Beta
শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদন

শেখ হাসিনার জন্য দিল্লি চাপ দিয়ে যাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রকে

নরেন্দ্র মোদীর আমন্ত্রণে ভারত সফর করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার ছিল সফরের দ্বিতীয় দিন।
নরেন্দ্র মোদীর আমন্ত্রণে গত জুন মাসে ভারত সফর করেন শেখ হাসিনা। তার দুই মাস না যেতেই তার সরকারের পতন ঘটে। ফাইল ছবি
[publishpress_authors_box]

শেখ হাসিনার পতন ঘটলে বাংলাদেশও আফগানিস্তানের মতো হবে, যুক্তরাষ্ট্রকে এমন ধারণা দিচ্ছিল ভারত। সেজন্য শেখ হাসিনার প্রতি নমনীয় থাকতে নয়া দিল্লি থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছিল ওয়াশিংটনকে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ১০ দিন পর বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের এই দিকটি উন্মোচিত হয়েছে।

উভয় দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী এই সংবাদপত্র। সেখানে হাসিনার শাসনকালে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কের অবনতির দিকটিও তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এক বছর আগে থেকে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ নিয়ে কূটনৈতিক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তদবির চালিয়ে যাচ্ছিল ভারত।

৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনার শক্ত শাসনে ব্যাপক সমালোচনা ছিল নির্বাচন, সরকারবিরোধীদের নির্যাতন করা নিয়ে। এই সময়ে তার সরকারের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী সমালোচনাও দেখতে হয়েছে ওয়াশিংটনকে।

জো বাইডেন প্রশাসন ২০২২ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপর গত বছরের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি গ্রহণ করে। যেখানে বলা হয়, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা হবে যারা, তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসবে।

এরপর নয়া দিল্লি থেকে কূটনৈতিক পর্যায়ে নানা বৈঠকে শেখ হাসিনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে তদবির চলতে থাকে বলে ওয়াশিংটন পোস্ট জানতে পেরেছে।

নয়া দিল্লির কূটনীতিকরা বলছিলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গলা নামানো দরকার। কারণ বাংলাদেশে নির্বাচনে বিরোধীরা সরকার গঠন করলে দেশটি হয়ে উঠবে ইসলামী চরপন্থিদের চারণভূমি, আর তা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠবে।

“তোমরা গণতন্ত্রের কথা বলতে পার, কিন্তু আমাদের জন্য এটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ, অস্তিত্বের প্রশ্নও,” ভারত সরকারের একজন উপদেষ্টা ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন।

তিনি নাম প্রকাশ না করে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এনিয়ে আমাদের অনেক আলোচনা হয়েছে। আমরা বলেছি, এটাই আমাদের বড় উদ্বেগের বিষয়। কারণ কৌশলগত জায়গায় কোনও রকম মতৈক্য না থাকলে কাউকে কৌশলগত অংশীদার করা যায় না।”

দৃশ্যত এরপর বাইডেন প্রশাসনও বাংলাদেশ প্রশ্নে নমনীয় হয়। নতুন করে কোনও নিষেধাজ্ঞাও আর দেয়নি।

তবে শুধু ভারতের চাপে এমনটা হয়েছে, তা স্বীকার করতে রাজি নন ওয়াশিংটনের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, এটা একটা কৌশলগত সিদ্ধান্ত।

ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দ্বিপক্ষীয় এমন আলোচনাগুলো এতদিন প্রকাশ্যে আসেনি। আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর এখন ওয়াশিংটন ও দিল্লির কর্মকর্তারা মুখোমুখি। পরস্পরকে এই বলে দুষছে যে বাংলাদেশ নিয়ে তাদের অবস্থানে কোথাও ভুল ছিল কি না?

যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেছেন, “বাংলাদেশ নিয়ে সব সময়ই একটি ভারসাম্যমূলক নীতি বজায় রেখে চলা হয়েছে। কারণ সেখানে অনেকগুলো বিষয় জড়িত, আর তা বেশ জটিল।”

গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশে যখন সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল, তার আগে নিজেদের অবস্থান ঠিক করা নিয়ে বিভেদ দেখা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনে।

শ্রম অধিকার
ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন পিটার হাস।

ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসসহ কয়েকজন শেখ হাসিনা সরকারের ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। বিশেষ করে যখন জো বাইডেন তার পররাষ্ট্র নীতির কেন্দ্রে গণতন্ত্রে রাখার কথা বলেছিলেন।

অবসরে যাওয়া পিটার হাস এবিষয়ে ওয়াশিংটনের কাছে মুখ খলতে চাননি। বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনের সময় নানাভাবে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের হুমকির মুখে পড়তে হয়েছিল হাসকে।

হোয়াইট হাউজের কিছু কর্মকর্তা বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের উত্তেজনা প্রশমিত করতে চাইছিল। যখন কি না ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে গত নভেম্বরে নয়া িদল্লিতে বৈঠকেও বাংলাদেশ নিয়ে তাদের কথা বলছিলেন।

গত শরতে ভারতের নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা অজিত দোভালও ওয়াশিংটন সফরে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করে যান বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র ওয়াশিংটন পোস্টকে জানিয়েছে।

তবে শেখ হাসিনা সরকারের আকস্মিক পতন ভারতের জন্য যেমন অপ্রত্যাশিত, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রকেও ফেলে দিয়েছে ঝামেলায়।

কারণ চীনকে ঠেকানোর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এক গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী ভারত, আবার ভারতকে আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায়ও দেখা যাচ্ছে।

গত জানুয়ারিতে একচেটিয়া নির্বাচনে শেখ হাসিনার জয়ী হলে তাকে সমর্থন দিয়েছিল ভারত সরকার। তারপর বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব জোরাল হয়ে ওঠে। একই অবস্থা দেখা দিয়েছিল মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায়ও।

ভারত বারবারই পশ্চিমা দেশগুলোকে বলে আসছিল, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ গেলে বিএনপি আসতে পারে ক্ষমতায়। তাতে বাংলাদেশের অবস্থা হবে আফগানিস্তানের মতো।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে এভাবে উল্লাস প্রকাশ করে।

দীর্ঘদিনের মিত্র শেখ হাসিনার আকস্মিক বিদায়ের পেছনে ওয়াশিংটনের হাত রয়েছে বলে ভারতের কূটনীতিক মহল ও সংবাদমাধ্যমে আলোচনা চলছে। কূটনীতিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এক স্বৈর শাসককে একদিন ধরে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার সমালোচনাও করছে।

সাবেক একজন কর্মকর্তা ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশের মাঠের চিত্র নয়া দিল্লি বুঝতে চায়নি।

“বাংলাদেশ থেকে যেই আসছিল, বলছিল যে সেখানে ভারতবিরোধী মনোভাব অনেক জোরাল হয়ে উঠেছে। কিন্তু তারপরও প্রশাসনের ওপর তার (শেখ হাসিনা) পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে ভেবে আমরা আশ্বস্ত হয়ে থেকেছি। আমরা ভেবেছি, তার সরকারকে ঝামেলায় ফেলার চেষ্টাগুলো ব্যর্থ হয়েছে, তিনি আবার সব সামলে নেবেন। কিন্তু আসল কথা হলো, বাংলাদেশ বারুদশালা হয়েই ছিল, অপেক্ষা ছিল শুধু দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালানো।”

যুক্তরাষ্ট্রের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জন ড্যানিলোউইকজ বলেন, “ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন বরাবরই দিল্লির আঞ্চলিক অভিলাষ থেকে নিজেকে দূরে রেখেছে। বাংলাদেশের ঘটনা তার জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ।

“কিন্তু ঝুঁকিটা থেকে যায় ইরানের ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের মতো। কেউ যদি স্বৈরাচারের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে, সেই স্বৈরাচারের যখন পতন ঘটে, তখন তার আর কিছু থাকে না।”

ঢাকায় এক সময় কাজ করে যাওয়া এই কূটনীতিক বলেন, “এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়কে স্বীকার করতে হবে যে বাংলাদেশ নিয়ে তারা ভুল অবস্থানে ছিল। কারণ দেশটির মানুষের চাওয়াটি তারা বুঝতে পারেনি।”

বাংলাদেশে পট পরিবর্তনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শেখ হাসিনা সরকারের পতনে ওয়াশিংটনের জড়িত থাকার অভিযোগও ‘হাস্যকর’ বলে উড়িয়ে দিচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও ড. ইউনূসকে অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা দিয়েছেন।

আর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের উপপ্রধান মুখপাত্র বেদান্ত প্যাটেল বুধবারও বলেছেন, বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে ভারতের সঙ্গে ওয়াশিংটন যোগাযোগ রেখে চলছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত