অর্থ সংকটের কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) কাটছাঁট করেও লক্ষ্যপূরণ করতে পারেনি সরকার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে অর্থাৎ জুলাই-মে সময়ে সংশোধিত এডিপির (আরএডিপি) ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৭৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে, যা মোট বরাদ্দের ৫৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার বরাদ্দসহ সব মিলিয়ে মূল এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৪ কোটি ২ লাখ টাকা।
গত ১২ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় ওই এডিপি থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি কমিয়ে ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩৯১ কোটি ৬৪ লাখ টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-মে মেয়াদে আরএডিপির ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৭৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা খরচ করেছে সরকার। বাস্তবায়নের হার ৫৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ, যা চার অর্থবছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই ১১ মাসে বাস্তবায়নের হার ছিল ৬১ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৬৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ২০২০-২১ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাস্তবায়নের হার ছিল যথাক্রমে ৫৮ দশমিক ৩৬ ও ৫৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
কোভিড মহামারীর কারণে ২০২০-২১ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার কম ছিল।
হিসাব বলছে, বিদায় নিতে যাওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংশোধিত এডিপির পুরোটা খরচ করতে হলে অর্থবছরের বাকি এক মাসে (জুন) ১ লাখ ৮ হাজার ১৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা ব্যয় করতে হবে।
একক মাসের হিসাবে সবশেষ মে মাসে ২১ হাজার ৫৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা খরচ করেছে সরকার।
সংকটের এই সময়ে এক মাসে (জুন) ১ লাখ কোটি টাকার বেশি খরচ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, “দুই বছরের করোনা মহামারির ধাক্কা কাটতে না কাটতেই আড়াই বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের অর্থনীতি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি রয়েছে। সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের পথ বেছে নিয়েছে। এ অবস্থায় এক মাসে এক লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা খরচ করা খুবই কঠিন।
“আর যদি তড়িঘড়ি করে এই টাকা ব্যয় করা হয়, প্রকল্পের কাজের মান ভালো হবে না। এ পরিস্থিতিতে দেশের বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ খরচ করতে হবে। সেক্ষেত্রে এবার যদি বছর শেষে এডিপি বাস্তবায়নের হার অন্যান্য বছরের চেয়ে কমও হয়, তাতেও সমস্যা নেই।”
তিনি বলেন, “আমরা সবাই জানি, সরকার সংকটের মধ্যে আছে। এ অবস্থায় এবার এডিপি বাস্তবায়নের হার কম হলেও সমস্যা নেই। প্রতিবারের মতো ৮৫-৯০ শতাংশ বাস্তবায়ন হতে হবে—এটার কোনও কথা নেই। এবার বছর শেষে যদি সার্বিক বাস্তবায়ন ৬৫-৭০ শতাংশও হয় তাতেই যথেষ্ট বলে আমি মনে করি।”
১১ মাসে বাস্তবায়ন ৫৭.৫৪%
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) বুধবার এডিপি বাস্তবায়নের যে হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ২০২৩–২৪ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে অর্থাৎ জুলাই-মে সময়ে সংশোধিত এডিপির ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৭৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে, যা মোট বরাদ্দের ৫৭ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
২০২২–২৩ অর্থবছরের এই ১১ মাসে খরচ হয়েছিল ১ লাখ ৪৬ হাজার ২১কোটি ৮৯ লাখ টাকা। শতাংশ হিসাবে যা ছিল ওই বছরের আরএডিপির ৬১ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
২০২১–২২ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে খরচ হয়েছিল ১ লাখ ৪২ হাজার৩৮৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা। বাস্তবায়নের হার ছিল ৬৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
২০২০–২১ অর্থবছরের এই ১১ মাসে খরচ হয়েছিল ১ লাখ ২২ হাজার ১৩১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। শতাংশ হিসাবে যা ছিল ওই বছরের আরএডিপির ৫৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
২০১৯–২০ অর্থবছরের জুলাই-মে বাস্তবায়নের হার ছিল ৫৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ; খরচ হয়েছিল ১ লাখ ১৫ হাজার ৪২১ কোটি লাখ টাকা।
আইএমইডির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবশেষ মে মাসে সংশোধিত এডিপির ২১ হাজার ৫৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। শতাংশ হিসাবে যা ৮ দশমিক ২৮ শতাংশ।
গত বছরের মে মাসে ব্যয় হয়েছিল ২৬ হাজার ৯৫৯ কোটি ৫১ লাখ টাকা। শতাংশ হিসাবে ওই বাস্তবায়নের হার ছিল ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ।
প্রতি বছরই সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি তথা এডিপিতে বরাদ্দ বাড়ে। সেই অনুযায়ী খরচও বাড়ে।
সেই ধারাবাহিকতায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার বরাদ্দসহ সব মিলিয়ে এডিপির মোট আকার ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৭৪ হাজার ৬৭৪ কোটি ২ লাখ টাকা। এর মধ্যে মূল এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা।
বাকি অর্থ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার নিজস্ব অর্থ থেকে জোগান দেওয়া হবে বলে লক্ষ্য ধরা হয়েছিল।
অর্থ সংকটের কারণে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের এডিপির আকার বাড়ানো হয়নি বলেই চলে।
গত ৬ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রায় আট লাখ কোটি টাকার যে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন, তাতে এডিপির আকার ধরা হয়েছে ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, বিদায়ী অর্থবছরের মূল এডিপির চেয়ে নতুন এডিপির আকার বেড়েছে মাত্র ২ হাজার কোটি টাকা।
সবচেয়ে বেশি খরচ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ
আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সর্বোচ্চ বরাদ্দ প্রাপ্ত ১৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগে গড় বাস্তবায়ন হয়েছে ৬২ দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ। জুলাই-মে সময়ে এই ১৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সব মিলিলয়ে এক লাখ ২১ হাজার ৮৫৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা খরচ করেছে।
সংশোধিত এডিপির ৭৭ দশমিক ১৯ শতাংশই বরাদ্দ আছে এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের।
এর মধ্যে শতাংশ হিসাবে সবচেয়ে বেশি, ৭৭ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৭২ দশমিক ৯৮ শতাংশ খরচ করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। তৃতীয় সর্বোচ্চ ৭১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ ব্যয় করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
এছাড়া ৬৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। ৬৪ দশমিক ১৩ শতাংশ খরচ করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ব্যয় করেছে ৫৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
৪৯ দশমিক ৪২ শতাংশ বাস্তবায়ন করেছে সেতু বিভাগ। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় খরচ করেছে ৬৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ; গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ৫৮ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ৬৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ৫২ দশমিক ৬৮ শতাংশ, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ ৪৩ দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ ৫৮ দশমিক ২৩ শতাংশ, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ৪২ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের খরচ হয়েছে ৫২ দশমিক ৮৭ শতাংশ।