সাফের ফাইনালের শেষ বাঁশি বাজতেই দশরথ স্টেডিয়ামের ডাগ আউটে থাকা ফুটবলারদের জড়িয়ে ধরেন তিনি। এরপর মাঠের সব ফুটবলারদের অভিনন্দন জানান। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন দলের সঙ্গে কোনও উদযাপন করেননি। বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলকে চ্যাম্পিয়ন করেই বৃটিশ কোচ পিটার জেমস বাটলার ঘোষণা দেন দায়িত্ব ছাড়ার। বৃহস্পতিবার কাঠমান্ডুর ত্রিভূবন আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বসে সকাল সন্ধ্যার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক বদিউজ্জামান মিলনের কাছে দেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে বলেছেন, টুর্নামেন্টে তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্ক নিয়ে। বলেছেন কেন নারী দলের সঙ্গে আর কাজ করবেন না।
সকাল সন্ধ্যা : তাহলে সত্যি আপনি মেয়েদের দলের সঙ্গে থাকছেন না?
পিটার বাটলার : দেখুন আমার চুক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে আগামী মাসে। হয়তো আবার একাডেমির দায়িত্বে ফিরব। যদিও এখানে একাডেমি বলে কিছু নেই।
সকাল সন্ধ্যা : কিন্তু কেনই বা মেয়েদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন? কেন ছেড়ে যাচ্ছেন?
বাটলার : কাজী সালাউদ্দিনকে (বাফুফের সাবেক সভাপতি) কথা দিয়েছিলাম। মূলত মিস কিরণের (বাফুফের সদস্য মাহফুজা আক্তার) আগ্রহে নারী দলের দায়িত্ব নিই। তাঁদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, সাফ জিততে নিজের সেরাটা দেব এবং দিয়েছি। উনারা বলেছিলেন, এটা নির্বাচনের সময়। আমরা তোমাকে সব সময় তদারকি করতে পারব না। আমি কাজী সালাউদ্দিনকে দেওয়া আমার কথা রেখেছি।
সকাল সন্ধ্যা : ফাইনালের পর কি কোনও কথা হয়েছে তাদের কারও সঙ্গে?
বাটলার : না কথা হয়নি। শুধু মেসেজ দিয়েছেন কিরণ। সালাহউদ্দিন কোরিয়াতে আছেন (এএফসির কংগ্রেসে গেছেন কাজী সালাউদ্দিন ও কিরণ)।
সকাল সন্ধ্যা : সাফ জিততে পেরে নিশ্চয় আপনি সন্তুষ্ট?
বাটলার : আমি অবশ্যই সুখী কোচ। কারণ আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব শেষ করেছি। কাজী সালাউদ্দিনকে দেওয়া কথা রেখেছি।
সকাল সন্ধ্যা : পরপর দুবার নারী সাফে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। এই মেয়েদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?
বাটলার : মেয়েদের ফুটবলের জন্য অনূর্ধ্ব-১৬ ও অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায়ের একটা সঠিক কাঠামো দরকার। এ বিষয়ে আমার বিনীত মতামত হলো, এই দলের সিনিয়র জুনিয়র নিয়ে যে তুলনা চলে সেই তুলনাটা মোটেও করবেন না। এদের নিয়মিত খেলার সুযোগ করে দিন।
সকাল সন্ধ্যা : কিন্তু শক্তিশালী কোনও দল বাংলাদেশের সঙ্গে খেলতে চায় না।
বাটলার : এটা কোনও সমস্যা না। কবে ফিফা উইন্ডো জানি না। আমার মনে হয় পরের ম্যাচটি হতে পারে পরের বছর। কিন্তু এই মেয়েদের প্রয়োজন প্রচুর গেম টাইম। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরিবেশ। বিশেষ করে একটা নারী ফুটবল লিগ খুব গুরুত্বপূর্ণ। এবং সেটা অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে হবে।
সকাল সন্ধ্যা : নারী লিগ তো হচ্ছে নিয়মিত…
বাটলার : এখন যেটা হয় সেটা কোনও রকমে। আরও উন্নতি দরকার এটার। আমি বলতে চাই কিছু মেয়ে খেললে হবে না। এ দেশে আরও অনেক মেয়ে আছে, যারা মোটেও ফুটবল খেলার সুযোগ পাচ্ছে না।
সকাল সন্ধ্যা : গত আগস্টে শুরু হওয়া প্রথম এএফসি ওমেন্স চ্যাম্পিয়নস লিগে বাংলাদেশের কোনও ক্লাবকে খেলতে পাঠায়নি বাফুফে।
বাটলার : পরে অবশ্য ভুটানের ক্লাবে (রয়েল থিম্পু এফসিতে) কয়েকজনকে খেলানোর জন্য আমার কাছে মতামত চেয়েছিল। আমি ৪ জন মেয়ের নাম প্রস্তাব করেছিলাম। ওরা গিয়েছিল (সাবিনা খাতুন, মারিয়া মান্দা, মনিকা চাকমা, ঋতুপর্ণা চাকমা)। সেখানে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। এটা ওদের দরকার ছিল। এমন ভালো সুযোগ অন্যরাও পেলে ভালো হতো।
সকাল সন্ধ্যা : সাবিনা তো বিদেশি লিগে নিয়মিত খেলেন।
বাটলার : সে যা খেলে সেটা যথেষ্ট না। সেখানে হয়তো সে ৪-৫টা ম্যাচ খেলতে পারে। কিন্তু লিগে ধারাবাহিকভাবে খেলতে হবে। বাংলাদেশে মেয়েদের লিগ অনেক পিছিয়ে।
সকাল সন্ধ্যা : কতটা পিছিয়ে?
বাটলার : আমি দেখেছি বাংলাদেশে পুরুষ ফুটবলে প্রচুর টাকা। কিন্তু নারী ফুটবলে কিছুই নেই। মেয়েদের উঠে আসার প্রক্রিয়া, অবকাঠামো মোটেও ভালো না। তাহলে এদের উন্নতির জন্য কেন আপনি এখানে টাকা ঢালবেন না? মেয়েদের নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকতে হবে। তাহলেই অবকাঠামো গড়ে উঠবে। আমার মতামত হচ্ছে, এখন আপনারা সাফল্য পাচ্ছেন এটাকে ভালো, খুব ভালো কিংবা খারাপ কিছুই বলব না। তবে মেয়েদের ফুটবলের জন্য আরও অনেক কিছু করার আছে।
সকাল সন্ধ্যা : বাফুফের সাবেক টেকনিক্যাল ডিরেক্টর পল স্মলি মেয়েদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন …
বাটলার : পল কিছুই করেনি। পল ভুল কাজ করে গেছেন।
সকাল সন্ধ্যা : সেটা কেমন?
বাটলার : ওখানে (বাফুফের ৪ তলায়) এক গাদা মেয়ে থেকেছে। বলা হয় ওটা একাডেমির মতো। আইডিয়া হয়তো ঠিক ছিল। তবে কোনও চমৎকার ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছিল না। এখানে ৫-১০ বছরের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকতে হবে।
সকাল সন্ধ্যা : এবারের সাফে বাংলাদেশের যারা খেলেছে ওরা কি এশিয়াতে খেলার মতো সম্ভাবনাময়?
বাটলার : অবশ্যই। অবশ্যই এই দলের অনেক মেয়ে এশিয় ফুটবলে খেলার যোগ্য। এদের এখন প্রয়োজন ভালো মানের কোচিং, ভালো পরিবেশ, ভালো পুষ্টিকর খাবার ও পেশাদার প্রোগ্রাম। যদিও এখানে কাজ করে মনে হয়েছে এই মেয়েদের সেসব পাওয়াটা মোটেও সহজ কিছু না।
সকাল সন্ধ্যা : বাফুফের নতুন কার্যনির্বাহী কমিটিকে কি এসব কথা বলবেন?
বাটলার : তাদের এসব বলে কোনও লাভ হবে কি? আমি তো পরিকল্পনাকারী নই। আমি একজন কোচ মাত্র। আসলে ২-৩ বছর পর মেয়েরা নিজেদের কোথায় দেখতে চায় সেটা ভাবতে হবে এখন থেকেই। আপনাকে একটা পরিকল্পনা রাখতে হবে খেলোয়াড়দের বেড়ে ওঠার। যেমন ধরুন স্বপ্না, মুনকি, আফঈদা, কোহাতি ওরা দলের তরুণ ফুটবলার। এদের জন্য নির্দিষ্ট কর্মসূচী থাকতে হবে।
সকাল সন্ধ্যা : আঁখি খাতুন নেই দলে। সেই জায়গায় আফঈদার খেলা কেমন মনে হয়েছে?
বাটলার: আফঈদা ইজ এ রক। পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলেছে। সে বেশ লম্বা ডিফেন্ডার। এশিয়ান লেভেলে অনায়াসে খেলতে পারবে। শুধু তার দরকার উপযুক্ত পরিবেশ । সে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ফুটবল খেলার সুযোগ পায় না।
সকাল সন্ধ্যা : আপনি সাফের চ্যাম্পিয়ন কোচ। কিন্তু নেপালকে হারানোর পর মনে হলো আপনাকে ফুটবলাররা উপেক্ষা করেছে !
বাটলার : আমি লাইমলাইটে থাকতে চাইনি। তাই থাকিনি। একটা মাত্র ছবি তুলেছি। নীরবে কাজ করেছি।
সকাল সন্ধ্যা : দলে সিনিয়র-জুনিয়র দূরত্ব আপনি তৈরি করেছেন বলে অভিযোগ…
বাটলার : আমি মেয়েদের উজ্জীবিত করেছি। নতুনদের খেলাতে চেয়েছি। ওরা বুঝতে চায়নি।
সকাল সন্ধ্যা : কিন্তু কেন?
বাটলার : আমি যেভাবে খেলাতে চাই, ওরা মনে হয় সেটা বুঝতে পারেনি। দুই দিন দুটো ভিডিও পর্যবেক্ষণ করে দেখিয়েছি। একজন কোচের কাছে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো বেসিক ঠিক রাখো।
সকাল সন্ধ্যা : আপনার খেলার স্টাইল, ফিলোসফি মেনেই তো মেয়েরা মাঠে শতভাগ দিয়েছে। কিন্তু জয়ের উদযাপনের সময় মাঠের কোণায় ছিলেন কেন?
বাটলার : আমি বিশ্বাস করি ম্যাচের ৯০ মিনিট শেষে ওদের স্পেস দিতে হবে। আমি ফুটবলারের সঙ্গে কোনও বন্ধুত্বে বিশ্বাস করিনা। তাদের স্পেস তাদের কাছে। আমারটা আমার। তাই ম্যাচ শেষ হওয়ার পর আমি সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। একজন কোচ হিসেবে আপনার বুঝতে হবে কখন লাগাম টেনে ধরতে হবে, কখন ছাড়তে হবে। কোচিং- ট্রেনিং ভিডিও এনালাইসিসের সময় আমি কোচ। বাকি সময় ওরা ওদের মতো থাকবে।
সকাল সন্ধ্যা : আপনি বলেছেন বাইরের মানুষ মেয়েদের প্ররোচিত করেছে। সেটা ওদের বোঝাননি কেন?
বাটলার : কেউ যদি প্ররোচিত করে সে করতেই থাকে। তাকে বলতে পারি, এমন কাজ কোরো না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কখন সুইচ অন করতে হবে, কখন অফ করতে হবে, সেটা আমি বুঝি। আমার মনে হয়, যথেষ্ট হয়েছে। এখন এসব বিষয় থামা উচিত।
সকাল সন্ধ্যা : যখন এসব ঘটছিল আপনি নিশ্চয় হতাশ ছিলেন?
বাটলার : এসব অবশ্যই হতাশ করেছে আমাকে। দিনের পর দিন যখন এসব চলে হতাশ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমি হতাশ হয়েছি যারা এসব করছে, মেয়েদের প্ররোচিত করছে তাদের জন্য। ওরা দলে গ্রুপিং করার চেষ্টা করেছে।
সকাল সন্ধ্যা : কোচ, আমাদের বিমানে ওঠার সময় হয়ে গেছে। ধন্যবাদ আপনাকে।
বাটলার : ধন্যবাদ।