ভারতের নৌবহরে একটি শক্তিশালী সাবমেরিন যুক্ত হয়েছে গত মাসের শেষের দিকে। সাবমেরিনটি পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বহন ও তা দিয়ে হামলা চালাতেও সক্ষম।
এর মধ্য দিয়ে ভারতের পারমাণবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়েছে বলে দাবি করেছে দেশটির সরকার। মনে করা হচ্ছে, চীন ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক প্রতিরক্ষা বাড়াতেই ভারত সাবমেরিনটি তৈরি করেছে।
ভারতের পারমাণবিক শক্তিচালিত নতুন সাবমেরনটির নাম আইএনএস আরিঘাট, এর অর্থ ‘শত্রুর ধ্বংসকারী’।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং গত ২৯ আগস্ট বিশাখাপত্তম নৌঘাঁটিতে আরিঘাটের সংযুক্তির অনুষ্ঠানে বলেন, সাবমেরিনটি এই অঞ্চলে “কৌশলগত ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে।”
বিশাখাপত্তম নৌ ঘাঁটিটি বঙ্গোপসাগর উপকূলে ভারতের ইস্টার্ন নেভাল কমান্ডের সদর দপ্তর।
তবে সমর শক্তিতে ভারত এখনও চীনের তুলনায় পিছিয়ে। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনার মধ্যে চীনের সেনাবাহিনী তাদের নৌবহরের পাশাপাশি স্থল ও আকাশপথের সক্ষমতাও বাড়াচ্ছে।
তবে সেই ভারসাম্য বর্তমানে চীনের দিকে ঝুঁকে আছে। চীনের নৌবাহিনী সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম নৌবাহিনী, যার মধ্যে রয়েছে ছয়টি অপারেশনাল জিন-শ্রেণীর পারমাণবিক ব্যালিস্টিক সাবমেরিন। অন্যদিকে, ভারতের আছে মাত্র দুটি সাবমেরিন— আইএনএস আরিঘাট এবং একই শ্রেণীর পূর্বসূরি আইএনএস অরিহন্ত।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য ক্ষেপণাস্ত্রের উন্নয়ন ও মোতায়েন বাড়াতে কাজ করে অলাভজনক সংস্থা মিসাইল ডিফেন্স অ্যাডভোকেসি অ্যালায়েন্স। সংস্থাটি জানিয়েছে, চীনা সাবমেরিনগুলো কমপক্ষে ৮ হাজার কিলোমিটার দূরে আঘাত হানতে সক্ষম এক ডজন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বহন করতে পারে এবং একাধিক পারমাণবিক ওয়ারহেড বহন করার ক্ষমতা রাখে।
অন্যদিকে, ওপেন-সোর্স গোয়েন্দা সংস্থা জেনসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ৩৬৬ ফুট লম্বা ও ৬ হাজার টন ওজনের ভারতের দুই সাবমেরিন আরিঘাট ও অরিহন্ত কে-১৫ সাগরিকা ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বহন করে। এই ক্ষেপণাস্ত্র চারটি উল্লম্ব লঞ্চ টিউব থেকে উৎক্ষেপণ করা যায়। কিন্তু কে-১৫ এর পাল্লা মাত্র ৭৫০ কিলোমিটার বলে ধারণা করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক কমান্ডের জয়েন্ট ইন্টেলিজেন্স সেন্টারের সাবেক অপারেশন পরিচালক ও সামরিক বিশ্লেষক কার্ল শুস্টার।
তিনি বলেন, “আইএনএস অরিহন্ত-শ্রেণির সাবমেরিন উত্তর বঙ্গোপসাগর থেকে পূর্ব চীন-ভারত সীমান্ত বরাবর চীনা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম নয়। উত্তর বঙ্গোপসাগর সাবমেরিন চলাচলের জন্যও বিপজ্জনকভাবে অগভীর।”
ভারত ও চীনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই সীমান্ত সংঘর্ষ চলে আসছে। সর্বশেষ ২০২২ সালে এক সংঘর্ষে ভারতের ২০ জন আর চীনের চারজন সৈন্য নিহত হয়।
সেকেন্ড-স্ট্রাইক সক্ষমতার বিকাশ করছে ভারত
আরিঘাটের সক্ষমতা সম্পর্কে ভারত সরকার মুখ বন্ধ করে রেখেছে। শুধু বলেছে, “এই সাবমেরিনে দেশীয়ভাবে গৃহীত প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এটিকে তার পূর্বসূরির তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি উন্নত করেছে, যা আট বছর আগে চালু করা হয়েছিল।”
এমনকি ২৯শে আগস্ট চালু হওয়ার পর থেকে আরিঘাটের ছবিও প্রকাশ করেনি ভারত।
নৌ-বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত স্পষ্টতই একটি উপসাগরীয় পারমাণবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরির পথে রয়েছে। এটি চীনের মতো বড় নাও হলেও বেইজিংকে ভারতের বিরুদ্ধে বৈরী পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত রাখতে যথেষ্ট পাল্টা আঘাত হানতে সক্ষমতা সম্পন্ন হবে।
ভারত দীর্ঘ পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রও তৈরি করছে। বিশ্লেষকদের মতে, সেসব ক্ষেপণাস্ত্র ৬ হাজার কিলোমিটার দূর পর্যন্ত আঘাত হানতে সক্ষম হবে। তার মানে চীনের যে কোনও জায়গায় হামলা চালাতে পারবে ভারত।
ফেডারেশন অফ আমেরিকান সায়েন্টিস্টের পারমাণবিক তথ্য প্রকল্পের সহযোগী পরিচালক ম্যাট কোর্দা বলেন, “ভারতের সমুদ্র-ভিত্তিক পারমাণবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আপেক্ষিকভাবে এখনো শৈশবেই রয়ে গেছে। তবে দেশটির স্পষ্টতই একটি অত্যাধুনিক নৌ পারমাণবিক বাহিনী তৈরি করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা রয়েছে, যার মূলে থাকবে পারমাণবিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম সাবমেরিন।”
সিএনএনকে ইমেইলে কোর্দা বলেন, “এই সাবমেরিনগুলো একটি সুরক্ষিত সেকেন্ড-স্ট্রাইক পারমাণবিক শক্তি স্থাপনের জন্য ভারতের বৃহত্তর প্রচেষ্টার মূল অংশ। যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান এবং চীনা লক্ষ্যবস্তুগুলো ভারতের হামলার আওতায় আসবে। বিশেষ করে ভারতের তৃতীয় এবং চতুর্থ সাবমেরিনে আরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র টিউব থাকবে এবং দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র যুক্ত হবে।”
ইতিহাস যদি কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করে তবে ভারতের পরবর্তী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সাবমেরিন আসতে আরও বেশ কয়েক বছর লাগবে। আরিঘাট প্রায় সাত বছর আগে চালু করা হয়েছিল এবং সেটি নৌবিহানিতে যোগ দেয় সম্প্রতি। সে হিসেবে পরবর্তী সাবমেরিনটি নৌবহর যোগ দিতে দিতে ২০৩০ পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।
এসএসবিএন-এর প্রতিপত্তি
সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির সহকারী সিনিয়র ফেলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সাবেক সাবমেরিন কমান্ডার শুগার্ট বলেন, “তবুও দ্বিতীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বহনকারী সাবমেরিন ভারতের নৌ ও সামরিক মনোবল বাড়াবে।”
শুগার্ট বলেন, “এটি ভারতের একটি পরাশক্তি হয়ে উঠার লক্ষণ।”
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্য— যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স সকলেরই পারমাণবিক ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম সাবমেরিন রয়েছে।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ সদস্যের মধ্যে সবচেয়ে কম সাবমেরিন রয়েছে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের। তাদের মাত্র চারটি করে সাবমেরিন রয়েছে। শুগার্ট বলেন, সমুদ্র প্রতিরক্ষার জন্য এই সংখ্যা সর্বনিম্ন।
পারমাণবিক সাবমেরিন জটিল মেশিন। এসব মেশিনের কোনোও কিছু ভেঙে গেলে তা মেরামত করতে এক মাসেরও বেশি সময় লাগে। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের কাজেও এক মাস বা তার বেশি সময় লাগতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর প্যাসিফিক ফ্লিটের তথ্য অনুযায়ী, তাদের নৌবাহিনীর ওহিও-শ্রেণীর পারমাণবিক সাবমেরিনগুলো সমুদ্রে গড়ে ৭৭ দিন করে থাকে এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ৩৫ দিন বন্দরে ব্যয় করে।
যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর নথি অনুযায়ী, পারমাণবিক চুল্লিতে জ্বালানি নবায়ন এবং সাবমেরিনের সংস্কার করতে ২৭ মাস পর্যন্ত সময় লাগে।
শুগার্ট বলেন, “একাধিক সাবমেরিন থাকার মাধ্যমে ভারত তাদের মধ্যে একটি সাবমেরিনকে সবসময় সমুদ্রে মোতায়েন রাখতে সক্ষম হবে।
“তবে সব সময় একটি সাবমেরিন সমুদ্রে মোতায়েন রাখতে হলে সম্ভবত বর্তমান দুটির চেয়ে বেশি সাবমেরিন লাগবে।”
সতর্ক চীন
চালু হওয়ার আগে আরিঘাট চীনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। দেশটির রাষ্ট্র-চালিত সংবাদপত্র গ্লোবাল টাইমস নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চীনা বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, ভারতের “শক্তি প্রদর্শনের জন্য এটি ব্যবহার করা উচিৎ নয়।”
গ্লোবাল টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা উচিৎ, শক্তি প্রদর্শন বা পারমাণবিক হুমকির জন্য নয়।”
অনেক বিশ্লেষক বলেছেন, নয়াদিল্লি কেবল বেইজিংয়ের বর্ধিত চাপের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। চীনের এখন জাহাজের সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের বৃহত্তম নৌবাহিনী রয়েছে।
গ্লোবালডেটা অ্যানালিটিক্স কোম্পানির বিশ্লেষক কান্দলিকার ভেঙ্কটেশ বলেন, “চীনের বিশাল নৌবাহিনী গড়ে তোলা এবং টাইপ ০৯৪ সাবমেরিন (জিন ক্লাস) দিয়ে সম্পূর্ণ সশস্ত্র পারমাণবিক প্রতিরোধ টহল নিয়মিত মোতায়েন করাকে ভারত সহ এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর জন্য হুমকি মনে করা হয়।”
তিনি বলেন, “অরিহন্ত-শ্রেণির সাবমেরিন মোতায়েন ভারতকে চীনের সঙ্গে কিছুটা সমতা এনে দিবে।” তিনি জানান, ভারত সাবমেরিন তৈরিতে আরও বিনিয়োগ করছে। আগামী দশ বছরে সাবমেরিন তৈরিতে ভারত প্রায় ৩১.৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।
ভেঙ্কটেশ বলেন, আরও বড় সাবমেরিন এবং দীর্ঘ-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কাজ চলছে। ১২ হাজার কিলোমিটার পাল্লার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রও ভারতের হাতে চলে আসবে।
আরেক আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী
মুম্বাইয়ের অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো অভিজিৎ সিং-এর মতে, কেবল চীনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা বাড়াতেই ভারত তার সাবমেরিন সক্ষমতা বাড়াচ্ছে না।
হিন্দুস্তান টাইমসে একটি মতামত সম্পাদকীয়তে সিং লিখেছেন, “ভারতের সেকেন্ড-স্ট্রাইক সক্ষমতা সম্প্রসারণের আসল প্রেরণা হল, ভারত মহাসাগরে পাকিস্তানি ও চীনা নৌবাহিনীর উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।”
তিনি জানান, পাকিস্তান তার বহরের আধুনিকায়নের জন্য চীনের তৈরি ৮টি টাইপ ০৩৯বি অ্যাটাক সাবমেরিন পেতে যাচ্ছে।
সিং লিখেছেন, “পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সমুদ্র-শক্তির পার্থক্য ক্রমাগতভাবে কমিয়ে আনছে।”
ভারত ও পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরেই কাশ্মীর নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত রয়েছে। কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের মধ্যে তিনটি যুদ্ধও হয়েছে। চীন পাকিস্তানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সমর্থক এবং দেশটিতে বড় বিনিয়োগকারী।
পারমাণবিক বিস্তারের ভয়
ফেডারেশন অফ আমেরিকান সায়েন্টিস্টস এর বিশেষজ্ঞ কোর্দা বলেছেন, সাবমেরিনগুলো উদ্বেগের কারণ নয়, তবে তারা যে একাধিক পারমাণবিক ওয়ারহেডযুক্ত মিসাইল বহন করে সেগুলো উদ্বেগজনক।
মাল্টিপল ইন্ডিপেন্ডেন্টলি টার্গেটেবল রিএন্ট্রি ভেহিকেল (এমআইআরভি) নামে পরিচিত এই প্রযুক্তি ভূমি-ভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্রেও থাকে। এই পারমাণবিক প্রযুক্তি অস্থিতিশীলতার কারণ হতে পারে।
কোর্দা বলেন, “ভারত, পাকিস্তান ও চীন সকলেই এমন ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে, যা একাধিক ওয়ারহেড বহন করতে পারে।”
ভারত এপ্রিলে মহা ধুমধাম করে ঘোষণা করেছিল যে, তারা এমআইআরভি ক্লাবে যোগ দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন। অভ্যন্তরীণভাবে উন্নত অগ্নি-ভি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সফল পরীক্ষা চালানোর পর ভারত ওই ঘোষণা দেয়।
পাকিস্তানও তার কাছে এমআইআরভি প্রযুক্তি আছে বলে দাবি করেছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাকিস্তানের দাবি সত্য নয়।
প্রতিপক্ষদের এই ধরনের দাবিগুলোকে সত্য বলে ধরে নিতে হবে, আর নয়তো সংঘর্ষের সময় অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়তে হতে পারে।
কোর্দা বলেন, “এই সিস্টেমগুলো আদর্শ প্রথম-স্ট্রাইক অস্ত্র, কিন্তু তারা পাল্টা প্রথম স্ট্রাইকে লক্ষ্যবস্তু হওয়া প্রথম অস্ত্রও হতে পারে।
“ফলে, এই অঞ্চলজুড়ে এসব অস্ত্র মোতায়েন সম্মিলিত অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে তীব্রতর করবে। সবকটি দেশই ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা এবং প্রচলিত স্ট্রাইক বিকল্প তৈরি করতে চায়, যা তাদের মোকাবেলা করতে পারে।”
তথ্যসূত্র : সিএনএন