ফ্রান্সের পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রথম ধাপে অভূতপূর্ব জয় পেয়েছে দেশটির উগ্র ডানপন্থী দল ন্যাশনাল র্যালি (আরএন)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম ফ্রান্সে ডানপন্থীদের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পথ তৈরি হয়েছে।
তবে এজন্য তাদেরকে দ্বিতীয় ধাপেও জয় পেতে হবে। আগামী রবিবার দ্বিতীয় ধাপের রান-অফ নির্বাচন হবে। এতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে আরএন পার্লামেন্সটে সরকার গঠন করতে পারবে।
কিন্তু তা ঠেকাতে এবার ফ্রান্সের বামপন্থী ও মধ্যপন্থী দলগুলো দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন থেকে শত শত প্রার্থীকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
রবিবারের ভোটে অংশগ্রহণে নিবন্ধনের সময়সীমা ছিল মঙ্গলবার পর্যন্ত। কিন্তু মঙ্গলবার পেরিয়ে যাওয়ার পর দেখা গেল দ্বিতীয় ধাপের ভোট থেকে অনেক প্রার্থীই সরে গেছেন।
সরে দাঁড়ানো প্রার্থীদের বেশিরভাগই হয় ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রোর মিত্র বা বামপন্থী দলগুলোর নেতা।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নির্বাচনে ম্যাঁক্রোর দল পরাজিত হওয়ার পর তিনি দেশে আগাম পার্লামেন্ট নির্বাচনের ডাক দেন। কিন্তু তার এই পদক্ষেপ মূলত ব্যাকফায়ার করেছে বলে মনে হচ্ছে।
ম্যাঁক্রোর মধ্যপন্থী রেঁনেসা পার্টির প্রতি ম্যান্ডেট বাড়ার বদলে মারিন লো পেনের আরএন পার্টি ৩০ জুনের প্রথম ধাপের ভোটে সর্বাধিক আসন জেতে।
ইসলামবিদ্বেষী হিসাবে নিন্দিত বিভিন্ন নীতির পাশাপাশি অভিবাসন বিরোধী নীতির সমর্থন করা লো পেনের দল সরকার গঠনের জন্য দ্বিতীয় ধাপের ভোটে পর্যাপ্ত আসন জয়ের আশা করছে।
মঙ্গলবার লো পেন বলেছেন, ৫৭৭ আসনের জাতীয় পরিষদে ২৮৯ আসনের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও তার দল সরকার গঠনের চেষ্টা করবে।
ম্যাঁক্রোর মধ্যপন্থী ও বামপন্থী নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনএফপি) অবশ্য বলছে, তারা এমন ঘটনা প্রতিরোধ করতে পারবে। মঙ্গলবার এলিসি প্রাসাদে মন্ত্রীদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্রো বলেন, “এখন আমাদের সবচেয়ে বড় কাজ হল আরএনের ক্ষমতায় যাওয়া ঠেকানো।”
এমনকি ম্যাঁক্রো ঘোষণা করেন, দলের অনেকের বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রয়োজনে কট্টর-বামপন্থী ফ্রান্স আনবোড পার্টির (এলএফআই) সদস্যদের সমর্থন নেওয়া হবে। ম্যাঁক্রোর দলের সদস্যদের মধ্যে অনেকেই এলএফআইয়ের সমর্থন নেওয়ার বিরোধিতা করেন।
এলএফআই পার্টির সদস্য ফ্রাঁসোয়া রাফিনও মঙ্গলবার বলেন, “একটি লক্ষ্যে তথা ন্যাশনাল র্যালির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ঠেকাতে সবার মধ্যে ঐক্য হয়েছে।”
প্যারিস থেকে আল জাজিরার প্রতিনিধি নাতাচা বাটলার বলেন, “কট্টর-ডানপন্থী দলের প্রার্থীরা এগিয়ে রয়েছেন এমন সব আসনে মধ্যপন্থী বা বামপন্থীরা নিজেদের প্রার্থীকে সরিয়ে নিয়েছেন। যাতে লড়াইটা ত্রিমুখী না হয়ে শুধু দ্বিমুখী তথা ন্যাশনাল র্যালি (আরএন) এবং অন্য যে কোনও একটি দলের প্রার্থীর মধ্যে হয়। তখন আরএন বিরোধীরা সবাই মিলে ওই প্রার্থীকেই ভোট দেবে।
বাটলার বলেন, “এর মানে হল যে কয়েকটি নির্বাচনী এলাকায় ত্রিমুখী প্রতিযোগিতা ছিল, সেখানে কট্টর-ডানপন্থী প্রার্থীদের সঙ্গে অন্য যে কোনও একটি দলের প্রার্থীর মধ্যে দ্বিমুখী প্রতিযোগিতা হবে, তা সে মধ্যপন্থী প্রার্থী হোক বা বামপন্থী জোট প্রার্থী হোক।
“তবে রবিবারের ভোটে প্রকৃতপক্ষেই এর কতটা প্রভাব পড়বে তা এখনই অনুমান করা যাচ্ছে না”।
কট্টর রাজনৈতিক শিবিরগুলো থেকে মাত্র ৭৬ জন আইনপ্রণেতা প্রথম ধাপের ভোটে অনেক বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন।
প্রথম ধাপের ভোটের পর অধিকাংশ পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, দ্বিতীয় ধাপের ভোটে আরএন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নাও পেতে পারে।
বেশ কয়েকজন বিশ্লেষক বলেছেন, সবচেয়ে সম্ভাব্য ফলাফল হতে পারে ঝুলন্ত পার্লামেন্ট। এর ফলে মাসের পর মাস রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দিতে পারে।
এই বিশৃঙ্খলায় ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ঘোর বিরোধী ম্যাঁক্রোর আন্তর্জাতিক বিশ্বাসযোগ্যতাও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। আগামী সপ্তাহে ওয়াশিংটনে ন্যাটো সম্মেলনে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে ম্যাঁক্রোর।
এছাড়া লে পেন বলেন, তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে তিনি তার ২৮ বছর বয়সী আস্থাভাজন জর্দান বারদেলাকে প্রধানমন্ত্রী করবেন। এমনটা হলে ম্যাঁক্রোকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত একজন কট্টর-ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রীকে সামলে তার প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদ শেষ করতে হবে।
ফ্রান্সে কট্টর-ডানপন্থীদের উত্থান ঠেকাতে মধ্যপন্থী ও বামপন্থী দলগুলোর বৃহত্তর জোট গড়ে তোলার অনুরূপ প্রচেষ্টা অতীতেও সফল হয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে ২০০২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কথা বলা যায়। সেবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লো পেনের বাবাকে পরাজিত করতে ডানপন্থীদের বিরোধীরা মিলিতভাবে জ্যাক শিরাককে জিতিয়েছিল।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা