বিশ্বের তেলসমৃদ্ধ অঞ্চল মধ্যপ্রাচ্য এখন যুদ্ধের ডামাডোলে। গাজায় যুদ্ধের দুই বছর হতে চলছে, তার মধ্যে পাঁচ দিন ধরে ইরান আর ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলা চলছে। সেই হামলায় ইরানের জ্বালানি স্থাপনাও হয়েছে আক্রান্ত।
চার বছর ধরে চলা ইউক্রেন যুদ্ধের জের টানতে হচ্ছে গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকে। তার মধ্যে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত বিশ্বের তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।
ইসরায়েল ইরানের বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কমান্ডার এবং পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা ও তাদের কিছু পারমাণবিক স্থাপনার ক্ষতি করার একদিন পর জ্বালানি খাতে হামলা চালায়।
মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী দুই সামরিক বাহিনীর মধ্যে সংঘাত একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিকে ধাবিত হওয়ায় আর্থিক বাজার এবং বিমান চলাচল খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্লেষকরা তেলের দামের দিকে সতর্ক নজর রাখছেন, বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণের মতো নিরাপদ ধাতুর দিকে ঝুঁকছেন।
তেলের দামে কী হবে
সংঘাত শুরুর তৃতীয় দিন সোমবার বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৭৪.৬০ ডলারে পৌঁছেছে। সংঘাত শুরুর আগের দিন বৃহস্পতিবারের তুলনায় দাম বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ।
বিশ্বের বেশিরভাগ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্য মধ্যপ্রাচ্যের ব্যস্ত সমুদ্র পথ দিয়ে পরিবাহিত হয়। এর বেশিরভাগ আবার যায় হরমুজ প্রণালী দিয়ে।
ইরান ঘেঁষা এই প্রণালী পারস্য উপসাগরকে আরব সাগর তথা ভারত মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। বিশ্বের সাগরপথে সরবরাহ হওয়া তেলের এক-তৃতীয়াংশ (দৈনিক প্রায় ২১ মিলিয়ন ব্যারেল) এই প্রণালী দিয়ে যায়।
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সংঘাতে হরমুজ প্রণালী দিয়ে তেল পরিবহন বন্ধ হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইরান এই প্রণালী বন্ধ করে দিলে তেলের দাম যাবে বেড়ে।
ইরানের আইনপ্রণেতা ইসমাইল কোসারির উদ্ধৃতি দিয়ে দেশটির সংবাদ সংস্থা ইরনা জানিয়েছে, তেহরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করার কথা বিবেচনা করছে।
বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকসের অনুমান, হরমুজ প্রণালী ইরান অবরোধ করলে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
তবে আশার কথা, গত শতকের ৮০ এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধ এবং এরপর মধ্যপ্রাচ্যে নানা সংঘাতেও হরমুজ প্রণালী কখনোই সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়নি।
তাছাড়া হরমুজ প্রণালী অবরোধ করলে তেহরানের নিজস্ব রপ্তানি ব্যাহম হওয়ার পাশাপাশি তাদের রাজস্ব আয়ও কমিয়ে দেবে।
অর্থনীতি বিশ্লেষক হামজেহ আল গাওদের মতে, হরমুজ প্রণালী বন্ধ করাটা ইরানের অর্থনীতির জন্য বুমেরাংই হবে।
বৈশ্বিক মুল্যস্ফীতিতে কী প্রভাব
তেলের দাম বাড়লে উৎপাদন খরচও বাড়ে। বিশেষ করে খাদ্য, পোশাকের মতো পণ্যের দাম বেড়ে যায়। বাড়তি ব্যয়টি শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপরই চাপে।
সংঘাত চলতে থাকলে বিশ্বের তেল আমদানিকারক দেশগুলোতে উচ্চ মুল্যস্ফীতি এবং ধীর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দেখা দিতে পারে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, তাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ক্রমবর্ধমান মূল্য নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টায় নানা ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখাতে পারে।
আল গাওদ বলেন, “জি-সেভেন এর কেন্দ্রীয় ব্যাংকাররা বর্তমানে সুদের হার কমানোর চেষ্টায় রয়েছেন এবং তাই জ্বালানি মূল্যের সম্ভাব্য ধাক্কা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকবেন।”
ব্যাংক অব ইংল্যান্ড সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের সুদের হার ৪.২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক ঝড়ের পর যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক সেপথে এগোয়নি।
পুঁজিবাজারে কী হবে
সংঘাতের প্রথম ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজার ওয়াল স্ট্রিট। শুক্রবার এসঅ্যান্ডপি ৫০০ এবং নাসডাক কম্পোজিট সূচক যথাক্রমে ১.১ এবং ১.৩ শতাংশ কমেছে। মধ্যপ্রাচ্যে মিশরের পুঁজিবাজারে সূচক রবিবার ৭.৭ শতাংশ কমেছে। তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জে সূচক কমেছে ১.৫ শতাংশ।
ইসরায়েলের হামলার খবরে ইউরোপে বিভিন্ন শেয়ারের দরপতন হয়েছে। আবার যুক্তরাজ্যে নিরাপত্তা কোম্পানি বিএই সিস্টেমসের শেয়ার দর বেড়েছে, যা চলমান উত্তেজনার যথার্থ প্রতিফলন। যুক্তরাষ্ট্রেও লকহিড, নর্থরপ গ্রুমান ও আরটিএক্সসহ যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহকারীদের শেয়ারের দাম বেড়েছে।
বিভিন্ন বাজারে তেল কোম্পানি বিপি ও শেলের শেয়ার দর ঊর্ধ্বমুখী।
স্বর্ণের দামও শুক্রবার প্রায় ১ শতাংশ বেড়ে আউন্স প্রতি ৩ হাজার ৪২৬ ডলারে লেনদেন হচ্ছিল, যা এপ্রিলে ওঠা ৩,৫০০ ডলারের রেকর্ড উচ্চতার কাছাকাছি।
আল গাওদ বলেন, “মনে হচ্ছে বাজারগুলো আশা করছে যে সংঘাত তুলনামূলকভাবে সীমিত থাকবে।”
আকাশপথে কী প্রভাব
বেশ কয়েকটি বিমান সংস্থা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ফ্লাইট স্থগিত বা বাতিল করেছে এবং কিছু দেশ তাদের আকাশপথ বন্ধ করে দিয়েছে।
এমিরেটস: মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম বিমান সংস্থাটি জানিয়েছে যে তারা ৩০ জুন পর্যন্ত ইরাক, জর্ডান, লেবানন এবং ইরানের ফ্লাইট স্থগিত করেছে।
ইতিহাদ: রবিবার পর্যন্ত আবুধাবি ও তেল আবিবের মধ্যে সমস্ত ফ্লাইট বাতিল করেছে। বিমান সংস্থাটি অন্যান্য বেশ কয়েকটি পরিষেবাও রুট পরিবর্তন করছে এবং গ্রাহকদের তাদের ফ্লাইটের অবস্থা সম্পর্কিত হালনাগাদ তথ্যের জন্য অপেক্ষা করতে বলেছে।
কাতার এয়ারওয়েজ: ইরান, ইরাক ও সিরিয়ার ফ্লাইট সাময়িকভাবে বাতিল করেছে কাতারের পতাকাবাহী বিমান সংস্থাটি।
ইরানের সরকারি বার্তা সংস্থা ইরনা জানিয়েছে, বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত দেশের আকাশপথ বন্ধ করে দিয়েছে।
শুক্রবার ইরাকও তার আকাশপথ বন্ধ করে দেয় এবং তার বিমানবন্দরগুলোতে কার্যক্রম স্থগিত করে দেয়।
পূর্ব ইরাক বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত বিমান করিডোর। ইউরোপ ও উপসাগরের মধ্যে চলা ডজন ডজন ফ্লাইট সেই আকাশ দিয়ে ওড়ে।
জর্ডানের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা বিপদ এড়াতে দেশের আকাশপথ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে।
আল গাওদ বলেন, “মধ্যপ্রাচ্যের পর্যটন স্বল্প মেয়াদে ব্যাহত হতে পারে। তা শুধু মাসখানেকের জন্য। তারপর আমার মনে হয় পর্যটন আবার গতিশীল হবে।”
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা