকে অতিরিক্ত ১৬৯ দিন, ইন্দোনেশিয়াকে অতিরিক্ত ১২৩ দিন, রোয়ান্ডাকে অতিরিক্ত ১২৪ দিন, সিঙ্গাপুরকে অতিরিক্ত ১৪৭ দিন, সুরিনামকে অতিরিক্ত ১৫৮ দিন গরম সইতে হয়েছে।

ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন, দ্য রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট ক্লাইমেট সেন্টার এবং ক্লাইমেট সেন্ট্রালের বিজ্ঞানীরা বিশ্বজুড়ে পরিবেশে মানবসৃষ্ট পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ওপর তার বিরূপ প্রভাবের বিষয়টি তুলে ধরলেও গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ পরিবেশ ধ্বংসের বিষয়টি উঠে এসেছে।

তাদের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ২০০২ সাল থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল কমেছে ৮ দশমিক ৩৯ কিলো হেক্টর। আর এই সময়কালে বাংলাদেশে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা ১৩ শতাংশ কমেছে।

গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে সবুজ এভাবে হারিয়ে না গেলে অন্তত ৭৫ মেগাটন কার্বন নিঃসরণ কমানো যেত।

ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন, দ্য রেড ক্রস রেড ক্রিসেন্ট ক্লাইমেট সেন্টার এবং ক্লাইমেট সেন্ট্রালের বিজ্ঞানীরা অত্যাধিক তাপমাত্রার প্রভাব খুঁজে বের করার মতো কঠিন কাজটি করার পাশাপাশি এর ঝুঁকি নিরসনে কার্যকর সমাধানও বাতলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। 

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, এটা কোনও দুর্ঘটনা বা আশ্চর্য হওয়ার মতো বিষয়ও নয়। এর কারণ সবারই জানা।

নিয়মিত কয়লা, তেল ও গ্যাস পোড়ানোর ফলে এতটাই গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত হয়েছে, যা এই গ্রহের উষ্ণতা বৃদ্ধি প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়িয়ে দিয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘনবসতিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠী ইতোমধ্যেই জলবায়ু সঙ্কটের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সঙ্গে লড়ছে, তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে উচ্চতর ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। যে বড় বড় শহর এবং এলাকাগুলোতে নজিরবিহীন তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছে, সেখানে স্বাস্থ্য সঙ্কট বেড়েছে, অবকাঠামোতে চাপ সৃষ্টি করেছে এবং খাদ্য ও পানির নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।

চরম তাপ বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে মারাত্মক প্রাকৃতিক বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে, প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ তাপ-সম্পর্কিত কারণে মারা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালের গ্রীষ্মে, ইউরোপজুড়ে অন্তত ৬১ হাজার ৬৭২ জনের তাপ-সম্পর্কিত প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।

অতিরিক্ত তাপ বিভিন্ন খাতে জটিল কিছু প্রভাব ফেলে। এই প্রভাবগুলো স্বাস্থ্য, পানি, কৃষি, অর্থনীতি, বাসযোগ্যতা, জটিল অবকাঠামো এবং পরিবেশের ওপর সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ তাপমাত্রা ক্লান্তি, হিটস্ট্রোক এবং আগে থেকে আক্রান্ত রোগীদের আরও ঝুঁকিতে ঠেলে দিতে পারে। বিশেষ করে বয়স্ক, শিশু এবং দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার মতো দুর্বল জনগোষ্ঠী এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

এছাড়া মাত্রাতিরিক্ত গরম শ্রমের উৎপাদনশীলতাতেও বিরূপ প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ খাত কৃষি ও নির্মাণের মতো মাঠপর্যায়ের কাজে তার প্রভাব বেশি পড়তে পারে।

তীব্র গরমে এসব খাতের কর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়ে, যা তাদের আয় আবশ্যিকভাবে কমিয়ে দেয় এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যায় বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনটিতে।

দেশে গত এপ্রিলে তাপপ্রবাহে তাপমাত্রা ছাড়ায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তার মধ্যেও কাজের প্রয়োজনে বের হতেই হয় অনেককে। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

সমাধানে বিজ্ঞানীদের সুপারিশ

প্রতিবেদনে এধরনের গরমের ঝুঁকি মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়। যেমন জরুরি স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলো প্রসারিত করা এবং প্রচণ্ড গরমের সময় বাড়তি চিকিৎসা সেবা দেওয়ার মতো সক্ষমতা নিশ্চিত করা; সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় দুর্গতদের শীতল পরিবেশ নিশ্চিত করতে ভর্তুকিমূল্যে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা; পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা, যাতে বর্ধিত চাহিদা মেটানো যায়; প্রচণ্ড গরমের সময় পরিবহন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা এবং তার প্রাপ্যতা সহজ করা।

গরম শুরুর আগেই কীভাবে সবাইকে সতর্ক করা যায়, সে বিষয়েও কার্যকর ব্যবস্থা জোরদারের সুপারিশ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।

এতে আরও বলা হয়, ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত আইনে ভবনের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা কম রাখতে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা; কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের নিরাপত্তা আইন পাস এবং প্রয়োগ; কৃষি সরবরাহ ব্যবস্থার ক্ষতি কমাতে হিমাগার বাড়ানো এবং সব এলাকার বাসিন্দারা যাতে শহরের শীতল স্থানের কাছাকাছি থাকতে পারে, সেভাবে শহরগুলো সাজানো।

উপরন্তু, জাতীয় এবং স্থানীয় জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনায় তাপ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে একীভূত করা অপরিহার্য বলেও উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।

যখন গোটা বিশ্বই জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তাই এ জাতীয় প্রতিবেদনগুলো সমস্যার গুরুত্ব বোঝার এবং এ ধরনের বিপর্যয়ের ক্ষতিকর পরিণতি থেকে দুর্বল জনগোষ্ঠীকে রক্ষার জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টাকে এক করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসাবে কাজ করবে বলে প্রতিবেদনে আশা প্রকাশ করা হয়।

এতে বলা হয়, অত্যধিক গরমের বৈশ্বিক এবং স্থানীয় প্রভাব সম্পর্কে এই নতুন উপলব্ধি, বিশেষ করে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার জন্য জলবায়ু সংক্রান্ত একটি সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে , যা ভবিষ্যতে এধরনের তাপপ্রবাহ থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত