Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

উত্তর প্রদেশে চমকের নেপথ্যে কি প্রিয়াঙ্কা

নিজে প্রার্থী না হলেও ভোটের মাঠ চষে বেড়িয়েছেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী।
নিজে প্রার্থী না হলেও ভোটের মাঠ চষে বেড়িয়েছেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী।
[publishpress_authors_box]

দিল্লিতে যাবে কে, তা ঠিক করে দেয় উত্তর প্রদেশ- এমন কথা ভারতে প্রচলিত। বড় এই রাজ্যটিকে নিজেদের দুর্গ বানিয়ে ফেলেছিল বিজেপি, কিন্তু সেই দুর্গে এবার নেমেছে ধস।

অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে এবার বড় চমক দেখা গেছে এই উত্তর প্রদেশেই। ‘ইউপি কি লেড়কা’ রাহুল গান্ধী ও অখিলেশ যাদব কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপিকে। তাদের ইন্ডিয়া জোট বিজেপির প্রায় অর্ধেক আসনে ভাগ বসিয়েছে।

উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস জোটের এই সাফল্যের নেপথ্য নায়ক মনে করা হচ্ছে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে। ইন্দিরা গান্ধীর নাতনি ভোটের লড়াইয়ে না নেমেও ভাসছেন প্রসংশায়।

কংগ্রেস ও জোটের নেতারাসহ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, প্রিয়াঙ্কার নীরব কিন্তু কঠোর শ্রম ও প্রচেষ্টাই উত্তর প্রদেশে ভোটের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।

ভারতের স্বাধীনতার পর থেকেই উত্তর প্রদেশের দুটি আসন তথা আমেথি ও রায়বেরেলি গান্ধী পরিবারের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৫২ সাল থেকে শুরু করে মাত্র দুই থেকে তিনবার ছাড়া বাকি সব নির্বাচনেই গান্ধী পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত প্রার্থীরাই এই দুই আসনে জয়ী হয়ে আসছিলেন।

কিন্তু ২০১৯ সালের নির্বাচনে আমেথিতে ছন্দপতন ঘটায় বিজেপি। রাহুল গান্ধীকে হারিয়ে দেন অভিনয় জগত থেকে রাজনীতির মঞ্চে আসা বিজেপির প্রার্থী স্মৃতি ইরানি।

২০০৪ সাল থেকে রাহুল গান্ধী আমেথি থেকেই নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। তার আগে আমেথিতে এমপি ছিলেন সঞ্জয় গান্ধী, রাজীব গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী। গান্ধী পরিবারের এমন শক্ত দুর্গেই আঘাত হানেন স্মৃতি ইরানি।

গতবার হারের স্বাদ নিয়ে এবার আমেথি থেকে গান্ধী পরিবারের কেউ ভোটে দাঁড়াননি। মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির সঙ্গে লড়তে কংগ্রেস প্রার্থী করে কিশোরী লাল শর্মাকে।

প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল আসনটিতে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে প্রার্থী করা হতে পারে। কিন্তু প্রিয়াঙ্কা রাজনীতিতে আসার সিদ্ধান্ত এখনও না নেওয়ায় বিকল্প প্রার্থী বেছে নিতে হয়।

রাহুল প্রার্থী হন রায়বেরেলি থেকে। তার মা সোনিয়া গান্ধী ২০০৪ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত টানা পাঁচবার আসনটি থেকে এমপি হন। এবার আসনটি ছেলেকে ছেড়ে দেন সোনিয়া।

দুটি আসনেই কংগ্রেসের এই রাজনৈতিক কৌশল বেশ ফলপ্রসূ হয়েছে। রায়বেরেলিতে চার লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে বিজেপি প্রার্থীকে হারিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীর চেয়েও বেশি ব্যবধানে জিতে রেকর্ড গড়েছেন রাহুল গান্ধী। আমেথিতেও হেরে গেছেন বিজেপির তারকা মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি।

ভোটে না দাঁড়ালেও আসন দুটিতে প্রচারে সক্রিয় ছিলেন প্রিয়াঙ্কা। বলা হচ্ছে, কংগ্রেসের তারকা প্রচারক প্রিয়াঙ্কার ব্যাপক প্রচারাভিযানই আসন দুটিতে এই ফলাফল এনে দেয়।

আমেথিতে কিশোরী লাল শার্মার জয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর প্রিয়াঙ্কা এক্সে এক পোস্টে বলেন, “কিশোরী ভাইয়া, আমার কোনও সন্দেহ ছিল না, আমি নিশ্চিত ছিলাম যে আপনি জিতবেন। আপনাকে এবং আমেথির আমার প্রিয় ভাই ও বোনদের আন্তরিক অভিনন্দন!”

সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন প্রিয়াঙ্কা গান্ধী।

প্রিয়াঙ্কার গণমুখী প্রচারণা

নির্বাচনী প্রচারে দলের কর্মীদের উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে প্রিয়াঙ্কা বলেছিলেন, “আমাদেরকে সমস্ত শক্তি দিয়ে একসঙ্গে লড়াই করতে হবে। আমাদের প্রত্যেককে সামনের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”

তিনি নির্বাচনে জয় নিশ্চিত করতে দল ও জোটের সদস্যদের অক্লান্ত ও নির্ভয়ে কাজ করার আহ্বান জানান এবং নিজেই তাদের পথ দেখান।

আমেথি ও রায়বেরেলিতে প্রিয়াঙ্কার প্রচারে তার অনন্য ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি, সাহসিকতা এবং উপস্থিত বুদ্ধিমত্তাদেখতে পেয়েছেন বিশ্লেষকরা।

জনসাধারণের সঙ্গে তার আন্তরিক সংযোগও আসে আলোচনায়। আমেথির নারীদের উদ্দেশে প্রিয়াঙ্কা বলেন, “আমি আপনাদের বোন, আপনাদের মেয়ে। আমি আপনাদের সমস্যা বুঝতে এবং সমাধান খুঁজতে এসেছি।”

প্রিয়াঙ্কার প্রচারাভিযান ভোটারদের, বিশেষ করে নারীদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার এবং তাদের উদ্বেগগুলোর সমাধানের দিকে মনোনিবেশ করেছিল। তিনি গ্রামগুলো চষে বেড়ান। ছোট ছোট সভা করেন এবং ঘরে ঘরে যান।

রায়বেরেলির একটি গ্রামে লোকনৃত্য পরিবেশনকারী অল্পবয়সী মেয়েদের সঙ্গে তিনি নিজেও নেচেছেন। এর মধ্য দিয়ে তার স্বতঃস্ফূর্ততা আরও স্পষ্ট হয়।

প্রিয়াঙ্কা ভারতীয় রাজনীতির পুরনো ধাঁচের বড় মঞ্চ ও সমাবেশভিত্তিক প্রচার থেকে সরে এসে ভিন্নভাবে প্রচার চালান। বড় সভা-সমাবেশ না করে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ২০টিরও বেশি ছোট ছোট সভা করেন প্রিয়াঙ্কা। বড় সভা-সমাবেশের চেয়ে ব্যক্তিগত, সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করেন তিনি েভাটারদের সঙ্গে। এতে তিনি সহজেই সাধারণ মানুেষর মন জয় করেন। যার ফল অনূদিত হয় কংগ্রেসের জয়ে।

সার্বিকভাবে কংগ্রেস এবং সমাজবাদী পার্টি এবার প্রিয়াঙ্কার মতোই তৃণমূলের মানুষের কাছে পৌঁছানোর ওপর বেশি জোর দেয়। অন্যদিকে, বিজেপি শুধু বড় বড় সভা-সমাবেশ করেছে। এসব সভা-সমাবেশে অংশ নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। তবে ছোট শহর বা গ্রামের দিকে তাদের নজর ছিল কম।

ভোটের প্রচারে একসঙ্গে নেমেছিলেন রাহুল গান্ধী ও অখিলেশ যাদব।

সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে সম্পর্কের বরফও গলান প্রিয়াঙ্কা

২০১৭ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের পরে কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টিকে আরেকটি নির্বাচনের জন্য একত্র হওয়া প্রায় অসম্ভব বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু উভয় দল শেষ পর্যন্ত আসন ভাগাভাগির বিষয়ে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।

দুই দলের মধ্যে সম্পর্কের এই অচলায়ন ভাঙতে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকেই কৃতিত্ব দেওয়া হয়। তার উষ্ণ আচরণেই কংগ্রেস ও সমাজবাদী পার্টির সম্পর্কের বরফ গলে।

গত ফেব্রুয়ারিতে আসন ভাগাভাগির বিষয়টি ঘোষণা করার সময় কংগ্রেসের উত্তর প্রদেশ রাজ্য প্রধান অবিনাশ পান্ডে ঐকমত্যে পৌঁছাতে প্রিয়াঙ্কার ভূমিকার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন।

প্রিয়াঙ্কা গান্ধীই দুই দলের মধ্যে মতপার্থক্য দূর করতে অখিলেশ যাদবকে নিজে যেচে ফোন করেছিলেন। তার এই বিনয়ী আচরণে দুদলের সম্পর্ক জোড়া লাগার পাশাপাশি কংগ্রেস কিছু গুরুত্বপূর্ণ আসনেও সমাজবাদী পার্টির কাছ থেকে বড় ছাড় পায়।

২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস মাত্র একটি আসনে জয় পেয়েছিল। যদিও সেসময় প্রিয়াঙ্কা গান্ধী দলীয় প্রচারে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও কংগ্রেস শুধুমাত্র রায়বেরেলি আসনে জয় পায়, যার প্রতিনিধিত্ব করেন সোনিয়া গান্ধী। আমেথির কংগ্রেস ঘাঁটিতে বিজেপির স্মৃতি ইরানির হাতে রাহুল গান্ধীর পরাজয় রাজ্যটিতে কংগ্রেসকে সর্বনিম্নে নামিয়ে আনে।

কিন্তু ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল এখন এক ভিন্ন গল্প বলছে। কংগ্রেস এবার উত্তর প্রদেশে ৬টি আসনে জিতেছে। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট জিতেছে মোট ৪৩টি আসনে। বাকি ৩৭টি আসনে সমাজবাদী পার্টির প্রার্থীরা দাঁড়িয়েছিল।

সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব।

সমাজবাদী পার্টির কৌশল

উত্তর ভারতে সার্বিকভাবে ইন্ডিয়া জোটের সাফল্যের পেছনে সমাজাবাদী পার্টির একটি কৌশলও গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এবার আসন বণ্টনের ক্ষেত্রে দলটি আগের চেয়ে ভিন্ন পথে হেঁটেছে। এবার প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যাদবদের চেয়ে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি) প্রার্থীদের বেশি গুরুত্ব দেয় সমাজবাদী পার্টি।

এবার মাত্র পাঁচজন যাদব প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয় সমাজবাদী পার্টি। তারা সবাই দলটির প্রধান অখিলেশ যাদবের পরিবারের সদস্য। অন্যদিকে ২৭টি আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে ওবিসিদের। উচ্চ বর্ণের প্রার্থীদেরও দেওয়া হয়েছে মাত্র ১১টি আসন। মুসলমান প্রার্থীরা পায় চারটি আসন। এছাড়া সংরক্ষিত আসনে ১৫ জন দলিত প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয় দলটি।

গত লোকসভা নির্বাচনে বিএসপি ও আরএলডির সঙ্গে জোট করেছিল সমাজবাদী পার্টি। সেবার ৮০টি আসনের মধ্যে ৩৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দলটি, বাকি আসনগুলো জোট শরিকদের ছেড়ে দেয়। গত নির্বাচনে ১০ আসনে যাদব প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সব মিলিয়ে নির্বাচনে মাত্র পাঁচটি আসনে জয় পেয়েছিল সমাজবাদী পার্টি। বিএসপি পেয়েছিল ১০টি আসন।

সমাজবাদী পার্টির জ্যেষ্ঠ এক নেতা বলেন, “যাদব ও মুসলমানদের সমর্থন নিয়ে নিশ্চিত ছিল আমাদের দল। তবে আমরা এই দুই সম্প্রদায়ের বাইরের অন্যান্য পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়ের মানুষ ও দলিতদের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছিলাম। আমাদের সেই কৌশল কাজে লেগেছে।”

অন্যদিকে বিজেপি উত্তর প্রদেশে এবার ৭৫টি আসনে নিজেদের প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়। বাকি পাঁচটি আসন পায় এনডিএ জোটের তিন মিত্র। ৭৫ আসনের মধ্যে উচ্চ বর্ণের প্রার্থীদেরই ৩৪টি আসন দেয় বিজেপি। অনগ্রসর সম্প্রদায়ের প্রার্থীদের দেওয়া হয় মাত্র ২৫টি আসন। তাদের মধ্যে একজন যাদবও রয়েছেন। বাকি ১৬টি ছিল সংরক্ষিত আসন।

এতে বিজেপি এবার ৩৩টি আসনে জয় পায়। অথচ গত নির্বাচনে বিজেপি জয় পেয়েছিল ৬২ আসনে। কংগ্রেস ও সমাজাবাদী পার্টির কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে বিজেপি। শুধু তাই নয়, কেন্দ্রে সরকার গড়তে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় আসনও হারায় দলটি।

কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোটের এই সাফল্যের পাশাপাশি সমাজবাদী পার্টি এবার ৩৭টি আসন পেয়ে ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আর কংগ্রেসও ৯৯ আসন পেয়ে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

তথ্যসূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত