ফিলিস্তিনের গাজায় গণহত্যা বন্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে ইসরায়েলকে আদেশ দিয়েছে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে)।
দক্ষিণ আফ্রিকার করা মামলায় শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) এই অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দিয়েছে নেদারল্যান্ডসের হেগ শহরে অবস্থিত আইসিজে। তবে দেশটির আরেক আবেদন অনুযায়ী অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আদেশ দেয়নি আইসিজে।
আইসিজের বিচারকরা বলেছেন, “ইসরায়েলকে অবশ্যই সৈন্যদের গাজায় গণহত্যা থেকে বিরত রাখতে তার সক্ষমতার আওতায় থাকা সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। এজন্য দরকার হলে সৈন্যদের শাস্তি দিতে হবে। গাজার মানবিক পরিস্থিতির উন্নতির জন্যও পদক্ষেপ নিতে হবে।”
গাজায় যুদ্ধ বন্ধের আদেশ না দিলেও আদেশে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের গণহত্যা সনদের আওতায় ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষা পাওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আছে।
আইসিজে সভাপতি জোয়ান ডোনোঘ বলেছেন, আদালত গণহত্যা মামলার জন্য যথেষ্ট প্রমাণ পেয়েছে এবং অভিযোগটি বাতিল না করে খতিয়ে দেখবে।
গাজায় মানবিক ত্রাণ সাহয়তা প্রবেশেও কোনও বাধা না দিতে আদেশ দেওয়া হয়েছে ইসরায়েলকে। পাশাপাশি আদালতের আদেশ কতটা বাস্তবায়ন করা হলো সে সম্পর্কে ইসরায়েলকে এক মাসের মধ্যে আদালতে রিপোর্ট পেশ করতে বলা হয়েছে।
গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জাতিসংঘের গণহত্যা সনদ লঙ্ঘন করা হচ্ছে, এমন অভিযোগ এনে গত ২৯ ডিসেম্বর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলাটি করে দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই মামলার শুনানিতেই এই অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ দেওয়া হলো শুক্রবার।
এই আদেশের পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকা
এই ঘটনাকে আন্তর্জাতিক আইনের চূড়ান্ত বিজয় এবং ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য ন্যায়বিচারের লড়াইয়ে একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। দেশটি ইসরায়েলকে এই আদেশ বাস্তবায়নের আহ্বানও জানিয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তরিকভাবে আশা করে যে, ইসরায়েল এই আদেশ বাস্তবায়নে বিশ্বকে হতাশ করবে না, যেমনটি তারা প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছে। তার পরিবর্তে তারা এই আদেশ সম্পূর্ণভাবে মেনে চলার জন্য কাজ করবে, যেটা তারা করতে বাধ্য।”
ইসরায়েল
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, “আমাদের বিরুদ্ধে আনা গাজায় গণহত্যার অভিযোগ মিথ্যা ও আপত্তিকর। তবে আমরা আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলব।”
তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি ইসরায়েলের প্রতিশ্রুতি অটুট আছে। পাশাপাশি নিজেদের দেশ ও জনগণকে রক্ষায় আমাদের পবিত্র প্রতিশ্রুতিও সমানভাবে অটুট থাকবে। প্রতিটি দেশের মতো, ইসরায়েলেরও আত্মরক্ষা করার সহজাত অধিকার রয়েছে।
নেতানিয়াহু বলেন, “ইসরায়েলের এই মৌলিক অধিকার অস্বীকার করার প্রচেষ্টা জঘন্য ও ইহুদি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে স্পষ্ট বৈষম্য। ফলে তা ন্যায্যভাবেই প্রত্যাখ্যান করেছি আমরা। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যার অভিযোগ কেবল মিথ্যা নয় আপত্তিজনকও এবং বিশ্বের সব শালীন লোকের তা প্রত্যাখ্যান করা উচিৎ।”
ইসরায়েল গণহত্যাকারী সন্ত্রাসী সংগঠন হামাসের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা অব্যাহত রাখবে জানিয়ে তিনি বলেন, “হলোকাস্টের পর গত ৭ অক্টোবর ইহুদি জনগণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নৃশংসতা চালিয়েছে হামাস এবং বারবার এই নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি করার শপথও নিয়েছে তারা। আমাদের যুদ্ধ হামাস সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে, বেসামরিক ফিলিস্তিনি নাগরিকদের বিরুদ্ধে নয়।”
ফিলিস্তিন
ফিলিস্তিনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই আদেশকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, এই রায় ফের সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে, কোনও রাষ্ট্রই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আদেশের পর ইসরায়েল ও তার অপরাধের দায়মুক্তিতে সমর্থণ দেওয়া দেশগুলোর হুঁশে ফেরা উচিৎ।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “আমরা ইসরায়েলসহ বিশ্বের সব দেশের প্রতি আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের রায় বাস্তবায়ন নিশ্চিতে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাই। এটি একটি অলঙ্ঘনীয় আইনি বাধ্যবাধকতা।”
হামাস
গাজায় ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধরত হামাসের সিনিয়র কর্মকর্তা সামি আবু জুহরি এক বিবৃতিতে বলেছেন, “আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের আদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি, যা দখলদার ইসরায়েলকে একঘরে করতে সহায়ক হবে এবং গাজায় তাদের অপরাধ ফাঁসে অবদান রাখবে। আমরা বিশ্বের প্রতি আদালতের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে দখলদার ইসরায়েলকে বাধ্য করার আহ্বান জানাই।”
যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, ৭ অক্টোবরের হামলার পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় তা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার রয়েছে, ওয়াশিংটনের এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আইসিজের এই সিদ্ধান্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা এখনও বিশ্বাস করি, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ ভিত্তিহীন। আইসিজেও গণহত্যা নিয়ে কোনও অনুসন্ধান চালায়নি বা আদেশে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়নি এবং হামাসের হাতে বন্দি সমস্ত জিম্মিকে নিঃশর্তভাবে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।”
ইরান
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আব্দুল্লাহিয়ান আইসিজের আদেশের পর ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকা ও ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি অভিনন্দন জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে এক পোস্টে তিনি বলেন, “আজ, ইসরায়েলি সরকারের কর্মকর্তারা বিশ্ব জনমতের সবচেয়ে ঘৃণ্য ব্যক্তি, যাদেরকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও নজিরবিহীন যুদ্ধাপরাধের জন্য অবিলম্বে বিচারের আওতায় আনতে হবে।”
আমির-আব্দুল্লাহিয়ান আরও লেখেন, “আমি অবশ্যই জোর দিয়ে বলতে চাই, ইহুদিবাদীদের অপরাধের জন্য হোয়াইট হাউসের সর্বাত্মক সমর্থনকে কখনও ভুলে যাওয়া হবে না এবং জনমতের মাধ্যমে বিবেচনা ও বিচার করা হবে।”
সৌদি আরব
গাজায় গণহত্যা বন্ধে জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণে আইসিজের আদেশের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে সৌদি আরব। শুক্রবার দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, সৌদি আরব ইসরায়েলের দখলদারিত্বমূলক কর্মকাণ্ড এবং জাতিসংঘের গণহত্যা সনদের লঙ্ঘনের প্রতি সমর্থন জানায় না।
কাতার
কাতার বলেছে, ইসরায়েলকে অবশ্যই গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জাতিসংঘের গণহত্যা সনদ অনুযায়ী সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, কাতার এই আদেশকে মানবিক বিজয় এবং আইনের শাসন ও আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের বিজয় বলে মনে করে।
মিশর
আইসিজের আদেশকে স্বাগত জানিয়ে মিশরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “মিশর গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবিতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমরা এর সিদ্ধান্তকে সম্মান ও বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেই।”
তুরস্ক
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান একে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, তিনি আশা করেন এই আদেশ বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের হামলা বন্ধ করবে।
এরদোয়ান সোশ্যাল মিডিয়ায় এক বিবৃতিতে আইসিজের আদেশকে মূল্যবান বলে অভিহিত করে বলেন, “আমরা আশা করি, এই আদেশে নারী, শিশু ও বুড়ো মানুষদের ওপর ইসরায়েলের হামলার অবসান ঘটবে।”
ইউরোপীয় ইউনিয়ন
ইউরোপীয় কমিশন এক বিবৃতিতে বলেছে, “আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের আদেশ সব পক্ষের জন্য বাধ্যতামূলক এবং তাদের অবশ্যই তা মেনে চলতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই আদেশের পূর্ণ, অবিলম্বে এবং কার্যকর বাস্তবায়ন আশা করে।”
এছাড়া ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড আইসিজের আদেশকে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। তারা ইসরায়েলকে এটি বাস্তবায়নের আহ্বান জানানোর পাশাপাশি হামাসেরও নিন্দা জানিয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও একে স্বাগত জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। তারা অবিলম্বে এটি বাস্তবায়নের জন্য ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
সাধারণ ফিলিস্তিনিদের প্রতিক্রিয়া
আল জাজিরার প্রতিবেদন মতে, গাজা ও পশ্চিম তীরের সাধারণ ফিলিস্তিনিরা এই আদেশকে স্বাগত জানালেও ইসরায়েলকে যুদ্ধ বন্ধের আদেশ না দেওয়ায় তারা হতাশা প্রকাশ করেছেন।