জাতীয় দলের জার্মান কোচ মার্টিন ফ্রেডরিখ সব সময় তাকে ডাকেন ‘চ্যাম্পিয়ন আর্চার’ বলে। রোমান সানা যে সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন, সেটা অনেকবার প্রমাণ করেছেন মাঠের খেলায়। কখনও পদক জিতে জাতিকে ভাসিয়েছেন গর্বে। কখনও-বা ফর্ম হারিয়ে ফিরেছেন বীরের বেশে। সেই রোমানের হঠাৎ অবসরে সবচেয়ে দুঃখ পেয়েছেন ফ্রেডরিখ।
সোমবার সকাল সন্ধ্যাকে ফ্রেডরিখ বলছেন, “রোমানের এই সিদ্ধান্তে ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। সে যে অবসর নিয়েছে, সেটাই তো জানতাম না। সংবাদ মাধ্যমে ওর অবসরের খবরটা জেনেছি।”
দীর্ঘদিন মনের ভেতরে পুষে রাখা ক্ষোভ, না পাওয়ার হতাশা, সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে মানসিক চাপ। সেই চাপ থেকে মুক্তি পেতেই রোমান ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন। সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জাতীয় দলে না খেলার।
বাস্তবতা হচ্ছে, একজন অ্যাথলেটের পারফরম্যান্স সব সময় এক রকম থাকে না। ক্যারিয়ারের উত্থান পতন থাকতেই পারে। থাকতে পারে ব্যক্তিগত সমস্যাও। এসব সমস্যার কারণেই রোমান অবসর নিয়েছেন। কিন্তু এমন চ্যাম্পিয়ন অ্যাথলেটের জীবন নিষ্কন্টক করে ফর্মে ফেরানোর উপায় তো ফেডারেশনের খোঁজা উচিত।
বাংলাদেশ আর্চারিতে যত সাফল্য এর বেশিরভাগই রোমানের হাত ধরে এসেছে। বিশ্বকাপে রিকার্ভ মিশ্র ইভেন্টে দিয়া সিদ্দিকীর সঙ্গে জুটি গড়ে জিতেছেন রুপা। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে জিতেছেন ব্রোঞ্জ। নিজের যোগ্যতা দিয়ে সরাসরি খেলেছেন অলিম্পিকে। এছাড়া অন্যান্য অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পদক তো আছেই। তুলনায় শুধু এসএ গেমসে সোনা জিতেই অনেক অ্যাথলেট পেয়েছেন ফ্ল্যাট, জমি। যোগ্যতা অনুসারে মূল্যায়ন না পাওয়ার হতাশা তাকে কুরে কুরে খেয়েছে প্রতিনিয়ত। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে নতুন সংসারের আর্থিক টানাপোড়েন। তাইতো রোমান নিজের সঙ্গে লড়াই করছেন প্রতিনিয়ত।
গত ৬ বছর ধরে খুব কাছ থেকে রোমানকে দেখছেন ফ্রেডরিখ। তার অবসরের জন্য এসব বিষয়কেই সামনে আনলেন কোচ, “অবশ্যই রোমান আমার কাছে খেলোয়াড়ের চেয়েও বেশি কিছু। অনেক দিন ধরেই তো ওকে দেখছি। ও যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেট একান্তই ওর নিজের। কিন্তু এটা সত্যি ওর কিছু পারিবারিক সমস্যা রয়েছে। সঙ্গে চোট আছে। পারফরম্যান্স নিয়েও লড়াই করছে। সর্বশেষ অলিম্পিক বাছাইয়েও ভালো করেনি। সে রেজাল্ট আনতে পারছিল না, সেটা নিয়েও চিন্তিত ছিল।”
ফেডারেশন থেকে রোমান পান ৩ হাজার টাকা বেতন। আনসারের সদস্য হিসেবে পান ২৫ হাজার। সব মিলিয়ে রোমানের যা আয় তাতে এই বাজারে ভালোভাবে সংসার চালানো দায়। তাকে কি আরও সুযোগ সুবিধা দেওয়া যেত কিনা? মাঠের বাইরের এসব সমস্যার সমাধান করে নির্ভার রোমানকে অনুশীলনে ফিরিয়ে তার কাছ থেকে সেরাটা বের করা যেত কিনা? এমন প্রসঙ্গ তুলতেই কৌশলী উত্তর দিলেন ফ্রেডরিখ, “আমি এটা নিয়ে মন্তব্য করব না। কিন্তু প্রতিটি আন্তর্জাতিক পদকে বোনাস দেয় ফেডারেশন। তাছাড়া সে ফেডারেশনের চাকুরে না। সে আনসারের চাকরি করে।”
আর্চারি ফেডারেশনের ডেভলপমেন্ট ও ট্রেনিং সাব-কমিটির চেয়ারম্যান ফারুক ঢালী বললেন উল্টো কথা, “আর্চারদের প্রতি মাসের সংসার চালানোর দায়িত্ব তো ফেডারেশনের না। সে আনসার থেকে বেতন পায়। এর বাইরে দুজনের (দিয়া ও রোমান) জন্য বাড়তি ৪ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিতাম। ফেডারেশন অত ধনী না যে ফ্ল্যাট ভাড়া করে দেবে ওদের জন্য।”
রোমানের অবসরের সিদ্ধান্তকে যদিও হঠকারী বলেই মনে হয়েছে ফারুক ঢালীর, “ওকে ব্যক্তিগতভাবে অনেক বুঝিয়েছি। ওর আরও অনেক কিছু দেওয়ার আছে দেশকে। কিন্তু সে কোনও কিছু বোঝার চেষ্টা করছে না।”
বিভিন্ন সময়ে রোমানের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ফেডারেশন। শৃঙ্খলা ভাঙার দায়ে নিষিদ্ধও হয়েছেন তিনি। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য রোমানসহ অন্যদের মনোবিদের ক্লাস করানো হয়েছে বলে জানালেন তিনি, “শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে যখন নিষিদ্ধ হয় রোমান, তখন রোমানসহ অন্যদের জন্য মনোবিজ্ঞানী নিয়োগ দিয়েছিলাম আমরা। দেড় বছরের মতো ক্লাস করেছে আর্চাররা। ওয়ার্ল্ড আর্চারি নিষিদ্ধ থাকা রোমানের মানসিক উৎকর্ষ বৃদ্ধির রিপোর্ট দিতে বলতো নিয়মিত। ক্যাম্পের বাইরে থেকেও সে তখন ট্রিটমেন্ট করিয়েছে। এত কিছুর পরও উন্নতি হয়নি তার।”
রোমানের মতো চ্যাম্পিয়নদের ধরে রাখতে ফেডারেশনকে বাড়তি উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোর্শেদ, “এসব বিষয়ে আমার দেখা সেরা সিস্টেম ভারতে। ওখানে শুরুতেই চাকরি দেয় খেলোয়াড়দের। পরবর্তীতে পারফর্ম করলে অফিসে যাওয়া লাগে না। পারফরম্যান্স যদি কমে যায় তাহলে অফিসে ৩-৪ ঘন্টার কাজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এবং যখন খেলা ছেড়ে দেয় তখন ফুল টাইম দায়িত্ব দেওয়া হয়।”
ভারতের সঙ্গে তুলনায় পিছিয়ে থাকায় এমন সমস্যায় ভুগছেন বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা। তেমনটাই বললেন নিয়াজ মোর্শেদ, “আমাদের দেশে অনেক খেলায় টাকাপয়সা নেই। আর্চারির মতো দাবারও একই অবস্থা। ক্রিকেট, ফুটবল, গলফের মতো এত টাকা তাদের নেই। যদি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসে যেমনটা ভারতে রয়েছে। ওদের দেশে ইন্ডিয়ান ওয়েল, ওএনজিসির মতো প্রতিষ্ঠান স্পনসর হিসেবে এগিয়ে আসে। বাংলাদেশে যেটা কখনোই ছিল না। এখনও খুব একটা দেখি না। আমাদের দেশের যে সব করপোরেট হাউজগুলো আছে তাদের এজন্য এগিয়ে আসা উচিত। তাহলে এই সমস্যা হওয়ার কথা না।”
রোমান চিঠি দিয়েছেন, কিন্তু ফেরার জন্য কিছু শর্তও দিয়েছেন। আর্থিক নিরাপত্তা পেলে হয়তো ফিরতেও পারেন জাতীয় দলে।
যদিও রোমানের ফেরার প্রক্রিয়াটা কঠিন হবে বলে জানালেন ফারুক ঢালী, “এবার যেহেতু সে র্যাঙ্কিং টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করেনি তাই এই বছর আর তার খেলার কোনও সুযোগ নেই। ওর ফিরতে হলে আরেকটি র্যাঙ্কিং টুর্নামেন্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আমরা এরই মধ্যে বিশ্বকাপ ও এশিয়া কাপের জন্য দল নির্বাচন করে ফেলেছি। এই বছর তাই আপাতত তার ফেরার কোনও সম্ভাবনা দেখছি না।”
যার তির-ধনুকে এদেশের মানুষ আর্চারি নামের খেলাটি চিনেছে, তরুণরা আগ্রহী হয়েছে, ফেডারেশন কর্তাদের যশ-খ্যাতি হয়েছে সেই তারাই এখন অচ্ছুৎ ভাবছেন ‘চ্যাম্পিয়নকে’! অথচ তারাই পারতেন এমন প্রতিভাকে ঠিকঠাক লালন-পালন করে পথে রাখতে। প্রতিভাবানরাই খ্যাপাটে হয়, অভিমানী হয়। তাদের জীবনও সোজা-সরল রেখায় নিয়ম মেনে চলে না। এটাই বোঝেনি ফেডারেশন। তারা অনুঘটকের ভূমিকায় থাকলে সেই জীবন আবার ‘চ্যাম্পিয়ন’-এর চেহারায় ফিরতো।