আগ্নেয়াস্ত্র কেনার সময় নিজের মাদকাসক্তি নিয়ে মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেন।
মঙ্গলবার ডেলাওয়ার রাজ্যের একটি আদালত এ সংক্রান্ত ফৌজদারি অপরাধের তিনটি অভিযোগেই তাকে দোষী সাব্যস্ত করে।
হান্টারের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র কেনার সময় নিজে মিথ্যা তথ্য দেওয়া, অস্ত্র বিক্রেতার নথিপত্রেও মিথ্যা তথ্য থাকার বন্দোবস্ত করা এবং অবৈধভাবে নিজের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র রাখার অভিযোগ আনা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী, তিনটি ফৌজদারি মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় হান্টারের সর্বোচ্চ ২৫ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে।
আগ্নেয়াস্ত্র কেনার সময় মিথ্যা তথ্য দেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ ১০ বছর, অস্ত্র বিক্রেতার নথিতে মিথ্যা তথ্য সন্নিবেশের অপরাধে সর্বোচ্চ ৫ বছর, আর মাদকাসক্ত অবস্থায় অবৈধভাবে আগ্নেয়াস্ত্র রাখায় সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে হান্টারের।
তবে প্রথমবারের মতো এ অপরাধ করায় তাকে সর্বোচ্চ সাজা নাও দেওয়া হতে পারে। সাজা কী হবে, তা জানানোর দিন এখনও ঠিক করেননি বিচারক। সাধারণত দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ১২০ দিনের মধ্যে সাজা ঘোষণা করা হয়ে থাকে।
২০১৮ সালে একটি হ্যান্ডগান বা রিভলভার কিনেছিলেন হান্টার বাইডেন। সেই অস্ত্র কেনার সময়ই নিজের মাদকাসক্তি নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন তিনি।
এরপর বন্দুকটি ১১ দিনের জন্য অবৈধভাবে নিজের কাছে রেখেছিলেন। পরে তার তৎকালীন প্রেমিকা বন্দুকটি ডাস্টবিনে ফেলে দেন। এই বিষয়ে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে অভিযুক্ত করা হয় ৫৩ বছর বয়সী হান্টারকে।
যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী, দেশটির নাগরিকদের অস্ত্র কেনার সময় আবেদনপত্রে অবশ্যই এটা উল্লেখ করতে হবে যে, তিনি মাদকে আসক্ত কি না?
৫৪ বছর বয়সী হান্টার অবশ্য আদালতে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। তার দাবি, সেই সময় তিনি মাদকাসক্তি থেকে বেরিয়ে আসার পথে ছিলেন। সেই কারণে আগ্নেয়াস্ত্রের আবেদনপত্রে তিনি যা বলেছেন, সেটাই সত্যি ছিল।
বাইডেনের আইনজীবী আবে লোয়েল বলেছেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে জোরালোভাবে সম্ভাব্য সকল আইনি পদক্ষেপ নেবেন তারা।
তবে অভিযোগ প্রমাণের পর স্পেশাল কাউন্সেল ডেভিড ওয়েস বলেন, অভিযোগটা মাদকাসক্তি নিয়ে নয়। বরং, আসক্ত অবস্থায় ‘অভিযুক্তের অবৈধ তৎপরতা’ নিয়ে।
“এই দেশে কেউ আইনের উর্ধ্বে নয়” উল্লেখ করে ওয়েস বলেন, “নিজের কৃতকর্মের দায় সবাইকেই নিতে হবে, এমনকি এই প্রেসিডেন্টপুত্রকেও।”
মাদকাসক্তি ও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে হান্টার বাইডেন দীর্ঘদিন ধরেই সমালোচনার মুখে ছিলেন। এসব বিষয় নিয়ে তাকে অনেক ভুগতেও হয়েছে।
বড় ভাইয়ের অকাল মৃত্যুতে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন হান্টার বাইডেন। তার বড় ভাই বিউ বাইডেন ২০১৫ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
হান্টার তার আত্মজীবনী ‘বিউটিফুল থিংস’-এও লিখেছেন, ভাইয়ের মৃত্যুর পরই তিনি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। ২০১৮ সালে তিনি কোকেনে আসক্তির কথা স্বীকার করেন। তবে ২০১৯ সালেই হান্টার মাদক ছাড়েন।
প্রায় ৫০ বছর আগে হান্টারের মাও তথা জো বাইডেনের প্রথম স্ত্রী তার নবজাতক মেয়েকে নিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন।
বাইডেনের প্রথম স্ত্রীর বেঁচে থাকা একমাত্র সন্তান হলেন হান্টার। এ কারণেই হয়তো হান্টার নিঃসঙ্গতা থেকে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন বলে মনে করা হয়।
হান্টার বাইডেন এমন এক সময়ে দোষী সাব্যস্ত হলেন, যখন তার বাবা জো বাইডেন আগামী নভেম্বরে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
জো বাইডেন জানিয়েছেন, আদালত তার ছেলের বিরুদ্ধে যে রায় দেবে, তা তিনি মেনে নেবেন। এমনকি তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে হান্টারকে ক্ষমা করবেন না।
তবে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি ছেলের সাজা কমিয়ে দেবেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
রায়ের পর বাইডেন বলেন, “প্রেসিডেন্ট হলেও আমি কিন্তু একজন বাবাও। জিল (বর্তমান স্ত্রী) ও আমি আমাদের ছেলেকে ভালোবাসি। তথাপি, আমি এই মামলার ফলাফল মেনে নেব। তেমনি হান্টার আপিল করলেও বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকব, তাতে কোনও হস্তক্ষেপ করব না। তবে, জিল, আমি, পরিবারের বাকি সদস্যরা সব সময় হান্টারের পাশে আছি। তার প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও সমর্থন থাকবে।”
সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হান্টারের কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি হান্টারকে ‘ভয়ংকর ব্যক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
ট্রাম্প বলেন, হান্টারের বাবা যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে খারাপ প্রেসিডেন্টদের একজন। তিনি বন্দুক নিয়ন্ত্রণের পক্ষের লোকদের খুশি রাখতে চান। তাই তিনি হান্টারকে সাহায্য করার সাহস পাবেন না।
ট্রাম্প আরও বলেন, “চিন্তা করো না, জো। আমি নির্বাচিত হওয়ার পর তোমার ছেলেকে বাঁচাব।”
ট্রাম্প নিজেও আদালতের রায়ে দোষি সাব্যস্ত। কিছুদিন আগে তাকে ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
হান্টার বাইডেন এবং ট্রাম্প উভয়েই অভিযোগ করেছেন, তারা রাজনীতির শিকার। তবে ট্রাম্প যখন তার বিরুদ্ধে দেওয়া রায়কে ‘কারচুপি’ বলে দাবি করে চলেছেন, তখন জো বাইডেন বলেছেন, তিনি তার ছেলের রায়ের ফলাফল মেনে নেবেন এবং তাকে ক্ষমা করা হোক এমনটাও তিনি চাইবেন না।
ভোটের মাঠে কতটা প্রভাব
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কোনও প্রেসিডেন্ট দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তার সন্তানের অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম।
বিরোধী রিপাবলিকান দলের নেতাকর্মীরা জো বাইডেনের পরিবার, বিশেষ করে তার ছেলে হান্টারের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে অভিযোগ করে আসছেন অনেক দিন ধরেই। গত কয়েক বছর ধরে তারা এটি প্রমাণ করতে চাইছেন যে, হান্টার তার বাবার প্রভাব কাজে লাগিয়ে অবৈধভাবে লাভবান হয়েছেন।
রিপাবলিকানদের আরও অভিযোগ, বাইডেন যখন ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন, তখন হান্টারের বিভিন্ন ব্যবসায়িক আর্থিক লেনদেন থেকে তিনি নিজেও লাভবান হয়েছিলেন।
তাদের দাবি, ২০১৫-১৬ সালে ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন জো বাইডেন তৎকালীন দুর্নীতিগ্রস্ত ইউক্রেনীয় কোম্পানিকে রক্ষা করতে হস্তক্ষেপ করেছিলেন। সেই কোম্পানির পরিচালনা বোর্ডে হান্টারও ছিলেন।
এমনকি, অতিরিক্ত মদ্যপান এবং মাদকের নেশায় আসক্ত পুত্রের আচরণ বাইডেনের নির্বাচনী প্রচারে ব্যাঘাত ঘটিয়েছিল বলে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় বাইডেনের দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির একাংশও অভিযোগ তুলেছিল।
গত সেপ্টেম্বরেই হান্টারের বিরুদ্ধে আরেকটি ফৌজদারি মামলা হয়। এতে তার বিরুদ্ধে লাখ লাখ ডলার কর ফাঁকির অভিযোগ আনা হয়। ফলে হান্টার বাইডেনের আইনি জটিলতা এখানেই শেষ নয়।
১৪ লাখ ডলার কর পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগে সেপ্টেম্বরে ক্যালিফোর্নিয়ায় তার বিচার হবে। রিপাবলিকানরা ইঙ্গিত দিয়েছেন, তারা পার্লামেন্টেও প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অভিশংসন প্রচেষ্টায় বিরামহীনভাবে কাজ করবেন।
প্রেসিডেন্টের ছেলেকে নিয়ে তদন্তকারীরা বাইডেনের বিরুদ্ধে কোনও অন্যায়ের অভিযোগ আনেননি। ফলে নির্বাচনে এর তেমন কোনও প্রভাব পড়বে না বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যালটে বাইডেনের নাম থাকবে, তার ছেলে হান্টারের নয়। ছেলের অপরাধের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের কোনও সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ নেই। আর জনমত জরিপেও বড় কোনও আভাস পাওয়া যায়নি যাতে মনে হতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ এই বিচার খুব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।
তবে এই রায় আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ শিবিরের প্রচারের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া ছেলের সাজা ঘোষণা হলে তা বাইডেনের মনোযোগও নির্বাচন থেকে অন্যদিকে সরিয়ে নিতে পারে।
রিপাবলিকান দল থেকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ট্রাম্পও সম্প্রতি দোষী সাব্যস্ত হন যৌন সম্পর্কের কথা গোপন রাখার জন্য এক পর্ন তারকাকে ঘুষ দেওয়ায়।
আগামী ১১ জুলাই তার বিরুদ্ধে সাজা ঘোষণা করা হবে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আদালতের ওই রায়কে ডেমোক্র্যাটরা নির্বাচনের মাঠে কাজে লাগাতে চাইলে রিপাবলিকানরাও তখন হান্টার বাইডেনের প্রসঙ্গ নিয়ে আসবে।
তবে বিবিসির উত্তর আমেরিকা প্রতিনিধি অ্যান্টনি জার্চার বলেন, নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হান্টার বাইডেনের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার বা সাজার রায়ও খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। কারণ সাধারণ মার্কিন জনতা দেশের ভালোমন্দের উপরে ব্যক্তিগত বিষয়কে তেমন একটা গুরুত্ব দেন না।
তথ্যসূত্র : বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স, এপি