Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ৯ মে, ২০২৪

গণমাধ্যম এখন

ছাপা বই থেকে সংবাদমাধ্যম: ছবির সাতকাহন

মোস্তফা জামান। প্রতিকৃতি অঙ্কন: সব্যসাচী মজুমদার

এই লেখা চিত্রবিষয়ক আলোচনা দিয়ে শুরু হওয়ার দরকার ছিল না। তবু একে নিয়তি মেনে চিত্র বা দৃশ্যগুণ এই দ্বিত্ততার মধ্যে দিয়ে শুরু করা যাক। এই সূত্রে শিল্পকলা নিয়ে বিশদ বক্তব্য দেওয়া সম্ভব এবং সেই সম্ভাবনার দিগন্তে চোখ রেখে দৃশ্য সংস্কৃতি বিষয়ে কিছু জ্ঞান উৎপাদনও সম্ভব। এ কারণে চিত্রে বা ছবিতে যে গুণাগুণ বিশদ হয়, তার বিন্দুবিসর্গ থেকে এই আলোচনা এগোতে পারে।

আঁকা ও লেখার, অর্থাৎ দেখা ও শ্রুতির জগৎকে পাশাপাশি হাজির করতে সমর্থ হন রবীন্দ্রনাথ। পূর্ণাঙ্গ ছবি আঁকার আগে এই কথাশিল্পী ১৯২৫ সালে ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপিতে কাটাকুটির মধ্যে দিয়ে দৃশ্য ফুটিয়ে তোলেন, তা সাধারণ বচনে ‘বিমূর্ত’ বলে পরিচিত। রূপ তৈরি হচ্ছে, কিন্তু তাতে সাদৃশ্যগুণ নাই। অর্থাৎ চিত্রজগতে প্রতিচ্ছবি ছাড়া চিত্র হয়ে উঠতে চাচ্ছে কবিতা থেকে কেটে ফেলা বাক্য বা বাক্যাংশ। বলাবাহুল্য, রোমান্টিক কবির ছবিতে প্রাণিসুলভ, মানবসুলভ মোটিফ যুক্ত হয়ে তা পূর্ণাঙ্গ ছবির জগতে তাঁকে নিয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর চিত্রে যা অর্জন করলেন, তা দৃশ্যগুণ ও সাদৃশ্যের সমন্বয়। এই দুইয়ের মধ্যে দিয়ে সত্যিকার শিল্প সত্যগুণ অর্জন করতে চায়— বিশেষ করে যে শিল্প অঙ্গিক বা ভাষার কাঠামো তৈরি করে ভাব তৈরিতে উদ্যোগী।  

হাতে আঁকা ছবির সত্যগুণ ভাবের সূত্রে জন্ম লয়। অন্যদিকে ক্যামেরা আবিষ্কারের পর এই যন্ত্রের সহযোগিতায় তৈরি ছবিতে সত্যগুণ তৈরি হয় দুই প্রকারে। প্রথমত: তথ্যের সূত্রে, দ্বিতীয়ত: ভাবজগতের অথবা জীবনদর্শনের নিমিত্তে। প্রথমোক্ত আলোকচিত্রে লিখিত ভাষ্যের সহযোগী হিসেবে ছবি দর্শক সমীপে পেশ করা হয়। আঙ্গিকসমৃদ্ধ চিত্রে বা শিল্পকর্মে যেমন ভাব ও বস্তুযোগে অখণ্ডতার ধারণা তৈরি হয়, একপ্রকারে আলোকচিত্রও শিল্প হয়ে ওঠে।

দৃশ্য যেন কোনো মতেই খবরের সারবস্তুকে গৌণ না করে তোলে। আর্ভিং মূলত টেলিভিশনের খবর নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এই তর্ক সামনে নিয়ে আসেন। কিন্তু এটি কাগুজে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্র— দৈনিক ও সাময়িকীর জন্যও প্রযোজ্য।

আধুনিকতার শাসন ও তার উপসর্গ এই দুইয়ের মধ্যে থেকে আজকের ছবি ও লেখার যুগল উপস্থাপনার পাঠ শুরু হতে হবে। ইয়োরোপ আধুনিকতার সূতিকাগার। সেই ‘বিশেষ’ পরিসরে ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলোর ভেতর দিয়ে যে স্বয়ংক্রিয়তার উত্থান, তারই সূত্রে ছবির পাশে ভাষ্য বা বার্তা কিংবা বার্তা বা তথ্যের পাশে ছবির কী অর্থ দাঁড়ায়, তা ব্যাখ্যা করা জরুরি। সমাজরূপান্তরের পিছে বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি ও যন্ত্রের ভূমিকা বিষয়ে জ্ঞান ব্যতিরেকে এই পাঠ সম্ভবপর না। পাঠের উত্থানও গুটেনবার্গের প্রেস আবিষ্কারের (পঞ্চদশ শতাব্দী) সঙ্গে জড়িত। ভারতে আধুনিকতার অনুপ্রবেশ ও বাংলাভাষীর ইয়োরোপমুখিনতার পাঠ ছাড়াও উপরোক্ত পাঠ সম্পূর্ণ হবে না। অর্থাৎ উপনিবেশায়ন ও পাশ্চাত্যধারায় শিক্ষিত বাঙালিদের মানসিক বিবর্তন এ অঞ্চলে ছাপানো বইয়ের ইতিহাসের শুরু ও এর বিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। আধুনিকতার আওতায় যে সরণশীল বা চলমান জীবনচর্চার শুরু তার মধ্যে বই ও পত্রপত্রিকার প্রকাশ ও প্রচার অন্যতম একটি ঘটনা। লেখা ও ছবির গাঁটছড়া আধুনিক সাহিত্যে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেনি; যদিও ঔপনিবেশিক শহর কলকাতায় বটতলার পপুলার বইপত্র ছবি ও লেখার অসম জুটিনির্ভর হয়ে জনমনে স্থান করে নিয়েছে।

সাহিত্য যদি চিত্রবৃত্তি হয় তার পাশে চিত্তের আরেকটি খোরাক দৃষ্টির বা রেখার নিমিত্তে এক করে হাজির করার সংস্কৃতি শুরু হলো বটতলার বইতে। বাংলা ভাষার স্থান তখনো ইংরেজি ও সংস্কৃতের নিচে, এমন এক যুগে ধর্মীয় পুস্তক ও পুঁথির উপস্থাপনায় আলেখ্যসমূহ ছবিসজ্জিত হয়ে পাঠক সমীপে হাজির হয়েছে। গৌতম ভদ্র জানাচ্ছেন যে উনিশ শতকের ষষ্ঠ ও সপ্তম পাদে বাংলা ভাষাকে ‘বেওয়ারিশ’ ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। তবে এই অভাববোধ বাংলায় পত্রিকা ও বইপত্র প্রকাশের উদ্যোগে গতিসঞ্চার করল। নিজে পড়া ও অন্যকে পড়ানোর উদ্যম তখনকার সময়ের যুবসমাজে গ্রন্থাগার গড়বার ও লেখালেখি করবার উৎসাহে সুস্পষ্ট। একপর্যায়ে সুরুচি ও সুনীতির পক্ষের যে সওয়াল তার মধ্যে বটতলার পপুলার নাটক-নভেলের বিরোধিতা লক্ষ করা গেল।

যে সমাজ অসম— যেখানে শ্রেণি ও ধর্মভিত্তিক জাতিতে মানুষ বিভক্ত, অমন সমাজে সাধারণের জন্য যে বই, আর উঁচুতলার প্রতিভাধর পাঠকের জন্য যে পুস্তক, তার মাঝে বিস্তর ফারাক থাকা স্বাভাবিক। আধুনিককালে এই পার্থক্য অন্যমাত্রায় উপনীত হলো। উনিশ শতকে বইয়ের দিকে মানুষকে আকর্ষণ করবার একটি উপায় হয়ত ছিল ছবি সংযোজন। চটুল বিষয়ের পাশাপাশি রহস্যময় ঐতিহাসিক বা সামাজিক বাস্তবতা নির্ভর লেখার (যা ইংরেজি মডেল অনুসারী) বিজ্ঞাপনের ভাষা থেকে পাঠক তৈরির চটজলদি উপায় সম্পর্কে জ্ঞান হবে। এমনই এক বিজ্ঞাপনের একটি বাক্য হলো— ‘ভেতরে মজা আছে, ঠকবেন না!’ ছবি এমন জনপ্রিয়তার আশায় জুড়ে দেওয়া হতো।

গৌতম ভদ্র ‘ন্যাড়া বটতলায় যায় ক’বার?’ গ্রন্থে লিখেছেন— ‘পড়া-লেখার পাশাপাশি দেখা, দেখানো ও দেখাদেখি তো অনায়াসে চলতে পারে।’

বাণিজ্যিক চিত্রায়ণের পাশাপাশি লেখা ও চিত্রের যুগল বইয়ের জগতে উচ্চরুচির প্রবেশও খেয়াল করার বিষয়। এর সংখ্যাল্পতা অনিবার্য ছিল। রাজশেখর বসুর ‘গড্ডলিকা’ গল্পগ্রন্থ (১৯২৪), যা পরশুরাম ছদ্মনামে লিখিত, আরো পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিচিত্রিতা’ (১৯৩২) কাব্যগ্রন্থ, সচিত্র বই আকারে প্রকাশিত হয়। গড্ডলিকায় তুলির কাজ করেছিলেন যতীন্দ্রকুমার সেন। ‘বিচিত্রিতা’য় রবীন্দ্রনাথের নিজের ছবিসহ দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর তুলির মহিমার ছোঁয়ায় বইটি চিত্রকলার প্রামাণ্য দলিল হয়ে উঠেছিল। এতে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ক্ষিতিন্দ্রনাথ মজুমদার, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, গৌরী দেবী, নন্দলাল বসু ও প্রতিমা দেবী প্রমুখের চিত্র ছাপা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথ এখানে শিল্পের নতুনত্ব নিয়ে বেশ কয়েকটি চিত্রপটে হাজির।

উচ্চরুচির জগতে সৃষ্টিমুখিন চিত্রী ও কবি বা লেখক তাঁদের চিত্র ও লেখায় যে উদ্দেশ্যে সাধন করেন, তার ঠিক ভিন্ন এক উদ্দেশ্য সাধিত হয় যখন সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে আলোকচিত্র যুক্ত হওয়ার চল শুরু হলো। কলকাতার ঔপনিবেশিক আধুনিকতায় বাংলা ১৩৩১ সালে ‘নাচঘর’ নামে যে নাট্য সাপ্তাহিক প্রকাশ পেল, তা ছিল, তখনকার ভাষায়, ‘চিত্রে চিত্রে সুবিচিত্রিত’। এর অনেককাল আগে থেকেই সচিত্র মাসিক পত্রিকার চল শুরু হয়। রমানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রবাসী’ এমত ধারার সবচেয়ে উদ্যমী প্রকাশনা।

প্রশ্ন হচ্ছে, প্রথমদিকের এই যে উদ্যোগ, যার পেছনে মানবিক উচ্চাশার ইশারা ছিল বলে মনে হয়, যা সেই সময়ের প্রগতিবাদী মানসিকতার আওতায় গড়ে ওঠা উন্নয়নের পথরেখা অনুসরণ করে, আজকে তার কী পরিণতি? লেখার সংগতকারী ছবি, আধুনিকতার এই যে যুগলবন্দি, একে বর্তমান ডিজিটাল যুগে কেন অনেকে মিডিয়ার উত্থান ও ক্ষমতাকাঠামোর নিমিত্তে রাজনৈতিক ভাষায় ব্যাখ্যা করেন? কেন সংবাদপত্র ও টেলিভিশনকে প্রচারমাধ্যম হিসেবে আখ্যা দিয়ে একে ভীড়ের হৃদয় নিয়ন্ত্রণ করবার ইনস্ট্রুমেন্ট বা মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয়? পাবলিক ডিসকোর্স বা লৌকিক বয়ান সৃষ্টির যে সম্ভাবনা দৈনিক পত্রিকা ও সাময়িকীর মাধ্যমে সম্ভবপর বলে মনে হয়েছিল, তার বিপরীতে ভীড়ের মন নিয়ন্ত্রণেই ফড়িয়া পুঁজির আওতায় গড়ে ওঠা মিডিয়ার ভূমিকা আজ মুখ্য। মিডিয়াতাত্ত্বিক ম্যকলুহান যেমন বলেন, ‘…কাগজ আবিষ্কার ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণে সহায়তা করেছে, ক্ষমতার কাঠামো বিকেন্দ্রীকরণে সাহায্য করতে পারেনি। সংবাদ বহনের মাধ্যমে দ্রুতশীল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীভূত শক্তির পক্ষে সম্ভব হয়েছে তার কর্মক্ষেত্রের সীমানা ক্রমে ক্রমে বাড়াতে।’ (অমিত দত্ত, ২০০১)

ছাপাখানার প্রযুক্তিগত উন্নতি কাগুজে পত্রিকা সাময়িকীর ওপর যেমন প্রভাব ফেলল তেমন কম্পিউটার প্রযুক্তি সাংবাদিকতার ডিজিটাল জগৎ উন্মুক্ত করল। ছবি সংযোগের মধ্যে দিয়ে, ছবির আধিক্য ও এর সুনির্দিষ্ট নির্বাচনের সূত্রে কাগজ ও ইলেকট্রনিক এই দুই মাধ্যমেই এক ‘রোমাঞ্চকর’ যুগের সূচনা হলো। পাঠক ওরফে দর্শক তৈরি করা মূল উদ্দেশ্য হয়ে উঠল। বিশ্বায়নের সূত্রে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের দূরত্ব ঘুচাবার ভাণ করল মাত্র। ইলেকট্রনিক মাধ্যম ও তার পাশাপাশি ওয়ার্ল্ডওয়াইড ওয়েব যোগাযোগের নতুন এক বাস্তবতার উদ্বোধন করল। বাস্তব জীবনে যোগাযোগের ক্রমসংকোচনের বিপরীতে, মিডিয়া হয়ে উঠল ভার্চ্যুয়াল বা অলৌকিক বাস্তবতা। এই বাস্তবতায় ছবি বাস্তব গায়েবীকরণের কাজটি করে, অর্থাৎ যে বাস্তবতাকে ছবি তুলে ধরে বলে মনে হয়, আসলে ওই কাজটাই সম্পন্ন হয় না। এমনটা জাঁ বদ্রিয়ারের তত্ত্ব অনুসরণে বলা যায়। এই চিন্তকের মতে, পুঁজিবাদের বর্তমান পর্যায়ে যেকোনো বস্তুই কেবল চিত্র, চিহ্ন, এমনকি গায়েবি বা শূন্যগর্ভ চিত্রে পরিণত হয়— যা শেষমেশ হাইপাররিয়েলিটি বা অতিবাস্তবতার জন্ম দেয়।

অমিত দত্ত মনে করেন যে মিডিয়ায় শেষমেশ খবর ব্যবসা, সংলাপ ও যোগাযোগ আংশিকভাবে ছবির দ্বারা নির্ধারিত হয়। তার ‘‘বিশ্বের ছবি— ছবির বিশ্ব : খবর ব্যবসার বৈশিষ্ট্যের ওপর কয়েকটি মন্তব্য’’ শিরোনামের একটি প্রবন্ধে বৈশ্বিক ব্যবস্থার অংশ হিসেবে পত্রিকায় রঙিন ছবির ব্যবহারকে চমক তৈরির সহায়ক উপাদান বলে গণ্য করা হয়েছে। লেখকের মতে, ‘ডার স্পিগল’ কিংবা ‘ডাই জিট’-এর মতো পত্রিকা যদি আগে ‘ভাষা, বিশ্লেষণ এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার দ্বারা পরিচালিত হতো’ অধুনাকালে ওদের ‘রঙিন ছবি ও আধুনিক আঙ্গিকের’ ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে দুনিয়া শাসনের যে কাঠামো পাশ্চাত্যের উপনিবেশবাদী দেশগুলো গড়ে তুলেছে, সেই প্রপঞ্চে আলোকচিত্র অন্যতম অনুষঙ্গ। প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে এমত সচিত্রকরণ নিয়তি ছিল, বলা যায়।

ছবি যে আকারের প্রতিচ্ছবি, এর ফলে এটি যে ‘সাকার’ রূপে পূজনীয় হয়ে ওঠে, অমনটা অনুভব করা যায় ফ্যাশন ইমেজে, অথবা বিনোদন ইন্ডাস্ট্রির তারকাদের ছবিতে। ছবি এখানে পুলকিত হবার সূত্রে সাকাররূপে হাজির। মূর্তিরূপে এই ছবি মানুষের মনোজগৎ অধিকার করে রাখে। এ প্রকারে নতুন মূল্যবোধনির্ভর এক দুনিয়াদারী গড়ে ওঠে, সেখানে মূর্তি বয়ান অপেক্ষা অধিক ভার বহন করে।

ব্যক্তির ও গোষ্ঠীর ভাবাদর্শ পুনর্নির্মাণে মূর্তিসুলভ আলোকচিত্র যেমন ব্যবহৃত হয়, তেমন তথ্য প্রদানে এর গুরুত্ব ততোধিক। যদিও ফটোসাংবাদিকতা তকমাটির জন্ম বহনযোগ্য ক্যামেরার সঙ্গে জড়িত, ফটোসাংবাদিকতার নতুনতর দিকদর্শনের শুরু ১৯২৪-২৫ সালে যখন জার্মানিতে লাইকা কোম্পানি ক্ষুদ্র আকারের হাইস্পিড লেন্স ক্যামেরা বাজারে ছাড়ে। ৩৫ মিলিমিটার ফিল্ম রোলের এই ক্যামেরা সৃষ্টিপাগল কার্টিয়ার ব্রেসোর হাতে ‘তুরীয় ক্ষণ’ ধরবার হাতিয়ারে পরিণত হলো। রবার্ট কাপার হাতে তা স্পেনের গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরবার বাহন হয়ে উঠল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মুহূর্তগুলো কাপা ও ইউজিন স্মিথ স্মরণীয় করে রেখেছেন।

কিন্তু ছবির পেছনের এই শক্তিশালী সত্তা, যাঁরা ফটোসাংবাদিকার মহীরুহ— তাঁদের ব্যক্তিগত বয়ান যদি রাষ্ট্রীয় ও রাষ্ট্র্রসংঘের মহাবয়ান বা অতিবয়ান থেকে ভিন্ন হয়ে যায়, তখন কি উপায় হয়? এডওয়ার্ড সাইদের বরাত দিয়ে বলা যায় যে আশির দশকের শুরুতে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে যখন প্যালেস্টাইনবাসী সাধারণের জাতীয় সংগ্রামের পক্ষে প্রদর্শনীর প্রস্তাব দেওয়া হয় তখন সাইদ ক্যাপশন ব্যবহারের অনুমতি পাননি। অর্থাৎ বিশ্ববাসীর প্রতিনিধিরা ছবি দেখতে রাজি হন, তবু ছবির পেছনে গল্প শুনতে হন গররাজি। অর্থাৎ ছবির জগতের নিয়ন্ত্রণ ছবির স্রষ্টার হাতে না থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত হয়।

আলোকচিত্র ব্যবহারের আরো একটি মাত্রা হচ্ছে আলোকচিত্র আইকন উৎপাদনে সমর্থ হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রতীক ‘টাইম’ ও ‘নিউজউইক’ সাপ্তাহিকীদ্বয় ছবি ব্যবহারে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে। ছবির মূল্য যে অপরিসীম তার মোক্ষম একটি উদাহরণ হলো আশির দশকের মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের শাসনামলে হোয়াইট হাউস থেকে উপরোক্ত দুটি ম্যাগাজিনের প্রতি নির্দেশ ছিল, যদি প্রেসিডেন্টের ওপর সমালোচনামূলক ফিচারও ছাপানো হয়, সেই ফিচারে যেন একটি পূর্ণপাতা প্রতিকৃতি যুক্ত করা হয়। কারণ, মুখাবয়ব হলো মূর্তি, যা মানুষের কাছে পূজনীয়। স্বাধীন ভারতবর্ষে এই মূর্তি নির্মাণে দেব-দেবীর রূপাশ্রয়ী করে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে জনসমক্ষে হাজির করতে হয়েছে, মার্কিনদের ক্ষেত্রে তাদের হলিউডের দ্বিতীয় শ্রেণির নায়ক হোয়াইট হাউস বিজয় করবার পরও তার জন্য হলিউডসুলভ ট্রিটমেন্ট নিশ্চিত করে রাজনৈতিক কালাকানুন অনুসারে মূর্তির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হয়েছে।

ওয়াল্টার বেঞ্জামিন যাকে ‘এসেথেটিসাইজেশন’ বা নান্দনিকীকরণ বলে আখ্যা দিয়েছেন, তা এই কালাকানুনের সূত্রে ঘটে, যা কালাকানুন থেকে জনতার চোখ অন্যত্র সরানোর কৌশলও বটে। একে মূর্তিপূজা বলা সমীচীন।

রাজনীতিতে কালাকানুনের সূত্রে মূর্তি নির্মাণ আধুনিক সমাজের পপুলার বা জনতামুখী রাজনীতির অতি দরকারী এক হাতিয়ার। এই কারণেই ছবি বয়ানসহকারে হাজির করা হয়, আবার শুধু নিখাদ ঐক্ষিক উপাদান হিসেবে নেতা বা নেত্রীর মুখাবয়ব ব্যবহার করা হয়। তবে সত্যভ্রষ্টতার প্রশ্নটি কেবল মূর্তি নির্মাণের কুশলতানির্ভর নয়। এতে যেমন লেখকের সত্যনিষ্ঠ থাকবার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি মিডিয়া আউটলেটের নিজস্ব অবস্থান কোন দেশের কোন রাজনৈতিক বাস্তবতায় গড়ে উঠেছে সেই সত্য অনেক বড় ভূমিকা রাখে।

আলোকচিত্র ঐক্ষিক বা দেখার দুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করবার একমাত্র ইনস্ট্রুমেন্ট না হওয়া সত্ত্বেও এর ভূমিকা যে গুরুত্বপূর্ণ, ডিজিটাল পরিবেশে তা ক্রমে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কেমিক্যাল আলোকচিত্রের যুগ-পরবর্তী সময়ে আজকে ফটোশপের নিমিত্তে প্রডাকশন ও প্রসেস যখন অনিয়ন্ত্রিত সম্পাদনার মধ্যে প্রবেশ করল, ছবি গড়ে তোলার সূত্রে এক নতুন সমস্যা সামনে এলো, যার নাম ম্যানিপুলেশন। আলোকচিত্রী পোস্ট-প্রডাকশনের দোহাই দিয়ে কতটা স্বাধীনতা নিচ্ছে, কতটা তার তোলা ছবি থেকে দূরে সরে গেলেন, এমনকি এমত স্বাধীনতা উনি কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলেন, এসবই ডিজিটাল যুগের প্রশ্ন।

ব্যক্তি যদি অ্যাটম হয়, সেই অ্যাটম বা একক ব্যক্তিত্ব মিডিয়া কসমসে নৈতিকতার সূত্রে সক্রিয় থেকে সত্যানুগ বা বাস্তবানুগ ছবি তুলে ধরতে পারেন।

ফটোশপের বদৌলতে যেমন সত্যের বিকৃতি ঘটে, আবার সম্পাদকীয় অজ্ঞতার কিংবা দুরভিসন্ধির সূত্রেও সত্যের পথ রোধ হয়ে যেতে পারে। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের নবম মাসে ভারতীয় সৈন্য যখন বাংলাদেশে প্রবেশ করে তখন সঙ্গী হয়েছিলেন ফটোসাংবাদিক কিশোর পারেখ। তাঁর অতি পরিচিত একটি ছবিতে ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশের সাধারণ জনতার মধ্যে থেকে এক ব্যক্তির লুঙ্গির ভেতর কোনো অস্ত্র আছে কি না, তা যাচাই করে দেখছেন। এই আলোকচিত্রটি হামেশাই পাকিস্তানি সৈন্যদের হিন্দু ও মুসলমান চেনার কৌশল হিসেবে গোপনাঙ্গ দর্শনের ছবি হিসেবে পত্রিকায় ছাপা হয়ে থাকে। অজ্ঞানতার সূত্রে যখন এমনটা ঘটে তখন তাকে অপারেশনাল বিপদের আওতায় ফেলা যেতে পারে। যদিও পত্রিকায় আলোকচিত্র সম্পাদক বলে যে বড় পদ তৈরি হয়ে আছে, সম্পাদনা পরিষদের পাশাপাশি সেই ব্যক্তির ওপর সত্যনিষ্ঠতার দায়িত্ব বর্তায়।

অতি পরিচিত এই ছবিতে ভারতীয় সৈন্যরা বাংলাদেশের সাধারণ জনতার মধ্যে থেকে এক ব্যক্তির লুঙ্গির ভেতর কোনো অস্ত্র আছে কি না, তা যাচাই করে দেখছেন। আলোকচিত্র: কিশোর পারেখ, ১৯৭১।

ছবির অপব্যবহার রোধের পাশাপাশি এর উপযুক্ত বা জুতসই ব্যবহারও ধর্তব্যে নেওয়া সাংবাদিকতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। পক্ষপাতদুষ্টতার মধ্যে এই কাজটি হয়তো বিশেষ মনোযোগের স্থান থেকে চ্যুত হয়, কিন্তু ছবি-লেখা সন্ধির মধ্যে দিয়ে যখন কেউ সামাজিক সত্য প্রতিষ্ঠা করতে চান, তাকে এই দুই ভিন্ন চরিত্রের প্রকাশমাধ্যমের মধ্যে সমঝোতার জায়গাটি বুঝে উঠতে হয়। এমন সন্ধির উপস্থাপনার সমস্যা মানব পারসেপশন বা অনুধাবন-ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত। ষাটের দশকে মিডিয়ার মোহন সাম্রাজ্য খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জার্নালিজমের অধ্যাপক ড. আর্ভিং ফ্যাঙ ছবি ও বয়ানের সামঞ্জস্যতার স্বাভাবিক একটি নীতি অনুসরণের কথা তোলেন। তাঁর মতে, পাঠক বা দর্শকের পক্ষ বিবেচনা করে ছবি ও লেখার যোগসূত্র স্থাপন জরুরি। কারণ, তাঁর মতে, ধারণকৃত দৃশ্য (যা দেখার) এবং কথন (যা শোনার), এ দুইয়ের সমন্বয় হবে তখন, যখন দৃশ্য কথনযোগ্য বিষয়টিকে গ্রহণ করার নিমিত্তে তৈরি করা হবে। অর্থাৎ দৃশ্য যেন কোনো মতেই খবরের সারবস্তুকে গৌণ না করে তোলে। আর্ভিং মূলত টেলিভিশনের খবর নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এই তর্ক সামনে নিয়ে আসেন। কিন্তু এটি কাগুজে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্র— দৈনিক ও সাময়িকীর জন্যও প্রযোজ্য।

শ্রাব্য ও দর্শনযোগ্য— এই উভয় বিষয়ই সহজপাচ্য। পাঠ্য বিষয় তুলনামূলকভাবে হজম হওয়া কঠিনতর। বিদ্যাহীনের জন্য বিদ্যার্জন ছাড়া পাঠ ও পাঠোদ্ধার দুই-ই অসম্ভব। আধুনিকতার আওতায় রোজগার ছাড়া অন্যত্র এক প্রকার শ্রমহীনতার বিকাশ লক্ষণীয়। নিউ মিডিয়ার বদৌলতে মানুষ এখন যত চলমান ও স্থির দৃশ্যে চোখ রাখে, ততটা লেখায় চোখ রাখে না। নতুন যুগের এই নির্বিকার হজমপন্থী বান্দার এই দশা থেকে তাকে মুক্ত না করে, তাকে ছবির ও ভিডিও কনটেন্টের গ্রাহক হিসেবে গণ্য করে, তাকে ছবির মাধ্যমে পাঠে উদ্বুদ্ধ করবার নয়া প্রক্রিয়া এ কারণেই ত্রুটিপূর্ণ।

পাঠক তৈরিতে উদ্যমী এমন কয়েকটি পত্রিকা এখনো টিকে আছে। বাংলাদেশে লিটল ম্যাগ নামের সাময়িকী স্বর্ণযুগ পার হয়ে পতিত অবস্থায়ও ছবি কমই ছাপছে। কলকাতার বিকল্পধারার প্রকাশনার জগৎও এখনো ছবির ব্যাপারে প্রয়োজন ছাড়িয়ে যাওয়ার কারণ খুঁজে পায়নি। কিন্তু দৈনিক পত্রিকা যেহেতু খবর সংক্রান্ত এবং খবর যেহেতু সেনসেশন বা উত্তেজনা তৈরির মাধ্যমও বটে—অমন পত্রিকার পাতায় ছবির উৎসব এখন স্বাভাবিকতা অর্জন করেছে।

গত দুই দশকে সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে কসম্যাটিক অঙ্গসৌষ্ঠব একটি বিশেষ উপাদান হিসেবে হাজির হয়েছে। জাতীয়তাবাদের দর্শনযোগ্য কিছু নমুনা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যেমন উৎসবমুখর চেহারা দান করেছে, তেমনি পত্রিকার পাতায়ও তার উদযাপন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ফলে ফ্যাশনে ও পতাকার রঙের জামাকাপড় পরিচয়ের চিহ্ন হিসেবে আজ চর্চিত। দৈনিকে ফ্যাশন সেকশনে এর প্রমোশন একে বৈধতা দিচ্ছে এবং এর মাত্রা বাড়িয়ে তুলেছে। সমাজের এসেথেটিসাইজেশন বা নান্দনিকীকরণের মূল সমস্যা এখান থেকেই সূচিত— যার ফল দাঁড়ায় রাজনৈতিকতা ও প্রচলিত পাবলিক ডিসকোর্স বা লৌকিক আলাপের থেকে সমষ্টিগতভাবে দূরে চলে আসা— এমনটা বাংলাদেশে ঘটে চলছে। পত্রিকার পাতায় যখন এসএসসির ফলাফল ছাপানোর পাশাপাশি যারা ভালো করছে তাদের উদযাপনের ফ্যাশনেবল ছবি ছাপা হয়, তার পাশাপাশি বছরজুড়ে শিক্ষার মান ও শিক্ষাসংক্রান্ত নানা বিষয় নিয়ে ছাপানো বিষয়াদি ম্লান হয়ে পড়ে।

মানুষের মনোযোগ এক অস্থায়ী বস্তুর মতো। একে জাগিয়ে রাখতে আজকের সবচেয়ে জরুরি ভাবনাটি হলো মনকে ফ্যাশন ইমেজ বা অমন জাদুকরি মূর্তি থেকে অধিককাল ‘খোদ’ ইমেজ বা ছবির মধ্যে থিতু রাখা। খোদ শব্দটি দ্বিবিধ অর্থে ব্যবহার করা যায়— প্রথমত, যে ছবি সামাজিক সত্যের কাছাকাছি; দ্বিতীয়ত, যে ছবি ফুটিয়ে  তুলতে মুখের ভাষাসহ আরো আরো সৃষ্টিশীল ভাষার— যেমন কবিতা, গান, নাটক বা সিনেমার প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশ নামের দেশের যে স্বপ্ন মানুষ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর থেকে দেখতে শুরু করে, সেই ছবি এমন খোদ বাসনার সঙ্গে সম্পৃক্ত, যা মানুষের সত্য ও সৎ অস্তিত্বকে চিনিয়ে দেয়। নতুন সমাজ গড়ার এটিই সোপান। পোশাকের মধ্যে দিয়ে নিজেকে হাজির করবার নান্দনিক শিষ্টাচারের মধ্যে দিয়ে যা সম্ভব নয়।

লেখক: শিল্পী, শিল্পসমালোচক ও কিউরেটর।