Beta
শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

মোদী টিকে গেলেও ‘ম্যাজিক’ উধাও

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
[publishpress_authors_box]

জনবহুল ভারতকে সামনে নিতে চাই শক্ত নেতৃত্ব- এই আওয়াজ তুলে ২০১৪ সালে প্রথম সরকার গঠন করেন নরেন্দ্র মোদী। সেই শক্তি যে নিজের আছে, তা জানান দিতে দেখিয়েছিলেন ৫৬ ইঞ্চি ‍বুকের ছাতি।

সেবার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই সরকার গড়েছিল বিজেপি। পাঁচ বছর পর ২০১৯ সালের নির্বাচনেও ‘মোদী ম্যাজিকে’ ভর করে আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ফেলে হিন্দত্ববাদী দলটি।

২০২৪ সালে এসে সেই ‘মোদী ম্যাজিকে’ ভোট উৎরানোর পরিকল্পনা সাজিয়েছিল বিজেপি; স্লোগান ঠিক করেছিল- ‘আবকি বার ৪০০ পার’। অর্থাৎ লক্ষ্য এবার লোকসভার ৫৪৫ আসনের মধ্যে ৪০০টি পাওয়া।

কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না। ঘোষিত ফল দেখাচ্ছে, বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ৪০০ আসনের ধারে-কাছেও যাচ্ছে না। আর বিজেপির আসন সংখ্যা কমে এমন অবস্থায় দাঁড়াচ্ছে, তাতে কারও সমর্থন ছাড়া তাদের একার পক্ষে সরকার গড়াও সম্ভবপর হবে না।

ভারতে অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে ছয় সপ্তাহে সাত দফায় ভোটগ্রহণের পর মঙ্গলবার একযোগে ফল ঘোষণা শুরু হয়েছে।

ভারতের নির্বাচন কমিশনের মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত ঘোষিত ফলে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি ২৪০টির মতো আসনে জিততে যাচ্ছে। কংগ্রেস জিততে যাচ্ছে ১০০টির মতো আসনে।

ভারতে ভোটের ফলে যে যেখানে। সূত্র : ভারতের নির্বাচন কমিশন

সরকার গঠন করতে ২৭২টি আসনে জয় প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে বিজেপি এককভাবে না হলেও তাদের এনডিএ জোট সেই ‘ম্যাজিক নম্বর’ যে পেরিয়ে যাবে, তাতে কোনও সংশয় দেখা যাচ্ছে না।

ফলে টানা তৃতীয়বারের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে মোদীর বড় কোনও বাধা থাকছে না। তবে তার দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে তাকে সব সময়ই অন্যের মুখাপেক্ষী থাকতে হবে।

আর ভোটের ফল দেখিয়ে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তো বলেই দিয়েছেন, “মোদী তোমার ভোট অন্য কোথাও যায়নি। তোমার ম্যাজিক শেষ।”

অথচ গত দুটি লোকসভা নির্বাচনের চিত্র ছিল ভিন্ন।

২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি একাই ২৮২ আসনে জিতেছিল, এনডিএ জোট পেয়েছিল ৩৩৬ আসন।

সেবার কংগ্রেস স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বাজে ফল করে পেয়েছিল মাত্র ৪৪টি আসন। তখন কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স (ইউপিএ) পায় ৫৯ আসন।

সেই নির্বাচনে বিজেপির স্লোগান ছিল ‘আচ্ছে দিন আনে ওয়ালে হ্যায়’ (ভালো দিন আসছে)। নরেন্দ্র মোদী তার নির্বাচনী প্রচারে এই বক্তব্য দিয়ে জনগণের কাছে পৌঁছেছিলেন।

স্লোগানটি তখন ভারতের সীমানা পেরিয়ে বাইরেও জনপ্রিয় হয়েছিল। ২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে একটি অনুষ্ঠানে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনকেও ওই স্লোগান দিতে দেখা গিয়েছিল।

এরপর আসে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন। বিজেপি তখন দেশবাসীর সামনে নিয়ে আসে ‘মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায় (মোদী থাকলেই সম্ভব)’ স্লোগান।

পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য ‘এজেন্ডা ২০১৯’ নামে এক উন্নয়ন মডেল ঘোষণা করেন মোদী। তিনি দেশের বিভিন্ন প্রান্তের নারী ও তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে একাধিক স্কিম চালুরও ঘোষণা দেন।

এসব প্রতিশ্রুতির ফলও পায় বিজেপি। দলটির আসনে বেড়ে ৩০০ ছাড়ায়। এককভাবে বিজেপি পায় ৩০৩টি আসন, এনডিএ জোট জেতে ৩৫৩ আসনে।

পাঁচ বছর আগে মোট ভোটের ৪৫ শতাংশই পেয়েছিল এনডিএ। বিরোধী দল কংগ্রেস পায় মাত্র ৫২টি আসন। আর ইউপিএ জোট পায় ৯১ আসন।

আগের সাফল্যে ভর করে এবার লক্ষ্য আরও বড় করে বিজেপি। স্লোগান তোলে- ‘আবকি বার ৪০০ পার’। কিন্তু ভোটের ফল বলছে, বিজেপি এককভাবে কেন, জোট নিয়েও ৪০০ আসনের মাইলফলক ছুঁতে পারেনি, যা ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে ছুঁয়েছিল কংগ্রেস।

ফলে ভারতে এক দশক পর আবার এক দলের আধিপত্যের ইতি ঘটতে যাচ্ছে।

একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়া নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন বিজেপির রাজস্থানের প্রধান সি পি যোশি। এই ফলাফল প্রত্যাশিত ছিল না বলে তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

যোশি বলেন, “নির্বাচনে যে ফল প্রত্যাশা করেছিলাম, তা হয়নি। চূড়ান্ত ফলের অপেক্ষায় আছি। তবে এটা স্পষ্ট যে, এনডিএ জোট আবারও সরকার গঠন করতে যাচ্ছে।”

বিজেপিবিরোধীরা ভোটের আগে ইন্ডিয়া জোট গড়লেও তাদের বাঁধন মজবুত নয়।

লোকসভা নির্বাচনে পরপর তিন বার বারাণসিতে জয় পেয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। তিনি তার আসন ধরে রাখলেও তার দল ভালো করতে পারেনি। যে উত্তর প্রদেশে (ইউপি) বিজেপি ২০১৯ সালে ৬২ আসন পেয়েছিল, এবার সেখানে ৩৬টি আসন পেতে পারে দলটি।

প্রদেশটিতে এগিয়ে আছে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টাল ইনক্লুসিভ অ্যালায়েন্সের (ইন্ডিয়া) অন্যতম শরিক দল অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি (এসপি)।

ভোটের ফলে দেখা যাচ্ছে, বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ২৯১টি আসন পেতে যাচ্ছে, বিপরীতে ইন্ডিয়া জোট পেতে যাচ্ছে ২৩২টি আসন।

বিজেপিকে তাই সরকার গড়তে জোটসঙ্গীদের উপর ভরসা করতে হবে। তার জোটের মধ্যে অন্ধ্র প্রদেশের চন্দ্রবাবু নাইড়ু নেতৃত্বাধীন তেলেগু দেশম পার্টি ১৬ আসন পেতে যাচ্ছে। আর বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের জনতা দল (ইউনাইটেড) পাচ্ছে ১২ আসন।

এছাড়া মহারাষ্ট্রের শিবসেনার সিন্ধে গোষ্ঠী, বিহারের লোক জনশক্তি পার্টি ও উত্তর প্রদেশের রাষ্ট্রীয় লোক দলের উপরও ভরসা করছে বিজেপি।

তবে বিজেপির নজর মূলত নাইড়ু ও নীতিশ কুমারের ওপর। এই দুই নেতা এখন বিজেপির জোটে থাকলেও তাদের একাধিক বার জোট ত্যাগের ও প্রত্যাবর্তনের ইতিহাস রয়েছে।

মোদী মঙ্গলবার দুপুরে অন্ধ্র প্রদেশে (বিধানসভা নির্বাচন) চন্দ্রবাবু নাইড়ুকে সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। অর্থাৎ জোটসঙ্গীকে খুশি রাখতে চাইছেন তিনি।

তবে বিহারের নীতিশ কুমারকে নিয়ে মোদীকে চিন্তায় থাকতে হবে বেশি। হিন্দুস্তান টাইমস বলছে, এবার কার্ড নীতিশ কুমারের হাতে। গত কয়েক বছর ধরে বিহার ও কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছেন তিনি।

২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে নীতিশের সঙ্গে বিজেপির দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তখন জনতা দল (ইউনাইটেড) বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। ২০১৫ সালের বিধানসভা ভোটের আগে মুখ্যমন্ত্রীর আসন ফিরে পান নীতিশ। তখন আরজেডি (রাষ্ট্রীয় জনতা দল), কংগ্রেস ও সিপিআই তাকে সমর্থন করে। এতে আস্থা ভোটে উৎরে যান নীতিশ।

নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকে নীতিশ কুমার।

কিন্তু দুই বছর পরেই বিজেপির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ফের মুখ্যমন্ত্রী হন নীতিশ। ২০২০ সালে বিজেপির সঙ্গে আবার ঝামেলা হয় তার। ২০২২ সালে আরজেডির সঙ্গে হাত মিলিয়ে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, বিজেপির সঙ্গে আর হাত মেলাবেন না। কিন্তু এর এক বছরের মাথায় ফের বিজেপির সঙ্গেই দেখা যায় তাকে।

ফলে নীতীশ কুমার বিজেপির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, এরই মধ্যে নীতিশ কুমারকে উপ-প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব দিয়েছে ইন্ডিয়া জোট। এনডিটিভি বলছে, মঙ্গলবার দুপুরে নীতিশকে দিল্লিতে বিভিন্ন পার্টির কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করতে দেখা গেছে।

জোটসঙ্গীদের মুখাপেক্ষী হওয়ার কারণে দৃশ্যত মোদীকে ভবিষ্যতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হবে। যে সমস্যায় গত দুই দফায় পড়তে হয়নি তাকে। শরিকদের ভরসায় এর আগে মোদী কখনও রাজ্য ও কেন্দ্র চালাননি। ফলে নতুন বাস্তবতায় মোদী ও তার সরকারের অনেক কিছু নির্ভর করবে শরিকদের উপর।

আর অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী মোদীকে যে শান্তিতে থাকতে দেবেন না, তা মমতা বলেই রেখেছেন।

“মোদী একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে অত্যাচার করত। যত খুশি বিল পাস করিয়ে নিয়েছে। রাজ্যের প্রধানদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। এজেন্সির রাজনীতি করেছে। এবার ওরা একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এ বার কি আমরা ছেড়ে দেব? আশা করি, ইন্ডিয়ার সদস্যরাও ছেড়ে দেবে না,” বলেছেন তিনি।

কোন দল কোন জোটে

ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সে (এনডিএ) আছে– ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), অল ঝাড়খন্ড স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (এজেএসইউপি), অল ইন্ডিয়া এন. আর. কংগ্রেস (এআইএনআরসি), আপনা দল (সোনিলাল), অসম গণ পরিষদ, হিল স্টেট পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি, ইন্ডিজেনাস পিপলস ফ্রন্ট অব ত্রিপুরা, জনতা দল (সেক্যুলার), জনতা দল (ইউনাইটেড), লোক জনশক্তি পার্টি (রাম বিলাস), মহারাষ্ট্রবাদী গোমানতাক পার্টি, নাগা পিপলস ফ্রন্ট, ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি, ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক প্রোগ্রেসিভ পার্টি, রাষ্ট্রীয় লোক জনশক্তি পার্টি, শিব সেনা, সিক্কিম ক্রান্তিকারি মোর্চা, তেলেগু দেশম পার্টি, টিপরা মোথা পার্টি, ইউনাইটেড পিপলস পার্টি লিবারেল, আম্মা মাক্কাল মুন্নেত্রা কাড়গম, তামিঝাগা মাক্কাল মুন্নেত্রা কাড়গম, ভারত ধর্ম জন সেনা, গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট, হরিয়ানা লোকিত পার্টি, হিন্দুস্তানি আওয়াম মোর্চা, জন সূর্য শক্তি, জন সেনা পার্টি, কেরালা কামারাজ কংগ্রেস, নিশাদ পার্টি, পাহাড় জনশক্তি পার্টি, পাটালি মাক্কাল কাচি, পুঠিয়া নিধি কাচি, রাষ্ট্রীয় লোক দল, রাষ্ট্রীয় লোক মোর্চা, রাষ্ট্রীয় সমাজ প্রকাশ, রিপাবলিকান পার্টি অব ইন্ডিয়া, সুহেলদেব ভারতীয় সমাজ পার্টি ও তামিল মানিলা কংগ্রেস।

ইন্ডিয়া (ইন্ডিয়ার ডেভেলডমেন্টাল ইসক্লুসিভ অ্যালায়েন্স) জোটে আছে – ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্ক্সিস্ট), আম আদমি পার্টি (এএপি), কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (সিপিআই), দাব্রিড়া মুন্নেত্র কাড়গম (ডিএমকে), জম্মু অ্যান্ড কাশ্মীর ন্যাশনাল কনফারেন্স, ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চা, ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, সমাজবাদী পার্টি (এসপি), শিব সেনা (উদ্ভব ঠ্যাকারে), অল ইন্ডিয়া ফরোয়ার্ড ব্লক, কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট), রেভ্যুলেশনারি সোসালিস্ট পার্টি, কেরালা কংগ্রেস (এম), বিদুথালাই চিরুথাইগাল কাচি, মারুমালারচি দ্রাবিড়া মুন্নেত্রা কাড়গম।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত