ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের বিখ্যাত একটি মন্দিরের মিষ্টি লাড্ডু দেশজুড়ে তিক্ত রাজনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই বিতর্কের কেন্দ্রে বিশ্বের সব থেকে সম্পদশালী হিন্দু তীর্থগুলোর অন্যতম প্রদেশটির তিরুপতি জেলার তিরুমালায় অবস্থিত শ্রী ভেঙ্কটেশ্বর মন্দির।
সেই মন্দিরের দেবতাকে প্রসাদম বা ধর্মীয় নৈবেদ্য দেওয়ার জন্য ঘিয়ের তৈরি শ্রীভরি লাড্ডুতে পশুর চর্বি মেশানোর অভিযোগ উঠেছে। এতে ভারতজুড়ে বইছে রাজনৈতিক বিতর্কের ঝড়।
মন্দিরটির পক্ষ থেকে প্রতিদিন প্রায় ৩ লাখ লাড্ডু তৈরি করা হয়, যা প্রসাদ হিসাবে আগত ভক্ত ও দর্শনার্থীদের মধ্যে বিতরণ করে মন্দির কর্তৃপক্ষ। পোটু নামে মন্দিরের গোপন রান্নাঘরে তৈরি করা হয় এই প্রসাদ। ৩০০ বছর ধরে চলে আসছে এই প্রথা।
হিন্দুদের কাছে ভগবান বিষ্ণুর অবতার ভেঙ্কটেশ্বরের এই মন্দিরটি রাজা তোন্ডমান নির্মাণ করেছিলেন। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে এক লাখের বেশি ভক্ত এই মন্দিরে পুজো দিয়ে অর্থ কিংবা সোনাদানা দান করেন।
মন্দিরটিতে ভক্তদের কাছ থেকে প্রতিবছর অনুদান হিসাবে প্রায় এক টন সোনা জমা পড়ে। মন্দির প্রাঙ্গণে ভক্তদের মাঝে লাড্ডু, বড়া, আপ্পাম, মনোহরম ও জিলাপির মতো প্রসাদ বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে লাড্ডু হলো এই মন্দিরের সবচেয়ে প্রাচীন এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রসাদ।
সনাতন বিশ্বাস অনুযায়ী, ভেঙ্কটেশ্বর যখন পদ্মাবতীকে বিয়ে করছিলেন, তখন তার অর্থের টান পড়েছিল। তাই তিনি ধনসম্পদের দেবতা কুবেরের কাছে অর্থ ও সোনা প্রার্থনা করেছিলেন।
বিশ্বাস করা হয়, ভেঙ্কটেশ্বরের সেই ঋণ এখনো রয়ে গেছে। তাই ভক্তরা তাদের ঈশ্বরকে ওই দেনার সুদ পরিশোধে সাহায্য করার জন্য উদার হস্তে দান করে যাচ্ছেন।
যাইহোক, বিতর্কের শুরুটা হয়েছিল অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুর একটি চমকপ্রদ অভিযোগ দিয়ে। তার দল তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি) বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট সরকারের গুরুত্বপূর্ণ শরিক।
তার অভিযোগ, অন্ধ্র প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওয়াই এস জগন মোহন রেড্ডি এবং তার নেতৃত্বাধীন পূর্বতন যুবজন শ্রমিক রাইথু কংগ্রেস পার্টির (ওয়াইএসআরসিপি) সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন তিরুমালা মন্দিরে প্রসাদ হিসাবে যে লাড্ডু তৈরি ও বিতরণ করা হত, তাতে নাকি পশুর চর্বির মিশ্রণ থাকত।
নাইডুর দাবি, জগন মোহনের আমলে মন্দিরের লাড্ডু তৈরি করতে যে ঘি ব্যবহার করা হতো, তা বিশুদ্ধ ছিল না। তাতেই নাকি মেশানো থাকত পশুর চর্বি। তবে তিনি ক্ষমতায় আসার পর এখন মন্দিরের ঐতিহাসিক লাড্ডু আবারও খাঁটি ঘি দিয়েই তৈরি করা হচ্ছে।
চন্দ্রবাবু নাইডুর নেতৃত্বাধীন সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে গত ১৮ সেপ্টেম্বর অন্ধ্র প্রদেশের বিজয়ওয়াড়ায় এনডিএ শরিকদলগুলোর একটি বৈঠক হয়। সেই বৈঠকেই গুরুতর এই অভিযোগ করেন চন্দ্রবাবু নাইডু।
গুজরাটের ন্যাশনাল ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের পরীক্ষাগারের একটি রিপোর্টের বরাতে তিনি এই দাবি করেন। গত ১৭ই জুলাই ওই লাড্ডুর নমুনা সংগ্রহ করা হয় এবং ২৩শে জুলাই পরীক্ষা শেষ হয়।
বৃহস্পতিবার নাইডুর দল টিডিপির মুখপাত্র এভি রেড্ডি সেই রিপোর্ট প্রকাশ করেন। রিপোর্টে দেখা গেছে, প্রসাদের যে নমুনা পাঠানো হয়েছিল, তাতে গরু, শুয়োরের চর্বি এবং মাছের তেল রয়েছে।
মন্দিরটির পরিচালনা কমিটি তিরুমালা তিরুপতি দেবস্থানম (টিটিডি) এর নির্বাহী কর্মকর্তা শ্যামলা রাওও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, আগের সরকারের আমলে ঘি সরবরাহের দায়িত্ব পাওয়া একটি কোম্পানি এই ভেজাল ঘি দিয়ে আসছিল। পরীক্ষার পর কোম্পানিটিকে কালোতালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
তিরুপতিসহ ভারতের বহু মন্দিরের প্রসাদ সম্পূর্ণভাবে নিরামিষ হয়ে থাকে। আবার দক্ষিণ ভারতীয় ভক্তদের একটা বড় অংশ নিরামিষাশী। তাই তাদের আরাধ্য দেবতার যে প্রসাদ তারা খাচ্ছেন, তাতে পশুর চর্বির উপস্থিতির খবর তাদেরকে খুবই বিচলিত করেছে।
তবে ওয়াইএসআর কংগ্রেস পার্টির নেতৃত্ব এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন আখ্যা দিয়ে অস্বীকার করেছে। তাদের পালটা দাবি, রাজনৈতিক ফায়দা লুটতেই ভিত্তিহীন এই অভিযোগ করছেন চন্দ্রবাবু। এর মধ্য দিয়ে তিনি তাদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদের তাস খেলছেন। ওয়াইএসআরসিপি ভারতের বর্তমান প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন বিজেপি বিরোধী ইন্ডিয়া জোটের শরিক।
পুরো বিষয়টিকেই চন্দ্রবাবু নাইডুর চাল বলে অভিযোগ তুলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে চিঠিও দিয়েছেন জগন মোহন রেড্ডি।
এই অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকার মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুর কাছ থেকে প্রতিবেদন তলব করেছে। ইতোমধ্যে একটি সবিস্তার রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জে পি নড্ডা।
এদিকে ভারতজুড়ে রাজনৈতিক নেতারাও বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। ভোপালে হিন্দুত্ববাদী কর্মীরা জগন মোহন রেড্ডির কুশপুত্তলিকা পোড়ায় এবং তাকেই এই কাজের জন্য দায়ী করে।
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এক্স-এ পোস্ট করেছেন, বিষয়টির পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করা দরকার।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেপি নাড্ডা লাড্ডু নিয়ে রিপোর্ট চেয়েছেন এবং কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশিও বিস্তারিত তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।
আরও এক ধাপ এগিয়ে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বান্দি সঞ্জয় মন্দিরটির পরিচালনা কমিটি টিটিডি-তে অন্যান্য ধর্মের লোকদের নিয়োগের উপর নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানিয়েছেন।
মন্দিরটি নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে ওয়াইএসআরসিপি, যা তখন বিরোধী দলে ছিল, তেলেগু দেশম পার্টি (টিডিপি) সরকারকে আক্রমণ করেছিল এই বলে যে, দেবতার কোষাগার থেকে একটি ‘অমূল্য গোলাপি হীরা নিখোঁজ’ হয়েছে।
দাবিটি একটি রাজনৈতিক এবং ভোটের ইস্যুতে পরিণত হয়েছিল যখন মন্দিরের একজন প্রবীণ পুরোহিত বলেছিলেন যে, বিরোধীদের দাবি সঠিক। মন্দির ব্যবস্থাপনা পরিষদ ওই পুরোহিত এবং ওয়াইএসআরসিপির একজন নেতার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করে প্রতিক্রিয়া জানায়। তবে ২০১৯ সালের নির্বাচনে ওয়াইএসআরসিপি ক্ষমতায় আসার পর মামলাটি প্রত্যাহার করা হয় এবং গোলাপী হীরা বিতর্কেরও অবসান ঘটে।
২০১৯ এবং ২০২৪ সালের মধ্যেও মন্দিরটি প্রায়ই ভুল কারণে খবরে ছিল। ২০১৯ সালে একবার কেউ কেউ দাবি করেন যে, পাহাড়ে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেসময় ভুয়া খবর ছড়ানোর অভিযোগে তিনজনকে আটক করে পুলিশ।
একই বছর তিরুমালা পাহাড়ের মন্দিরের জন্য ইস্যু করা অন্ধ্র প্রদেশ রাজ্য সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের বাস টিকেটের পেছনে জেরুজালেমে তীর্থযাত্রার প্রচারের বিজ্ঞাপন প্রিন্ট করা হলে তীব্র বিতর্ক তৈরি হয়। ক্ষমতাসীন বিজেপির রাজ্য ইউনিটগুলোও তখন রাজ্য সরকারের যোগসাজশে হিন্দুদের অনুভূতিতে আঘাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলে।
২০২০ সালে টিটিডি কর্মকর্তারা একটি অভিযোগ পেয়েছিলেন যে, গুন্টুরের একজন গ্রাহক একটি বিদেশী ধর্ম বিশ্বাসের প্রচার সামগ্রী সহ টিটিডি বুলেটিন ‘সপ্তগিরি’ পেয়েছেন। এই ঘটনাগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই জগন মোহন রেড্ডির নিন্দুকেরা তাকে ‘হিন্দু-বিরোধী’ তকমা দেওয়ার জন্য ব্যবহার করেছিলেন। জগন মোহন রেড্ডি ধর্মবিশ্বাসে একজন খ্রিস্টান।
হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর সদস্যরা রেড্ডির বাড়ির বাইরে বিক্ষোভ করেছে, স্লোগান দিয়েছে। তারা তার বাড়ির গেট ও দেয়াল গেরুয়া রঙে রাঙিয়ে দিয়েছে, যে রঙের পোশাক হিন্দু পুরোহিতরা পরিধান করেন। এটি বিজেপি এবং অন্যান্য হিন্দু দলের পতাকারও রঙ।
বিষয়টি সোশ্যাল মিডিয়াতেও উত্তেজনা তৈরি করেছে। লাড্ডু, #TirupatiLaddu, #TirupatiLadduControversy এবং #TirupatiLadduRow-এর মতো হ্যাশট্যাগ সহ, এক্সে (আগের টুইটারে) কয়েকদিন ধরে ট্রেন্ডিং ছিল।
অনেকে একে হিন্দু বিশ্বাসকে আঘাত করার ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো রেড্ডির মাথায় মুসলিমদের টুপি লাগানো ছবি ছড়িয়ে দিয়েছে।
তবে এবার লাড্ডু বিতর্ক নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় শুরু হলেও সাধারণ ভক্তদের মনে তেমন কোনও প্রভাব পড়েনি বলেই মনে হচ্ছে। এখন শুভ ‘পুরত্তাসি’ তামিল মাস চলছে এবং ভক্তরা শ্রদ্ধেয় শ্রীবরি লাড্ডুকে নির্দ্বিধায় মহা প্রসাদম (মহান অর্ঘ) হিসাবে গ্রহণ করছেন। বিতর্ক শুরু হওয়ার পরেও তিরুমালায় লাড্ডু বিক্রি কমেনি।
ওয়াইএসআরসিপি, কংগ্রেস ও বামরা বলছে, ভেজাল ঘিয়ের ট্যাঙ্কারগুলো জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে জব্দ করা হয়েছিল এবং জুলাইয়ের শেষের দিকে পরীক্ষার ফলাফল বেরিয়ে এসেছে। তাহলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কেন বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছে?
তাদের অভিযোগ, নাইডু ক্ষমতা পাওয়ার পর গত ১০০ দিনে তেমন কিছু অর্জন করতে পারেননি এবং এখন তার ব্যর্থতাগুলো থেকে মনোযোগ সরাতেই ইস্যুটিকে ব্যবহার করছেন।
তাদের মতে, নাইডু বিষয়টিকে এখন সামনে এনেছেন যাতে টিডিপি ও বিজেপি একসঙ্গে জগন মোহন রেড্ডিকে লক্ষ্যবস্তু করতে পারে এবং তাদের পক্ষে হিন্দু অনুভূতিকে তাঁতিয়ে তুলতে পারে। মন্দিরটির ভক্তদের সমর্থন নিজেদের পক্ষে টানাই তাদের উদ্দেশ্য।
এই লক্ষ্যে সোমবার চন্দ্রবাবু নাইডুর দল পুরোহিতদের দিয়ে মন্দিরটি ‘শুদ্ধ’ করার জন্য মন্দির চত্বরে ‘মহা শান্তি হোমযজ্ঞ’ আয়োজন করিয়েছে। চার ঘণ্টা ধরে চলে এই শুদ্ধিকরণ যজ্ঞ।
এরপর পুরোহিতেরা দাবি করেছেন, এই হোমযজ্ঞের ফলে ভেজালের কুপ্রভাব দূর হবে। প্রসাদ হিসেবে লাড্ডুর পবিত্রতা পুনরুদ্ধার হবে এবং ভক্তদের মঙ্গল নিশ্চিত হবে।
মন্দির কমিটির নির্বাহী শ্যামলা রাও জানিয়েছেন, নতুন বিতর্কের পর লাড্ডুতে খাঁটি ঘি ব্যবহারের বিষয়ে আরও বেশি সতর্ক হয়েছে মন্দির কর্তৃপক্ষ। এর ফলে প্রসাদি লাড্ডুর স্বাদ আরও বেড়ে গেছে বলেও মনে করা হচ্ছে।
তথ্যসূত্র : দ্য হিন্দু, হিন্দুস্তান টাইমস, টাইমস অব ইন্ডিয়া, এনডিটিভি, আনন্দবাজার