অনূর্ধ্ব-১৯ সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ মাতাচ্ছেন মোসাম্মত সাগরিকা। দুই ম্যাচে ৩ গোল করে বাংলাদেশকে ফাইনালে পৌঁছে দিতে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সাগরিকা উঠে এসেছেন ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল উপজেলার রাঙ্গাটুঙ্গি ফুটবল একাডেমি থেকে। এর প্রতিষ্ঠাতা তাজুল ইসলাম শুধু সাগরিকা নয়, জাতীয় ও বয়সভিত্তিক দলে উপহার দিয়েছেন ১৮ ফুটবলার। উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে নানা কুসংস্কার আর সামাজিক বাধা পেরিয়ে কীভাবে এত ফুটবলার তৈরি করলেন তিনি? সকাল সন্ধ্যার রাহেনুর ইসলামকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাজুল ইসলাম জানালেন সেটাই।
প্রশ্ন : অভিনন্দন আপনাকে। আপনাদের রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেডে গড়ে ওঠা সাগরিকা তো এখন দেশের সম্পদ।
তাজুল ইসলাম : ধন্যবাদ। অনূর্ধ্ব-১৯ সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ দলে শুধু সাগরিকাই নয়, আমাদের একাডেমির আরও এক ফুটবলার স্বপ্না রাণী খেলছে। সাগরিকা গোল করছে বলে নজরে এসেছে সবার। কিন্তু মিডফিল্ডে স্বপ্না রাণী যে পুরো দলের ভারসাম্যটা ঠিক রাখছে এটা নিয়ে তেমন আলোচনা নেই। তা না হোক, আমাদের একাডেমির দুজন বয়সভিত্তিক একটা দলে খেলছে, এটা গর্বের।
প্রশ্ন : জাতীয় দলেও তো খেলেছেন রাঙ্গাটুঙ্গি ইউনাইটেডের কয়েকজন ফুটবলার…
তাজুল ইসলাম : দুই বোন সোহাগি কিসকু, কোহাতি কিসকুর সঙ্গে খেলেছেন স্বপ্না রাণী। ২০২২ সালে নেপালে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপাজয়ী দলে ছিল সোহাগী আর স্বপ্না।
প্রশ্ন : জাতীয় দল আর বয়সভিত্তিক বিভিন্ন দলে আপনাদের কতজন ফুটবলার প্রতিনিধিত্ব করেছে?
তাজুল ইসলাম : সব মিলিয়ে মোট ১৮ জন। জাতীয় দলের তিনজনের নাম তো বললাম। বর্তমান খেলোয়াড়দের মধ্যে সাগরিকা খেলছে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। অনূর্ধ্ব-১৭ দলে আছে অনন্য মুরমু বিথি। আর অনূর্ধ্ব-১৬ দলে আছে সুমি আক্তার ও রেশমি আক্তার। এর আগে বয়সভিত্তিক বিভিন্ন দলে খেলেছে মুন্নি, কাকলী, হান্না, কল্পনা, মমতাজ, শাবনুররা। বিকেএসপিতে সুযোগ পেয়েছিল ১১ ফুটবলার। এই ১১ জনের মধ্যে এখন বিকেএসপিতে আছে শুধু একজন। জাতীয় দলের তিনজন বাফুফেতেই অনুশীলন করে। অন্যরা বিকেএসপির বদলে আমাদের একাডেমির অনুশীলনে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য।
প্রশ্ন : বিকেএসপির উন্নত পরিবেশ আর অনুশীলন ব্যবস্থার বদলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটা একাডেমির অনুশীলনে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য ফুটবলারদের?
তাজুল ইসলাম : (হাসি) ভাই, আমার এখানে খেলেই তো ওরা বিকেএসপি আর জাতীয় দলে গেছে। বিশেষ কিছু একটা তো আছে এখানে।
প্রশ্ন : কী সেটা?
তাজুল ইসলাম : আমি জানি না, বিকেএসপিতে কীভাবে খেলোয়াড়দের অনুশীলন করায়। অবশ্যই তারা দেশসেরা প্রতিষ্ঠান। আমি কোনও কোচ নই, বিদেশ থেকে কোনও ডিগ্রি নিয়েও আসিনি। অভিজ্ঞতা বলতে ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত জেলা পর্যায়ে খেলা। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলেছি আমাদের বাংলা বিভাগীয় দলের হয়ে। এই অভিজ্ঞতায় জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড় তৈরি করা যায় না। তাই আমি সাহায্য নিয়েছি ইউটিউবের। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, স্পেন, ইতালি-বিভিন্ন দেশের একাডেমির অনুশীলনের ভিডিও এখন পাওয়া যায় ইউটিউবে। আমি এসবেরই অনুসরণ করি।
প্রশ্ন : তাহলে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুবিধাটুকু নিয়েছেন আপনি?
তাজুল ইসলাম : দেখুন একটা সময় মেয়েদের ফুটবল বলতে সবাই নাম নিতো ময়মনসিংহের কলসিন্দুরের। ওরাই শুরুটা করেছে। এখন শুধু কলসিন্দুর নয়, দেশের বিভিন্ন জায়গায় মেয়েদের ফুটবল হচ্ছে। আমার মনে হয়েছে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে নিজেদের উন্নতি করতে হবে। একটা জিনিস জানি, উইথ দ্য বলে যে যত ভালো, সে তত ভালো ফুটবলার। এই স্কিল উন্নতির জন্য কথা বলেছি নারী জাতীয় দলের বর্তমান কোচ সাইফুল বারী টিটু ভাই আর সাবেক কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন ভাইয়ের সঙ্গে। আমাদের একাডেমিতে ‘সি’ লাইসেন্স করা কোচ গোপাল মুর্মু সুগা আছেন। সুগা নিজের মেয়ের মতোই গড়ে তুলছেন ফুটবলারদের। তারা নানা পরামর্শ দিয়েছেন আমাকে, সবাইকে ধন্যবাদ। তাদের পরামর্শ মানার পাশাপাশি ইউটিউবের ভিডিওগুলো অনুসরণ করি আমি। সুগাকে সেই কৌশলগুলো শেখাতে বলি। মেয়েরাও সেটা উপভোগ করছে। তাই বলতে পারি ইউটিউব দেখে তৈরি করেছি জাতীয় দলের ১৮ ফুটবলার। এখানে বিকেএসপির সঙ্গে প্রতিযোগিতার কোনও ব্যাপার নেই।
প্রশ্ন : ২০১৪ সাল থেকে চলছে আপনার একাডেমি। কীভাবে চলছে এটা?
তাজুল ইসলাম : আমি যখন শুরু করি সে সময় অনেকে খারাপ মন্তব্য করেছিলেন। এলাকাটা আদিবাসী অধ্যুষিত। ওরা পড়ালেখা করতো না, ভালোভাবে বাংলাও জানতো না। গত ৯ বছরে ফুটবলের সাফল্য বদলে দিয়েছে পুরো এলাকা। কুসংস্কারমুক্ত হয়ে আদিবাসীদের পাশাপাশি বাঙালি পরিবার থেকেও এখন অনেক মেয়ে আসছে আমাদের একাডেমিতে। গত কয়েক বছর ৪০-৪৫ জন মেয়ে অনুশীলন করছে। এর তো একটা খরচ আছে। বছরে কম করে হলেও ৫ লাখ টাকা খরচ। তাদের জার্সি, বুট, পোশাক, ওষুধ, যাতায়াত, বিকেলের নাস্তা, অতিথি আপ্যায়ন মিলিয়ে এর কম খরচ হওয়ার কারণ নেই। প্রায় সব খেলোয়াড়ের বাবা-মা দরিদ্র কৃষক, দিনমজুর অথবা ইটভাটায় কাজ করে।। সাগরিকার বাবাই তো চায়ের দোকানি। তাদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার উপায় নেই।
প্রশ্ন : তাহলে প্রয়োজনীয় টাকা আসছে কোথা থেকে?
তাজুল ইসলাম : আমাদের একাডেমি পরিদর্শন করতে এসে অর্থ সাহায্য করেছেন কয়েকজন জেলা প্রশাসক। উপজেলা পর্যায়ের অনেকেও সাহায্য করেন। তবে পরিমাণটা সামান্য। বলতে পারেন ৫ লাখ খরচ হলে ৪ লাখ আমার ব্যক্তিগত। এভাবে আমি কতদিন একটা একাডেমি চালাব? সরকারি অনুদানের ভীষণ প্রয়োজন। আমি কারও কাছে হাত পাতিনি। যতদিন বেঁচে আছি ততদিন চালিয়ে নেবো হয়তো। তবে সরকারি সাহায্য বা বাফুফের অনুদান পেলে দেশের জন্য আরও অনেক প্রতিভা তুলে আনতে পারতাম। বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবল লিগে একটা দল খেলানোরও ইচ্ছা আছে আমার। এই একাডেমি থেকে ফুটবলার নিয়ে অনেক ক্লাব খেলাচ্ছে। রংপুর বিভাগীয় দল বা ঠাকুরগাঁও জেলা দলের ৮০ শতাংশ খেলোয়াড় আমার একাডেমির। কিন্তু আমি একটা দল গড়ে খেলাতে পারছি না টাকার অভাবে।
প্রশ্ন : রানীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক ছিলেন আপনি। এমন একটা পেশায় থেকে মেয়েদের নিয়ে ফুটবল একাডেমি করার ভাবনাটা এলো কীভাবে?
তাজুল ইসলাম : আমার অনুপ্রেরণা ভারতের হরিয়ানার বালালি গ্রামের মহাবীর সিং ফোগাট। সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজের মেয়েদের মুষ্টিযোদ্ধা বানিয়েছিলেন তিনি। এ নিয়ে ২০১৬ সালে বলিউডে ‘দঙ্গল’ নামের একটি সিনেমা হয়েছে, ফোগাটের ভূমিকায় ছিলেন আমির খান। আমার দুই ছেলে, কোনও মেয়ে নেই। তবে গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষদের মেয়েদের নিয়ে লড়াইটা চালিয়ে যেতে চাই আজীবন।