Beta
বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
বুধবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২৫
আদালতের রায়ে নাটকীয় মোড়

ইমরান খানের দল এখন পাকিস্তান পার্লামেন্টে বৃহত্তম

আদালতের রায়ে সংরক্ষিত আসনে ভাগ পাওয়ায় পিটিআই এককভাবে সবচেয়ে বেশি আসনের অধিকারী হতে যাচ্ছে।
আদালতের রায়ে সংরক্ষিত আসনে ভাগ পাওয়ায় পিটিআই এককভাবে সবচেয়ে বেশি আসনের অধিকারী হতে যাচ্ছে।
[publishpress_authors_box]

পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)।

পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদের সংরক্ষিত আসনের ভাগ পাওয়ায় দলটি এককভাবে সবচেয়ে বেশি আসনের অধিকারী হতে যাচ্ছে।

অন্যদিকে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাচ্ছে মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) নেতৃত্বাধীন জোট সরকার।

গত ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে পিটিআই এবং সুন্নি ইত্তেহাদ কাউন্সিল (এসআইসি) সম্মিলিতভাবে ৯২টি আসনে জয় পেয়েছিল। সংরক্ষিত আসন থেকে আরও ২২টি আসন পাওয়ায় তাদের আসন বেড়ে হচ্ছে ১১৪টি।

জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম-ফজলুর রহমানের (জেইউআই-এফ) আছে ৮টি, পশতুনখোয়া মিলি আওয়ামী পার্টি (পিকেএমএপি), বেলুচিস্তান ন্যাশনাল পার্টি (মেঙ্গল), এবং মজলিস ওয়াহদাত-ই-মুসলিমীন (এমডাব্লিউএম) এর একটি করে আসন রয়েছে। এর অর্থ জাতীয় পরিষদে বিরোধীদের মোট আসন এখন ১২৫ হবে।

ক্ষমতাসীন জোটের আসন হবে ২০৯, যা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় ২২৪ আসনের চেয়ে কম। পাকিস্তানের জাতীয় পষিদের মোট আসন সংখ্যা ৩৩৬টি। ফলে সংবিধান সংশোধন এবং আইন প্রণয়নেও পিটিআইয়ের সমর্থন লাগবে।

জোটের সবচেয়ে বড় দল পিএমএল-এন এর আসন কমে ১০৮টিতে দাঁড়িয়েছে। আর পিপিপির আসন ৬৮টি। মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্টের (এমকিউএম) ২১টি, মুসলিম লীগ (কিউ)-র ৫টি এবং ইস্তেহকাম-ই-পাকিস্তান পার্টির (আইপিপি) আছে ৪ আসন।

শুক্রবার পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ইমরান খানের দলকে সংরক্ষিত আসন পাওয়ার যোগ্য বলে ঘোষণা করে রায় দেয়। এর ফলেই এই আসন পুনর্বণ্টন হয়।

মামলাটি করেছিল সুন্নি ইত্তেহাদ কাউন্সিল (এসআইসি)। পিটিআই-সমর্থিত প্রার্থীরা ৮ ফেব্রুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধ্য হয়েছিল। পরে তারা এসআইসিতে যোগ দেয়।

একটি ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে গত বছরের আগস্ট থেকে কারাগারে আছেন ইমরান খান। পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন (ইসিপি) তার দলকে ক্রিকেট ব্যাট প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার কেড়ে নেয়।

ফলে পিটিআই প্রার্থীদের স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছিল। তবুও তারা জাতীয় পরিষদে ৯৩টি আসন জিতে পর্যবেক্ষকদের হতবাক করে, যা অন্য যেকোনও দলের চেয়ে বেশি। পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএলএন) ৭৫টি আসন নিয়ে দ্বিতীয় এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ৫৪টি আসন নিয়ে তৃতীয় স্থানে ছিল।

ইমরান খান তার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বির সঙ্গে হাত মেলাতে অস্বীকৃতি জানালে পিএমএলএন ও পিপিপি অন্যান্য ছোট দলগুলোকে নিয়ে একটি জোট সরকার গঠন করে।

পাকিস্তানের আইনে সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের ২৬৬টি আসনে সরাসরি ভোট হয়। বাকী ৭০ আসন সংরক্ষিত (৬০টি নারীদের ও ১০টি সংখ্যালঘুদের জন্য) থাকে। এসব আসন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তাদের নির্বাচনী পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে বণ্টিত হয়। সরকার গঠনে লাগে ১৬৯টি আসন। আর সাংবিধানিক সংশোধনী পাসের জন্য প্রয়োজন হয় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তথা ২২৪টি আসন।

শুক্রবারের রায়ে সুপ্রিম কোর্ট পিটিআইকে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবেও স্বীকৃতি দিয়েছে। আদালত বলেছে, নির্বাচনী প্রতীক না থাকলেও একটি দলের ভোটে প্রার্থী দেওয়ার আইনি অধিকার থাকে।

রায়ে বলা হয়, “পিটিআই একটি রাজনৈতিক দল ছিল এবং আছে। এটি ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে সাধারণ আসনও পেয়েছে।”

আদালত পিটিআইকে দুই সপ্তাহের মধ্যে সংরক্ষিত আসনের জন্য নামের তালিকা জমা দিতে নির্দেশ দিয়েছে।

রায়ের পর পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন (ইসিপি) এসব আসনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের ৭৭ জন এমপির বিজয়ের বিজ্ঞপ্তি স্থগিত করেছে।

বরখাস্ত আইনপ্রণেতাদের মধ্যে পিএমএল-এন থেকে ৪৪, পিপিপি থেকে ১৫, জেইউআই-এফ থেকে ১৩ এবং পিএমএল-কিউ, আইপিপি, পিটিআই-পি, এমকিউএম-পি এবং এএনপির একজন করে রয়েছেন।

এর মধ্যে ২২ জন জাতীয় পরিষদের নারী ও সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হয়েছেন। এদের মধ্যে ১৪ জন পিএমএল-এন, পাঁচজন পিপিপি এবং ৩ জন জেইউআই-এফ থেকে নির্বাচিত হয়েছেন।

পিটিআই নেতা গওহর আলি খান সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে একে আইনের শাসনের বিজয় বলেছেন।

শুক্রবার রায়ের পরে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, “এই সিদ্ধান্ত ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এটি পাকিস্তানের গণতন্ত্রের জন্য একটি জয় এবং আমাদের দলের অধিকার পুনরুদ্ধার করেছে।”

সাংবিধানিক আইনজীবী রিদা হোসেনও আদালতের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। আদালত, ইসিপির কর্মক্ষমতার সমালোচনা করেছে এবং এর নিরপেক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “রায়ে ইসিপির আচরণের সমালোচনা করা হয়েছে, যা পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য ক্ষতিকর ছিল। নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ হওয়ার একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব রয়েছে। তবুও এটি একটি প্রধান রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। বেআইনিভাবে পিটিআইকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার অস্বীকার করেছে।”

ইসলামাবাদের নির্বাচনী আইন বিশেষজ্ঞ আইনজীবী আকরাম খুররমও ইসিপির সমালোচনা করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, নির্বাচনের সময় পিটিআইকে তার প্রতীক ব্যবহার করতে বাধা দেওয়ার নির্বাচন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত নিয়ে সব বিচারক সর্বসম্মতভাবে প্রশ্ন তোলেন।

তিনি আল জাজিরাকে বলেছেন, “বেঞ্চের প্রতিটি বিচারক এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, ইসিপি পিটিআইয়ের নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভুল ব্যাখ্যা করেছে। নির্বাচনী সংস্থাটিকে তার সিদ্ধান্তের ফলে উদ্ভূত রাজনৈতিক সংকট এবং আইনি জটিলতার দায় নিতে হবে।”

তবে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা তাদের আচরণে কোনও পক্ষপাতিত্ব অস্বীকার করেছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক বেনজির শাহ সংসদের গঠন ও সুনামের ওপর এই রায়ের প্রভাব তুলে ধরেন।

তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “যদি পিটিআই সংরক্ষিত আসন হারাত, তাহলে তা পার্লামেন্টের সংসদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করত। এখন পিটিআইকে সংরক্ষিত আসন বরাদ্দ দেওয়ায় দলটি সংসদের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হয়ে উঠেছে।

”এতে ক্ষমতাসীন জোটের মধ্যেও ফাটল ধরতে পারে। বিশেষ করে তৃতীয় বৃহত্তম দল পিপিপি মুসলিম লীগের নেতৃত্বাধীন জোট থেকে বেরিয়ে পিটিআই-য়ের সঙ্গে নতুন জোট গঠনে প্রলুব্ধ হতে পারে। তাই সবার মনোযোগ এখন পিপিপির ওপর।”

বেনজির শাহ আরও বলেন, “যদিও সরকার ও তার মিত্ররা এখনও পার্লামেন্টে স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রেখেছে, আমাদের দেখতে হবে পিপিপি কী করে। তারা পিএমএলএন-এর জোট ত্যাগ করে পিটিআইয়ের সঙ্গে সরকার গঠনের কথা বিবেচনা করতে পারে।

“৮ ফেব্রুয়ারির ভোটের পর পিপিপি পিটিআইয়ের সঙ্গে সরকার গঠনের জন্য রাজি ছিল।”

লাহোরের রাজনৈতিক ভাষ্যকার মজিদ নিজামি এই রায়কে পিটিআই-এর জন্য ‘স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস এবং আশার আলো’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। দলটি ২০২২ সালের এপ্রিলে সংসদীয় অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই একের পর এক রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে।

নিজামী উল্লেখ করেন, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগত ভারসাম্য উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন নাও হতে পারে, তবে এই রায় আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করবে।

তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “পার্লামেন্টে জোট সরকারের আর দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে না। এর মানে, কোনও সাংবিধানিক সংশোধনী এবং আইন পিটিআই-এর সমর্থন ছাড়া সহজে পাস করা যাবে না।”

ইমরান খানের হুঁশিয়ারি

পিটিআই প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খান সংরক্ষিত আসনের মামলায় সুপ্রিম কোর্টের শুক্রবারের রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। যারা তার দলকে নারী ও সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত আসন থেকে বঞ্চিত করতে চেয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে তিনি সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদের অধীনে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন।

সোশাল মিডিয়ায় তার দলের প্রকাশিত একটি বার্তায় পিটিআই প্রতিষ্ঠাতা বলেছেন, “আল্লাহ আল হক! আমি বারবার আমার এবং পিটিআই-এর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনের প্রদর্শিত কুসংস্কার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছি।

“আজকের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে পিটিআইয়ের বিরুদ্ধে ইসিপির পক্ষপাতিত্ব এবং বিদ্বেষ প্রমাণিত হওয়ায় আমাদের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। আমরা পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের লাখ লাখ ভোটার এবং সমর্থকদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য দায়ী সবার বিরুদ্ধে সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদের অধীনে ফৌজদারি মামলার দাবি জানাই।”

ইমরান খান প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিকান্দার সুলতান রাজা ও ইসিপি সদস্যদের অবিলম্বে পদত্যাগের দাবিও জানান।

এছাড়া ইমরান খান প্রধান বিচারপতি কাজী ফয়েজ ঈসাকেও পিটিআই এবং তার বিরুদ্ধে মামলার শুনানিকারী কোনও বেঞ্চের অংশ না হওয়ার জন্য সতর্ক করেছেন।

ইমরান খান হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “আমি আবারও বলব যে, প্রধান বিচারপতি কাজী ফয়েজ ঈসাকে অবশ্যই আমার বা পিটিআইয়ের বিরুদ্ধে মামলার শুনানি থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে।”

অন্য বিরোধী দলগুলোও সুপ্রিম কোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিকান্দার সুলতান রাজার পদত্যাগ দাবি করেছে। এতে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি হতে পারে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত