বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে আকস্মিক বন্যার পর আলোচনায় আবার ভারত। কারণ এই অঞ্চলের নদীগুলোও ভারত হয়েই বাংলাদেশে ঢুকেছে।
ভারতের ত্রিপুরায় গোমতী নদীর ওপর ডম্বুর বাঁধে আটকে থাকা পানি ছেড়ে দেওয়ার জন্য এই বন্যা- এমন দাবি করে সোশাল মিডিয়ায় আলোচনার ঝড় বইলেও বিশেষজ্ঞরা অবশ্য ভিন্ন মত জানিয়েছে।
এই বন্যার মূল কারণ বাঁধের পানি ছেড়ে দেওয়া নয়, বিশেষজ্ঞরা তা বললেও পানি ছেড়ে দেওয়ার আগে ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি, তা জানিয়েছেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। ফলে ভারতের দিকে অভিযোগের আঙুল থাকছেই।
শুধু এবারই নয়, অভিন্ন নদীর পানি বিষয় পূর্ণাঙ্গ তথ্য ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ কখনও পায় না বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশনের কর্মকর্তারা।
এসব তথ্য পাওয়া নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। কেউ বলছেন, যৌথ নদী কমিশনের স্ট্যাটিউট অর্থাৎ দলিল অনুযায়ী এসব তথ্য পাওয়ার জন্য আলাদা কোনও চুক্তির দরকার নাই। এসব তথ্য আদান প্রদানের জন্যই যৌথ নদী কমিশন তো রয়েছেই।
তবে কারও মতে, এজন্য ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করতে হবে। আবার দ্বিপক্ষীয় চুক্তি না করলেও দুই পক্ষ ১৯৯৭ সালে প্রণীত জাতিসংঘ পানি প্রবাহ সনদে উভয় পক্ষ অনুসমর্থন করলেও জটিলতা কেটে যায়, এমন মতও রয়েছে।
প্লাবন সমভূমির দেশ নদী মাতৃক বাংলাদেশে ৫৭টি নদী এসেছে অন্য দেশ থেকে। এই আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ৫৪টিই এসেছে ভারত দিয়ে। বাকি তিনটি মিয়ানমার হয়ে এসেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার তিন মাস পেরোতেই ১৯৭২ সালে মার্চ মাসে গঠন করা হয় যৌথ নদী কমিশন। বন্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণের বিস্তারিত প্রকল্প প্রণয়ন ও প্রধান প্রধান নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ প্রকল্পের উপর সমীক্ষা পরিচালন, উভয় দেশের জনগণের পারস্পরিক সুবিধা অর্জনের লক্ষ্যে এই অঞ্চলের পানি সম্পদের ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার নিশ্চিত করাই এই কমিশনের লক্ষ্য।
তবে এই অভিযোগ দীর্ঘদিনের, উজানের দেশ ভারতের সঙ্গে ভাটির দেশ বাংলাদেশের অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহারে যে ধরনের যৌক্তিক ও ন্যায্য ব্যবস্থাপনা থাকার কথা, তা নেই।
ভারতের কাছে কতটুকু তথ্য পাওয়া যায়
আবহাওয়া বিষয়ক তথ্য আদান-প্রদান করে থাকে বাংলাদেশ ও ভারত। এই কাজটি একটি সফটঅয়্যারে তথ্য হালনাগাদ করার মাধ্যমে হয়ে থাকে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মজিদুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সেখানে (সফটঅয়্যার) তারাও তথ্য দেয়, আমরাও তথ্য দিই। এভাবেই আমাদের যোগাযোগ হয়ে থাকে।”
তবে যৌথ নদী কমিশন ভারত থেকে পর্যাপ্ত তথ্য পায় না। ৫৪টি অভিন্ন নদী হলেও বাংলাদেশ মাত্র ৮টি নদীর ১৪ স্টেশনের তথ্য পায়, তাও কোনও চুক্তি ছাড়াই।
বাকি নদীগুলোর তথ্য পেতে বাংলাদেশ বিভিন্ন সময়ে অনুরোধ করেছে জানিয়ে যৌথ নদী কমিশনের সদস্য ড. মোহাম্মাদ আবুল হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, তাতে ভারতের সাড়া পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশন ব্যর্থ হলেও সিন্ধু অববাহিকা ঘিরে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের পানি বণ্টন কিন্তু চলছে, যদিও দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক বৈরিতা সব সময়ের।
‘ইন্দাস ওয়াটার ট্রিটি’ বা সিন্ধু জল চুক্তি নামে পরিচিত সেই চুক্তি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। দুই দেশের মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছিল বিশ্ব ব্যাংক।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি রয়েছে। ১৯৮৩ সালে একটি স্বল্প মেয়াদী চুক্তির মাধ্যমে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তবে পূর্ণাঙ্গ চুক্তি ঝুলে আছে দীর্ঘদিন ধরে।
২০১৮ সালে থেকে যৌথ নদী কমিশন থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে চারটি সমঝোতা স্মারক হয়েছে তিনটি দেশের সঙ্গে। চীন ও নেপালের সঙ্গে ১টি করে। ভারতের সঙ্গে দুটি।
যৌথ নদী কমিশনের সদস্য আবুল হোসেন বলেন, “আমরা গোমতী নদীর উজানে ওমরপুর স্টেশনের তথ্য ভারত থেকে পেয়ে থাকি। দিনে দুই বার করে। ডম্বুর আরও ১২৩ কিলোমিটার উজানে। সেই তথ্য দেওয়ার এগ্রিমেন্ট নাই।
“ভারতের ৫৪টি অভিন্ন নদীর যেখানে ড্যাম আছে, সেখানে কখন গেট খুলবে কখন বন্ধ করবে, সেই তথ্য আমরা চেয়েছি। কিন্তু তারা দেয়নি। পরে দেবে বলে জানানো হয়েছে।”
তবে গত বছরে অক্টোবরে তিস্তার ক্ষেত্রে ভারতের পক্ষ থেকে আগাম তথ্য দেওয়া হয়েছিল বলে জানান তিনি।
গত বছরের আগস্টে একটি বৈঠকেও ভারতের সঙ্গে এক বৈঠকে তথ্য চাওয়া হয়েছিল জানিয়ে আবুল হোসেন বলেন, “এমাসেই ঢাকায় আরেকটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। তবে দেশের এমন পরিস্থিতি থাকার কারণে তাদেরকে আমরা ডাকি নাই। হয়তবা আগামী মাসেই ঢাকায় একটি বৈঠক হবে।”
মে মাসে ভারতের পুনেতে আবহাওয়াবিদদের একটি বৈঠক থেকে আগস্টে বন্যার বিষয়ে আগাম সতর্ক করা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “মে মাসের আগাম ফোরকাস্ট দিয়ে আসলে ফ্ল্যাশ ফ্লাড ঠেকানো সম্ভব না।”
তবে ডম্বুর বাঁধের পানি ছেড়ে দেওয়ায় কারণে বাংলাদেশে এখনকার বন্যার যে কথা বলা হচ্ছে, তাতে আপত্তি জানিয়ে আবুল হোসেন বলেন, “তার আগে ভাটিতে অনেক বৃষ্টি হয়েছে। সেটা আমাদের অনেক বেশি এফেক্ট করেছে।”
তবে ডম্বুরে বাঁধের পানি ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে ভারত থেকে কোনও তথ্য বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়া হয়নি বলে যৌথ নদী কমিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী শহীদুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন।
আরও তথ্য পেতে কী করা দরকার
ভারতের কাছ থেকে তথ্য পেতে যৌথ নদী কমিশনকে কার্যকর করার ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী ম ইনামুল হক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, যৌথ নদী কমিশনকে দুর্বল করে রাখা হয়েছে।
একই কথা বলেন নদী ও ব-দ্বীপ গবেষণা কেন্দ্রের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান ও নদী বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ এজাজ।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “যৌথ নদী কমিশন গঠন করেছিল ১৯৭২ এ। তাদের আসলে নতজানু নীতি ছিল। নদীর পানি তাদের প্রায়োরিটিতে ছিল না। এতদিন তারা ঘুমের মধ্যে ছিল। কাদের নির্দেশনায় তাদেরকে অকেজো করে রাখা হয়েছে, সে বিষয়ে খোঁজ নিতে হবে।
“বিশেষজ্ঞ ও সিভিল সোসাইটি নিয়ে একটি কমিটি গঠন করতে হবে। যাতে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা যায়। আমরা মনে করি, এই সরকারের অবশ্যই ইউএন ওয়াটারকোর্সেস কনভেনশন ১৯৯৭ অনুস্বাক্ষর করবে। দ্বিপাক্ষিক চুক্তি যদি না করে যাতে ইউএন চুক্তি দিয়ে সহযোগিতা পেতে পারি।”
ভারতের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে নালিশ জানানোর যে কথা সোশাল মিডিয়ায় আসছে, সেগুলোকে চটকদার বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
ইনামুল হক বলেন, “(জাতিসংঘের) জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে এসব কথা তোলাই যায়। লাভ হয় না। বাহবা পাওয়া যায়, তালি পাওয়া যায়, এর বেশি কিছু না।”
জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ সনদে অনুসমর্থন করার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “যেটা আমরা বারবার বলছি … অনেকেই আন্দোলন করেছে… বাংলাদেশকে রেটিফাই করার জন্য, সম্মতি দেওয়ার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ এখনও দেয়নি, ভারতও দেয়নি।
“সে তো একটা নতজানু নীতিতে ছিল ভারতের সঙ্গে। যে তেজ আমরা এখন বর্তমান সরকারের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি, তাতে আমি বলব, এই তেজের শক্তিতে আগে এই কনভেনশনটাকে রেটিফাই করা দরকার। তখন যৌক্তিকভাবে, আইনগতভাবে জাতিসংঘ বা সারাবিশ্বের কাছে পৌঁছাতে আমাদের সুবিধা হবে।”
তথ্য সংকট কাটাতে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের এগ্রিমেন্ট করতে হবে। চুক্তি করতে হবে। রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের, সেখানে আন্তর্জাতিক কিছু নাই।”
ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে এসব বিষয়ে সমঝোতায় এলেও সদিচ্ছার অভাব দেখছেন রিভারাইন পিপলের মহাসচিব, নদী গবেষক শেখ রোকন।
যে দলিলের ভিত্তিতে যৌথ নদী কমিশন প্রতিষ্ঠা হয়েছে, তার প্রসঙ্গ টেনে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, অভিন্ন নদী ব্যবস্থার সুবিধা সর্বাধিক কার্যকরভাবে যৌথ প্রচেষ্টায় নিশ্চিত করার জন্য অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্য পেতে ভারতের সঙ্গে নতুন কোনও চুক্তির প্রয়োজন দেখছেন না শেখ রোকন।
তিনি বলেন, “তবে ভারতের যে ড্যাম রয়েছে, সে ড্যামের গেট খোলার বিষয়ে কোনও চুক্তি নাই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, সেগুলো প্রতিবেশী দেশকে জানাতে হবে।”
তথ্য সংকট কাটাতে কী করবেন- জানতে চাইলে যৌথ নদী কমিশনের সদস্য আবুল হোসেন বলেন, “ভবিষ্যতে আমরা আলাপ করব। সব গেট খোলার আগাম তথ্য যাতে আমাদের দেওয়া হয়।
“চুক্তি করতে পারি। চুক্তি ছাড়াও তারা তথ্য দেয়। ৮ নদীর ১৪ স্টেশনের যে খবর, তা তারা চুক্তি ছাড়াই দিচ্ছে।”
এর আগেও তথ্য চেয়ে পাওয়া যায়নি। সেক্ষেত্রে নদী কমিশন কী করতে পারে- প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমাদের টায়ারে যদি এগ্রি না হয়, তা হলে উপদেষ্টা পর্যায়ে বৈঠক হবে। আমাদের কমিটি টেকনিক্যাল কমিটি। এই কমিটির মিটিং এ রাজি না হলে উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠকে আলোচনা করব।”