ভারতে না গিয়ে চীনে গেলেন মালদ্বীপের নতুন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু। তার সফরের মধ্যেই ভারত-মালদ্বীপের মধ্যে উত্তেজনা শুরু হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে মুইজ্জু ক্ষমতায় আসার আগেই তার বক্তব্য ঘিরে অসন্তোষ চলছিল দুই দেশের মধ্যে।
মুইজ্জু চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত। ক্ষমতায় এসেই তিনি দিল্লিকে তার দেশ থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে বলেন। মালদ্বীপে ভারতের ৭৭ সেনার একটি কন্টিনজেন্ট আছে। তারা দেশটির বিমানবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে।
গত নভেম্বরে মুইজ্জু জানান, ভারত মালদ্বীপ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারে রাজি হয়েছে। তবে দেশটি এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও ঘোষণা দেয়নি।
বিষয়টি নিয়ে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে উভয় দেশের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। এতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা।
নতুন করে উত্তেজনা যা নিয়ে
নতুন উত্তেজনার কারণ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে মালদ্বীপের তিন মন্ত্রীর অবমাননাকর মন্তব্য।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নরেন্দ্র মোদি ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাক্ষাদ্বীপে যান। তিনি সফরের কিছু ছবি-ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করে ভারতীয়দের মালদ্বীপের বদলে সেখানে ভ্রমণের আহ্বান জানান।
এরপরই মালদ্বীপের তিন মন্ত্রী মোদিকে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করেন। তারা মোদিকে ‘সন্ত্রাসী’ ও ‘ক্লাউন’ বলে সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট দেন।
এর জেরে গত সোমবার মালদ্বীপের হাইকমিশনারকে তলব করে গভীর উদ্বেগ জানায় নয়াদিল্লি।
মালদ্বীপ সরকার অবশ্য তার আগেই ওই তিন মন্ত্রীকে বরখাস্ত করে। মরিয়ম শিউনা, মালশা শরিফ ও মাহজুম মাজিদ নামের ওই তিন মন্ত্রীকে গত রবিবার বরখাস্ত করা হয়। তারা দেশটির যুব ক্ষমতায়ন, তথ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বরত ছিলেন।
দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্রও এই ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে বলেছেন, তাদের ওই মন্তব্য একান্তই ব্যক্তিগত। দেশটির সরকারের ওই মতামতের প্রতিনিধিত্ব করে না।
কিন্তু এতেও প্রশমিত হয়নি ভারতের রাগ। মালদ্বীপের হাইকমিশনারকে তলব করে ক্ষোভ জানায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
লাক্ষাদ্বীপে মোদির এই সফরকে মালদ্বীপ থেকে পর্যটকদের দূরে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হিসেবে দেখছে মালদ্বীপের নেতৃত্ব। এতে তাদের বিচলিত হওয়ার কারণ হলো, দেশটির অর্থনীতি প্রধানত পর্যটনের ওপরই নির্ভরশীল।
ভারতের লাক্ষাদ্বীপও মালদ্বীপের মতোই একটি সাগরঘেরা দ্বীপপুঞ্জ। এর অবস্থান দেশটির কেরালা উপকূলের অদূরে মালদ্বীপের কাছেই। লাক্ষাদ্বীপেও রয়েছে মালদ্বীপের মতোই সাদা বালির সৈকত। এটিকেও ঘিরে রেখেছে সমুদ্রের স্ফটিকস্বচ্ছ নীল জলরাশি। তবে ভারত দ্বীপটিকে এখনও পর্যটনের উপযোগী করে গড়ে তোলেনি।
ভারতে সোশাল মিডিয়ায় মালদ্বীপকে বয়কটের ডাক
ভারতে সোশাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের মধ্যেও উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। ফেসবুক ও এক্সে অনেকে মালদ্বীপকে বয়কটের ডাক দিয়েছেন। মালদ্বীপে ভ্রমণ না করারও আহ্বান জানানো হয়েছে।
সোমবার ভারতের বৃহত্তম ভ্রমণ প্ল্যাটফর্মগুলোর একটি ইজি মাই ট্রিপ মালদ্বীপে ফ্লাইট বুকিং স্থগিত করেছে। অনেক ভারতীয় নাগরিকও তাদের পূর্বনির্ধারিত মালদ্বীপ সফর বাতিল করার কথা সোশাল মিডিয়ায় জানায়।
বলিউড অভিনেতা ও ক্রীড়া তারকাসহ কয়েকজন ভারতীয় সেলিব্রিটিও মালদ্বীপের কর্মকর্তাদের মন্তব্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
জনপ্রিয় ভারতীয় অভিনেতা অক্ষয় কুমার এক্সে এক পোস্টে বলেছেন, “মালদ্বীপ সরকারের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি ভারতীয়দের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ও বর্ণবাদী মন্তব্য করেছে। এটা দেখে আমি খুবই অবাক হয়েছি। তারা এমন একটি দেশের বিরুদ্ধে কটু মন্তব্য করেছে যারা তাদের দেশে সর্বাধিক সংখ্যক পর্যটক পাঠায়।”
রয়টার্সের প্রতিবেদন মতে, ভারত ও রাশিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি পর্যটক মালদ্বীপে যায়। গত বছর দেশ দুটি থেকে ২ লাখ ৯ হাজার পর্যটক দেশটিতে ভ্রমণে যায়। ২০২৪ সালে ২০ লাখ পর্যটককে সেবা দেওয়ার টার্গেট নিয়েছে মালদ্বীপ।
মালদ্বীপ সরকারের বক্তব্য
মালদ্বীপের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলছে, “আমাদের সরকার বিশ্বাস করে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক এবং দায়িত্বশীল পদ্ধতিতেই ব্যবহার করা উচিৎ। এমন উপায়ে মত প্রকাশ করতে হবে, যা ঘৃণা ও নেতিবাচকতা ছড়াবে না এবং মালদ্বীপ ও তার আন্তর্জাতিক অংশীদারদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে বাধাগ্রস্ত করবে না।”
মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ তিন মন্ত্রীর মন্তব্যকে “ভারতের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য ভাষা” বলে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন।
তিনি এক্সে এক পোস্টে বলেন, “ভারত সবসময়ই মালদ্বীপের ভাল বন্ধু ছিল। দুই দেশের মধ্যে বহু পুরনো সেই বন্ধুত্বকে নষ্ট করার জন্যই এই ধরনের কটু মন্তব্য করা হয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে আমাদের এই ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করতে দেওয়া উচিৎ হবে না।”
দেশটির আরেক সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদও সোশাল মিডিয়ায় এক পোস্টে তিন মন্ত্রীর ভাষাকে “ভয়াবহ” বলে অভিহিত করেছেন।
মালদ্বীপের একজন সিনিয়র প্রশাসনিক কর্মকর্তার বরাতে এএফপি জানায়, দেশটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু এই ঘটনায় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এই ঘটনায় ভারতের প্রতিক্রিয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ প্রতি বছর ভারত থেকে বহু পর্যটক মালদ্বীপে যায়। আর মালদ্বীপের অর্থনীতির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল।
ভারতের আগে চীন সফরে মুইজ্জু
মুইজ্জু ৮ থেকে ১২ জানুয়ারী পর্যন্ত পাঁচদিনের চীন সফরে আছেন। এই প্রথম মালদ্বীপের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান ভারতের আগে চীনে গেলেন। তিনি ক্ষমতায় এসে সর্বপ্রথম তুরস্কে যান।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে মুইজ্জু মালদ্বীপের আগের সরকারের ভারতকে প্রাধান্য দেওয়ার নীতি থেকে সরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি মালদ্বীপে ভারতের সামরিক উপস্থিতির অবসান ঘটানোরও প্রতিশ্রুতি দেন।
তবে ক্ষমতায় আসার পর মুইজ্জু তার ভারতবিরোধী বক্তব্য কমিয়ে দিয়ে বলেছেন, মালদ্বীপে ভারতীয় সেনার বদলে চীনা সেনাদের এনে তিনি আঞ্চলিক ভারসাম্য নষ্ট করতে চান না।
কিন্তু ভারতের আগে চীন সফরেই গেলেন তিনি। এই ঘটনাকে মালদ্বীপের আগের সরকারগুলোর ভারতঘেষা নীতি থেকে তার সরে আসার স্পষ্ট ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
দ্য গার্ডিয়ান বলছে, “এই সফর দিল্লির জন্য একটি ধাক্কা হিসেবে আসতে পারে। কারণ, ভারত মহাসাগর অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমাতে দিল্লি মালদ্বীপের কৌশলগত অবস্থানের সুবিধা পেতে চায়।”
বিবিসি বলছে, মুইজ্জুর রাজনৈতিক জোট চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পক্ষে। মালদ্বীপের অবকাঠামো ও উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ ও অনুদান হিসেবে চীন কয়েক মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। আরও বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। তবে ভারতও মালদ্বীপকে প্রায় ২০০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা দিয়েছে।
গত ডিসেম্বরে মুইজ্জু সরকার জানায়, তারা ভারতের সঙ্গে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বাতিল করতে যাচ্ছে। ওই চুক্তিতে ভারতকে মালদ্বীপের আঞ্চলিক জলসীমায় সমুদ্রতলের মানচিত্র তৈরিতে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
মুইজ্জু সরকারের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে জানান, ২০২৪ সালের জুনে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। এরপর আর চুক্তিটি নবায়ন করা হবে না।
ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ অংশে নজর রাখতে মালদ্বীপকে প্রয়োজন দিল্লির। চীনও ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় রয়েছে। ভারত মহাসাগরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা নিয়ে তাদের এই প্রতিযোগিতার প্রভাব পুরো দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতেই পড়ছে।