একটা সময় ছিল যখন আদালতপাড়ার কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে উঠত সারি সারি টাইপরাইটার মেশিনের ছবি। কানে বাজত কিবোর্ডের খটাখট শব্দ।
তখন আদালত সংক্রান্ত কোনও দালিলিক কাজ মানেই ছুটতে হতো টাইপরাইটারদের কাছে। ভীষণ ব্যস্ত আর দক্ষ হাতে তারা লিখে করে দিতেন জরুরি নথি, আর সেজন্য অপেক্ষাও করতে হতো লম্বা সময়।
তবে প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে পাওয়া গতির কাছে ধীরে ধীরে হার মানতে শুরু করে টাইপরাইটার। সেই জায়গা দখল করে নিতে শুরু করে কম্পিউটার। কারণ, কম্পিউটারে কাজ করা তুলনামূলক সহজ, সেখানে গুরুত্বপূর্ণ নথি সংরক্ষণ করে রাখা যায়, লিখতে গিয়ে ভুল হলে তা শোধরানোও সহজ।
যদিও, দ্রুতগতির কম্পিউটারের পাশাপাশি এখনও দেশের বিভিন্ন আদালতপাড়ায় টিকে আছে টাইপরাইটার। এখনও পুরোনো পেশা ধরে রাখতে প্রাণপন চেষ্টা করে যাচ্ছেন টাইপিস্টরা। কিন্তু কতদিন আসলেই তা ধরে রাখা যাবে, কতদিনই বা এই পেশার মাধ্যমে জীবনধারণ করা যাবে তা নিয়ে তাদের মধ্যেই রয়েছে শঙ্কা।
ঢাকা জজ কোর্টের পাশের পাশেই রেবতী ম্যানশনের প্রবেশ পথে টাইপরাইটার নিয়ে নিজের টেবিলে বসে ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। কথা হলো তার সঙ্গে।
সকাল সন্ধ্যার প্রশ্নের জবাবে অনেকটা স্মৃতিচারণই করলেন তিনি; বলেন, “একসময় টাইপরাইটার মেশিনের কদর ছিল। আইনজীবী বা আইনজীবী সহকারীরা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে কাজ করাতেন।
“এখন কম্পিউটারের যুগে সবার চেম্বারে কম্পিউটার। দোকানে দোকানে কম্পিউটার। টাইপরাইটারের কদর কমে গেছে। আগের মতো আর কাজ নেই। অন্য কোনও কাজ করতে পারি না বলে এখনও টাইপিংয়ের কাজ করে যাচ্ছি।”
১৯৮৭ সাল থেকে টাইপরাইটারের কাজ করেন ষাটোর্ধ্ব আবুল কালাম আজাদ। তিনি বললেন, “আগের মতো আর কাজ নেই। নির্দিষ্ট ফরমের মধ্যে লেখা, সিপি কস্ট (যে কস্ট বা খরচ পরিশোধ না করা পর্যন্ত আদালতের নির্দিষ্ট আদেশ কার্যকর হয় না), খাম কিংবা এডি টাইপ করার মতো ছোটো খাটো কাজ করতে হয়। সামান্য যা পাই তাই দিয়ে কোন রকমে সংসার চলে।”
ঢাকার মহানগর দায়রা আদালতের পশ্চিম পাশে একটি টিনশেড অংশে টাইপরাইটারদের কাজের জন্য বরাদ্দ। ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালত প্রশাসন সেখানে ৩৭ জন টাইপরাইটারের বসার অনুমতি দেয়।
সম্প্রতি গিয়ে দেখা দেখা গেল, সেখানে মাত্র দুজন সেখানে টাইপরাইটারে কাজ করেন। বাকিদের টেবিলে কম্পিউটার।
দুইজন টাইপরাইটারের একজন শেখর পাল সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “কোনও কোনও দিন সারাদিনও কাজ পাই না। সকালে এসে সারাদিন বসে থেকে খালি হাতে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরি। খুব কষ্টে দিন কাটাতে হচ্ছে।”
আবুল কালাম আজাদের পাশের টেবিলে কম্পিউটারে কাজ করছিলেন রমজান আলী। যদিও তিনি আগে টাইপরাইটারের কাজ করতেন। সময়ের সঙ্গে কম্পিউটার শিখে নিয়েছেন। তবে এখনও বিজয় কিবোর্ডে অভ্যস্ত হতে পারেননি। মুনীর অপটিমা নামে টাইপ মেশিনের কিবোর্ডের মতো মুনীর সফটওয়্যারে কম্পিউটারে কাজ করেন।
তিনি বলেন, “সরকারি চাকরির আশায় টাইপিং শিখেছিলাম, গতিও ভালো ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চাকরি না পেয়ে টাইপ রাইটিংকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম।”
আগে ঢাকার নিম্ন আদালতে ৫০-৬০জন টাইপরাইটার কাজ করতেন জানিয়ে তিনি বলেন, এই সংখ্যা এখন ৫-৬ জনে নেমে এসেছে।
নিজের টাইপরাইটার মেশিনটা কি করেছেন জানতে চাইলে রমজান আলী বলেন, “সেটি আছে। স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি। কদিন আগেও একটি সিনেমার শুটিংয়ে টাইপ মেশিনটি দিয়ে কাজ করে তিন হাজার টাকা পেয়েছি।”
পেশাদার টাইপিস্ট কল্যাণ সমিতির উপদেষ্টা সুভাষ পাল বলেন, “আমি ৪৯ বছর ধরে টাইপিং পেশার সঙ্গে জড়িত। আগে আমরা জেলা জজ ভবনের নিচতলায় ছিলাম। পরে আমাদের এখানে টিনশেড করার অনুমতি দেয়।
“শুরুতে ৩৭ জন বসার অনুমতি পেয়েছিলাম, তাদের মধ্যে কয়েকজন মারা গেছেন। যারা মারা যান তাদের স্থানে নতুন আর কেউ আসে না। নতুন করে কেউ টাইপ রাইটিং শেখে না। কোনও প্রতিষ্ঠানও আর টাইপ রাইটিং শেখায় না। আমরাই হয়তো শেষ জেনারেশন যারা মারা গেলে টাইপরাইটার পেশাটা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আমরা হারিয়ে গেলে হারিয়ে যাবে টাইপরাইটারও।”
স্মৃতিচারণ করলেন সুভাষ পালও। জানালেন, ১৯৭৫ সালে প্রতি পাতা টাইপের জন্য পেতেন ২৫ থেকে ৫০ পয়সা। তারপরেও যা পেতেন তা দিয়ে খুব ভালোভাবে চলতে পারতেন। কিন্তু এখন যা আয় করেন তা দিয়ে সংসার চালানোই কঠিন।
এক সময় ঢাকার আদালত প্রাঙ্গণ, প্রেসক্লাবের সামনে, দৈনিক বাংলার মোড়ে, ভূমি অফিসে, নগর ভবনের সামনে, রাজউক ভবন এবং ওসমানী উদ্যানের পাশে শতাধিক টাইপরাইটার কাজ করতেন বলে জানালেন সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাসান। যার অধিকাংশই এখন আর নেই।
ফরম টাইপ করতে এসেছিলেন মাহবুব নামে এক আইনজীবী। তার ভরসা এখনও টাইপরাইটারেই।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “যতদিন আদালত থাকবে ততদিন টাইপরাইটার থাকবে। কেননা আদালতের কিছু ফরম আছে যেগুলো হাতে লেখা যায় না। আবার ফরমের বিভিন্ন স্থানে লিখতে হয়, যা কেবল টাইপ রাইটার দিয়েই সম্ভব। কম্পিউটারে করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
“ফলে দেশের আদালতে টাইপরাইটার মেশিনের চাহিদা থাকবেই। তাছাড়া টাইপিস্টরা খুবই দক্ষ। তাদেরকে কোনও কাজ করতে দিলে ভুল হওয়ার টেনশনে থাকতে হয় না।”
কম্পিউটারের ঝকঝকে লেখা আর স্পষ্ট ছাপাসহ নানা সুবিধার কারণে জরুরি কাজে মানুষ আর টাইপিস্টদের কাছে যেতে চায় না। তাই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে মুদ্রাক্ষরিক পেশা। চাহিদা অনুযায়ী সরকারি অফিসগুলোও এখন টাইপ রাইটারের বদলে কিনছে কম্পিউটার। ফলে টাইপ রাইটারের সঙ্গে অফিসগুলো থেকে বিদায় নিচ্ছে সাঁটলিপিকার ও মুদ্রাক্ষরিক পদটিও।
মুনীর অপটিমা উদ্ভাবন
শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ১৯৬৫ সালে উদ্ভাবন করেন বাংলা লেখার জন্য টাইপরাইটারের আলাদা লেআউট। তার নাম অনুসারে যেটি পরিচিতি পায় মুনীর অপটিমা নামে।
এর আগে রোমান হরফ ব্যবহার করে টাইপরাইটারে বাংলা লেখা হতো। মুনীর অপটিমা লেআউটের মাধ্যমেই প্রথম সরাসরি বাংলায় লেখালিখি শুরু হয়।
মুক্তিযুদ্ধের পর ইলেকট্রনিক টাইপরাইটারেও যুক্ত হয় বাংলা লেখার এই পদ্ধতি।