Beta
বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫

৮০০ বছর পর কেন জেগে উঠছে আগ্নেয়গিরি

আগ্নেয়গিরির যুগে প্রবেশ করছে আইসল্যান্ড। ছবি: এএফপি
আগ্নেয়গিরির যুগে প্রবেশ করছে আইসল্যান্ড। ছবি: এএফপি
[publishpress_authors_box]

একবার নয়, দুবার নয়, গত চার মাসে চার বার বিস্ফোরণ ঘটল আইসল্যান্ডের আগ্নেয়গিরিতে। সর্বশেষটি হয় শনিবার রাতে। আর সেটাই সবচেয়ে শক্তিশালী বলে দ্বীপরাষ্ট্রটির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

শনিবার স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৮টার দিকে আইসল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় রেকিয়ানেস উপদ্বীপের একটি আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাত হয়। এতে প্রায় দুই মাইল দীর্ঘ ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে।

আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ থেকে নির্গত লাভা দেশটির অন্যতম বিখ্যাত পর্যটন শহর ক্রিনতাভিকের কাছে পৌঁছে যায়। পরিস্থিতি এমন জায়গায় চলে যায় যে, আইসল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ শহরটি ও এর আশপাশের এলাকায় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে।

শনিবার অগ্ন্যুৎপাতের মাত্র ৪০ মিনিট আগে আইসল্যান্ডের আবহাওয়া দপ্তর জানতে পেরেছিল যে ক্রিনতাভিক শহরের কাছে অগ্ন্যুৎপাত হতে যাচ্ছে। বিস্ফোরণের মাত্র কয়েকটি মিনিট আগে সেখানে তারা সতর্কবার্তা পাঠাতে পেরেছিল।

শহরটিতে ৪ হাজার মানুষ বাস করলেও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় খুব বেশি মানুষ সেখানে ছিল না।   

আইসল্যান্ডের রেকিয়ানেস উপদ্বীপজুড়ে ২০২১ সাল থেকে সাতবার অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে চারটি অগ্ন্যুৎপাত হয় এই চার মাসে। এর আগে ৮০০ বছর ওই উপদ্বীপে কোনও অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটেনি।

আবহাওয়াবিদদের আশঙ্কা, আইসল্যান্ডের আগ্নেয়গিরি থেকে যে হারে লাভা নির্গত হচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে একপর্যায়ে তা উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে গিয়ে পড়বে। লাভা সাগরের পানির সংস্পর্শে এলে ছোটখাটো বিস্ফোরণ হতে পারে। এমনকি বিপজ্জনক গ্যাসও সৃষ্টি হতে পারে।

আইসল্যান্ডের আগ্নেয়গিরির ঘুমিয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না, যা নিয়ে উদ্বিগ্ন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, যে হারে অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটছে, তা দেশটির আগ্নেয়গিরির যুগে প্রবেশের ইঙ্গিতই দিচ্ছে। এবং এই যুগ কয়েক দশক এমনকি কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে।

আইসল্যান্ডের ভূতাত্ত্বিক অবস্থান

আগ্নেয়গিরি ও আইসল্যান্ড এ দুই শব্দকে আলাদা করার উপায় নেই। বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি আছে, তার একটি আইসল্যান্ড। এর কারণ হচ্ছে আইসল্যান্ড ভূতাত্ত্বিকভাবে উষ্ণবিন্দুর ওপরে অবস্থিত, যেখানে পৃথিবীর অভ্যন্তরে থাকা উত্তপ্ত উপাদান ভূপৃষ্ঠের দিকে উঠে আসে।

আরেকটি কারণ হচ্ছে ইউরেশীয় ও নর্থ আমেরিকা টেকটোনিক প্লেটের সীমানায় আইসল্যান্ডের অবস্থান। এ দুটো প্লেট খুব ধীরে ধীরে একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এর ফলে উত্তপ্ত গলিত শিলা বা ম্যাগমা বেরিয়ে আসার জায়গা তৈরি হচ্ছে।

ম্যাগমা যেহেতু ভূগর্ভে জমা হতে থাকে, তাই চাপ বাড়তে থাকে এবং একপর্যায়ে অগ্ন্যুৎপাতের মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠের ওপরে ফেটে বেরিয়ে আসে। ওই অগ্ন্যুৎপাতের সময় যে উত্তপ্ত গলিত শিলা নির্গত হয়, তাকেই লাভা বলা হয়।   

গ্রিনদাভিকের কাছে জনপ্রিয় পর্যটনস্থল ব্লু লেগুন অভিমুখী রাস্তায় চলে আসে লাভা।

কেন ঘুম ভাঙল

গোটা আইসল্যান্ডে ১০০টির বেশি আগ্নেয়গিরি আছে। এগুলোর মধ্যে ৩০টির বেশি বর্তমানে সক্রিয়।

আইসল্যান্ডজুড়ে এত আগ্নেয়গিরি থাকলেও দেশটি প্রথম লাভার স্রোত দেখেছিল কয়েকশ বছর আগে। ধারণা করা হয়, অষ্টম বা নবম শতাব্দীতে দক্ষিণাঞ্চলীয় রেকিয়ানেস উপদ্বীপে প্রথম লাভা নির্গত হয় এবং ১২৪০ সাল পর্যন্ত তা প্রবাহিত হতে থাকে।

এখন ফের সেখানে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত হচ্ছে। মাঝে প্রায় ৮০০ বছরের ব্যবধান। এই দীর্ঘ সময় আইসল্যান্ডের আগ্নেয়গিরিগুলো ঘুমিয়ে ছিল কেন?  

বিবিসি সাংবাদিকের এ প্রশ্নের জবাবে ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের মৃত্তিকা বিজ্ঞানী অধ্যাপক টামসিন ম্যাথার বলেন, “টেকটোনিক প্লেটগুলো যে গতিতে সরছে, তার সঙ্গে আমাদের নখের বৃদ্ধির তুলনা করা যায়। অর্থাৎ প্রতি বছরে কয়েক সেন্টিমিটার করে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে প্লেটগুলোর মধ্যে। 

“তবে প্লেটগুলো সহজে একে অপরের থেকে দূরে সরে না। কখনও কখনও ঝাঁকুনির মধ্য দিয়ে দূরে সরে। এবং এটাই সম্ভবত আমরা এখন রেকিয়ানেস উপদ্বীপের ক্ষেত্রে দেখছি।”

ম্যাথার বলেন, “আইসল্যান্ডের শিলাগুলো দেশটির অতীত সম্পর্কে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। শিলাগুলো প্রায় এক হাজার বছর শান্ত অবস্থায় ছিল। এরপর কয়েক শতাব্দী ধরে অগ্ন্যুৎপাত চলতে থাকে। শান্ত থেকে তারপর অগ্ন্যুৎপাত-এই যে ধরন-এটি ওই অঞ্চলে গত চার হাজার বছরে তিনবার দেখার প্রমাণ মেলে।”

আইসল্যান্ডের আগ্নেয়গিরিতে এখন যা ঘটছে, তা প্রত্যাশিতই অধ্যাপক ম্যাথারের কাছে। তিনি বলেন, “আমরা আশা করছি, আগামী কয়েক বছর ও দশকে দেশটিতে তুলনামূলকভাবে ছোট ও স্থায়ী অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটতে থাকবে।”

আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের পূর্বাভাস নিয়ে এখন কাজ করছে আইসল্যান্ড। বিশেষ করে ক্রিনতাভিক শহরের নিরাপত্তা নিয়ে তারা চিন্তিত। ডিসেম্বর থেকে মার্চের মাঝ পর্যন্ত চারবার অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা শহরটির অবকাঠামো ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।

ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব লিডসের আগ্নেয়গিরি বিশেষজ্ঞ ড. ইভগেনিয়া ইলিন্সকায়া বলেন, “আইসল্যান্ডের আগ্নেয়গিরিতে এখন অগ্ন্যুৎপাত হতে থাকবে। আগামীতে কী হতে যাচ্ছে, এ বিষয়ে বিজ্ঞানীদের ভালো ধারণা আছে।

“ভূ-গর্ভস্থ থেকে ম্যাগমা বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে মাটি কীভাবে স্ফীত হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। এখন তারা নিশ্চিত করে বলতে পারেন, ম্যাগমা কখন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করবে।”

আগ্নেয়গিরির ঠিক কোন জায়গায় অগ্ন্যুৎপাত হবে, তা আগে থেকে জানা কঠিন। আইসল্যান্ডের আগ্নেয়গিরি ইতালির মাউন্ট এতনার মতো শঙ্কু আকৃতির নয়। মাউন্ট এতনার লাভা জ্বালামুখের মোটামুটি কাছাকাছি জায়গা থেকে বেরিয়ে এসেছিল।

অন্যদিকে আইসল্যান্ডের রেকিয়ানেস উপদ্বীপে ম্যাগমা মাটির নিচে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে আছে। ফাটলের মধ্য দিয়ে এটি ভূ-পৃষ্ঠে উঠে আসবে। এসব ফাটল কয়েক মাইল দীর্ঘ হতে পারে।  

প্রাচীর নির্মাণ করে লাভা ঠেকানোর চেষ্টা করছে আইসল্যান্ড কর্তৃপক্ষ। ছবি: ফক্স নিউজ

প্রাচীর নির্মাণ

আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত-পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে ক্রিনতাভিক শহরের চারদিকে উঁচু প্রাচীর ও পাওয়ার স্টেশন নির্মাণ করছে আইসল্যান্ড কর্তৃপক্ষ। লাভার প্রবাহ ঠেকাতে এসব অবকাঠামো কার্যকর বলে মনে করা হচ্ছে।      

তবে প্রাচীরের ভেতরে যদি ফাটলের সৃষ্টি হয়, তাহলে লাভা ঠেকানোর কোনও পথ থাকবে না। ক্রিনতাভিক শহরে এ বছরের জানুয়ারিতে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। সে সময় লাভার কারণে কয়েকটি বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়।        

এছাড়া দীর্ঘসময় ধরে অগ্ন্যুৎপাত হতে থাকলে আইসল্যান্ডকে বড় ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়তে হবে।    

এবিষয়ে ইউনিভার্সিটি অব লিডসের ইলিন্সকায়া বলেন, “ক্রিনতাভিক আইসল্যান্ডের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। এর ৪০ কিলোমিটারের মধ্যে দেশটির ৭০ শতাংশ মানুষ বাস করে।

“আইসল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ সব ভবন এই শহরে অবস্থিত। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বিশাল জিওথার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বহু পর্যটন স্থাপনা ক্রিনতাভিকে নির্মাণ করা হয়। দেশটির অর্থনীতির বড় অংশ ওই পর্যটন স্থাপনাগুলো।”      

অগ্ন্যুৎপাত আইসল্যান্ডের রাজধানী রেকিয়াভিকের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন ইলিন্সকায়া।

তিনি বলেন, “রেকিয়াভিকের জন্য উদ্বেগের কারণ আছে। অগ্ন্যুৎপাত যদি রেকিয়ানেস উপদ্বীপের আরও পূর্বদিকে এগিয়ে যায়, তাহলে তা শহরটির জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। “রেকিয়াভিক এখন যেখানে, সেখানে এক হাজার বছর আগে লাভা প্রবাহিত হয়েছিল। তাই আগামীতে রাজধানী শহরটিতে লাভা প্রবাহের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত