আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ‘আয়নাঘর’ নামের যে গোপন বন্দিশালায় রাখা হতো, তার হোতা নন বলে দাবি করেছেন আলোচিত সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান।
ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক, বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসানকে বুধবার আদালতে ওঠানোর পর শুনানির সময় তাকে আয়নাঘরের ‘মূল হোতা’ বলে উল্লেখ করেন বিএনপিপন্থী আইনজীবী নয়ন কাইয়ুম।
তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে জিয়াউল আহসান বলেন, “আয়নাঘরের মূল হোতা আমি? এসব কীভাবে বানান? আমি আয়নাঘরের মূল হোতা নই।”
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের এজলাসে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জিয়াউল আহসান এই দাবি করেন।
এদিন সকালে কারাগার থেকে জিয়াউল আহসানকে ঢাকার এই আদালতে হাজির করা হয়।
সেখানে তাকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান কর্নেল (অব.) মো. তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরীকে অপহরণ ও গুমের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করা হয়।
আবেদনটি করেন ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিউ মার্কেট থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. তহিদুল ইসলাম। শুনানি শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম সাইফুর রহমানের আদালত তার আবেদন মঞ্জুর করে।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, ২০১৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরীকে ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডে নিজ বাসা থেকে সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যায় আসামিরা। দুই দিন গুম করে রাখার পর তাকে ২৯ ডিসেম্বর দুটি ভুয়া মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
জামিন পেয়ে এ বিষয়ে তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী অভিযোগ জানাতে থানায় গেলে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) নথিভুক্ত করা হয়নি। এ ঘটনায় গত ১৯ সেপ্টেম্বর জিয়াউল আহসান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারেক আহমেদ সিদ্দিকীসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে নিউ মার্কেট থানায় মামলা করেন তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানকে গ্রেপ্তার দেখানোর শুনানিতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে বিচারক জিজ্ঞেস করেন, “আসামি কি অব্যাহতিপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা?”
জবাবে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “না, তিনি অব্যাহতিপ্রাপ্ত নন। অবসরপ্রাপ্ত।”
এরপর বিচারক মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেন, “উনার (জিয়াউল আহসান) নামের পাশে অব্যাহতিপ্রাপ্ত লেখা রয়েছে। এটা ঠিক করে দেবেন।”
সেসময় উপস্থিত বিএনপিপন্থী আইনজীবী নয়ন কাইয়ুম বলে ওঠেন, “উনি মূলত অব্যাহতিপ্রাপ্ত। আয়নাঘরের মূল হোতা তিনি। বিগত সরকারের খুন-গুমের কারিগর।”
তার এই বক্তব্যর প্রতিবাদে আসামি পক্ষের আইনজীবী বলেন, “আয়নাঘরের হোতা বললেই হলো? এসব পান কই?”
বিচারক তখন বলেন, “এখন তো শুনানির সময় না। আপনারা সবাই চুপ করেন।”
শুনানি শেষে জিয়াউল আহসানকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে খাসকামরায় চলে যান বিচারক।
সেসময় এজলাসে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অবস্থায় জিয়াউল আহসান বিএনপিপন্থী আইনজীবী নয়ন কাইয়ুমের উদ্দেশে বলেন, “আয়নাঘরের মূল হোতা আমি? এসব কীভাবে বানান? আমি আয়নাঘরের মূল হোতা নই। এসব আমার নামে বানানো মিথ্যা অভিযোগ।”
তখন জিয়াউল আহসানের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। পুরো ঘটনায় তারা দুজনই চুপ ছিলেন। কোনও কথা বলেননি।
এদিন সালমান এফ রহমান ও চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে ঢাকার খিলগাঁও পল্লীমা স্কুলের সামনে পরিবহন শ্রমিক সোহেলকে হত্যাচেষ্টার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
এছাড়া এদিন একই মামলায় সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীকে গ্রেপ্তার দেখানোর আবেদন করে পুলিশ। তাদের আবেদন মঞ্জুর করে আদালত।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে যেসব ব্যক্তি গুম হয়েছে বলে অভিযোগ উঠছিল, তাদের অনেকে ফেরার পর যেমন স্থানের কথা বলে আসছিল, তেমন স্থানের সন্ধান পাওয়ার কথা গত ৩ অক্টোবর জানিয়েছে গুমের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিশন।
কমিশন জনিয়েছে, ঢাকা সেনানিবাসের কচুক্ষেতে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) কার্যালয়ে গিয়ে গোপন বন্দিশালার সন্ধান পাওয়া গেছে। ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিত জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলটি (জেআইসি) ডিজিএফআইয়ের সদর দপ্তরের ভেতরে অবস্থিত। দোতলা ওই ভবনে রয়েছে মোট ২২টি সেল।
৩ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলনে গুম অনুসন্ধান কমিশনের সভাপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী জানিয়েছিলেন, তাদের কার্যক্রম শুরুর পর ১৩ কর্মদিবস পর্যন্ত ৪০০টি গুমের অভিযোগ তারা পেয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে গত ২৭ আগস্ট ৫ সদস্যের কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।