শেষ হলো ভারতের ১৩ বছরের অপেক্ষা। ২০১১ সালের পর আর কখনও বিশ্বকাপ জেতা হয়নি তাদের। সেবার জিতেছিল ঘরের মাঠের ওয়ানডে বিশ্বকাপ। একযুগের বেশি সময় পর এবার টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট দিয়ে বিশ্বকাপ ঘরে তুলল ভারত। বার্বাডোসের ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন ভেঙে কুড়ি ওভারের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জিতল রোহিত শর্মারা।
শনিবার (২৯) কেনসিংটন ওভালের শ্বাসরুদ্ধকর ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৭ রানে হারিয়ে শিরোপা উদযাপন করেছে ভারত। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৭ উইকেটে ১৭৬ রান করেছিল ভারত। সেই লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে প্রোটিয়ারা ২০ ওভারে করতে পেরেছে ৮ উইকেটে ১৬৯ রান। ২০০৭ সালে প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত। সেই হিসাবে ১৭ বছর পর জিতল প্রতিযোগিতাটির দ্বিতীয় শিরোপা।
The wait of 17 years comes to an end 🇮🇳
— T20 World Cup (@T20WorldCup) June 29, 2024
India win their second #T20WorldCup trophy 🏆 pic.twitter.com/z35z54ZQlI
৬ বলে দরকার ১৬ রান। কঠিন, তবে টি-টোয়েন্টিতে অসম্ভব নয়। ক্রিজে যখন আছেন ডেভিড মিলার, দক্ষিণ আফ্রিকার আশার প্রদীপ জ্বলজ্বল করছিল তখনও। শেষ ওভারে বোলিংয়ে আসা হার্দিক পান্ডিয়া প্রথম বলটা দিলেন মনের মতো- ফুলটস। মিলার মারলেন উড়িয়ে। কিন্তু বাউন্ডারি সীমানায় সূর্যকুমার যাদবের দুর্দান্ত ক্যাচে তার বিদায়ের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্নপ্রদীপও নিভে যায়। ম্যাচ শেষ হতে ৫ বল বাকি থাকলেও ততক্ষণে হার দেখে নিয়েছিল প্রোটিয়ারা।
সমান্তরালে জয়ের আনুষ্ঠানিকতার অপেক্ষায় ভারত। হার্দিকের শেষ বলটা হতেই বিশ্বকাপ জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা রোহিত শর্মা-বিরাট কোহলিরা। গত বছর ঘরের মাঠের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে যন্ত্রণার যে শিল বিঁধেছিল বুকে, সেখানে নিশ্চয় এখন খুশির ঝরনা ধারা বইছে।
দুটো আলাদা ফরম্যাট, দুটো আলাদা মঞ্চ। কিন্তু একটা জায়গায় অর্থ একই- বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে সেই খেতাবই জিতল এই ভারত।
টার্নিং পয়েন্ট
ফাইনাল মঞ্চে রান তাড়া করা এমনিতেই কঠিন। সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে ছিল ১৭৭ রানের বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জের শুরুতে খেই হারায় প্রোটিয়ারা। ১২ রান তুলতে হারায় রিজা হেনড্রিকস (৪) ও এইডেন মারক্রামের (৪) উইকেট। শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে দলকে পথে ফেরান কুইন্টন ডি কক ও ট্রিস্টান স্টাবস। চাপের মধ্যেও আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে ২১ বলে ৩১ রানের ইনিংস খেলেন স্টাবস।
ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের পথে তার উইকেটটি হতে পারতো টার্নিং পয়েন্ট কিংবা ৩১ বলে ৩৯ রান করা ডি ককের আউটও হতে পারতো ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়ার মুহূর্ত। তবে তাদের বিদায়ের পরও ম্যাচ পুরোপুরি দক্ষিণ আফ্রিকার নিয়ন্ত্রণে ছিল হেনরিক ক্লাসেনের তাণ্ডবে। আইপিএল মাতিয়ে আসা এই ব্যাটার ১৫তম ওভারে আক্ষরিক অর্থেই ঝড় তুলেছিলেন অক্ষর প্যাটেলের ওপর। ওই ওভারে তিনি ২৪ রান নিলে দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ের জন্য দরকার পড়ে ৩০ বলে ৩০ রান।
কিন্তু ক্লাসেনকে বিদায় করে হিসাব পাল্টে দেন হার্দিক। ১৭তম ওভারে তার প্রথম বলে ক্লাসেনের ফেরাটাই ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট। ২৭ বলে ২ চার ও ৫ ছক্কায় ক্লাসেনের খেলা ৫২ রানের ইনিংসে জয়ের দারুণ সম্ভাবনা তৈরি হলেও পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা।
তারপরও মিলার ছিলেন বলে আশা ছিল প্রোটিয়াদের। কিন্তু শেষ ওভারের প্রথম বলে মিলারের (১৭ বলে ২১) আউটে সব শেষ দক্ষিণ আফ্রিকার।
ভারতের স্পিনাররা ফাইনালে হতাশ করেছেন। সেমিফাইনালের অন্যতম নায়ক কুলদীপ যাদব ৪ ওভারে ৪৫ রান দিয়েও ছিলেন উইকেটশূন্য। তবে পেসাররা করেছেন আগুনে বোলিং। জসপ্রিত বুমরার ম্যাজিক চলমান ছিল। ১৫ উইকেট নিয়ে তিনি বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়।
ক্লাসেনের আউটের আগে-পরে জাদুকরী ২ ওভারে বুমরা খরচ করেছেন মাত্র ৬ রান। ফলে আস্কিং রেট বাড়তে থাকে প্রোটিয়াদের। ডানহাতি এই পেসার ৪ ওভারে মাত্র ১৮ রান দিয়ে নেন ২ উইকেট। আরেক পেসার আর্শদীপ সিংও আলো ছড়িয়েছেন। ৪ ওভারে ২০ রান দিয়ে তার শিকার ২ উইকেট।
তবে ক্লাসেন ও মিলারকে আউট করা হার্দিক হয়তো তাদের চেয়ে একটু এগিয়ে থাকবেন। প্রয়োজনের সময় দুটো গুরুত্বপূর্ণ উইকেট এনে দিয়ে ফাইনাল জয়ের পথ তৈরি করেছেন তিনি। ডানহাতি পেসার ৪ ওভারে মাত্র ২০ রান দিয়ে নেন ৩ উইকেট।
সেরা মুহূর্ত
ফাইনালের একাদশে বিরাট কোহলি কি থাকবেন? যার ব্যাটে গাঁথা হয়েছে রেকর্ডের মালা, সেই ক্রিকেটারের বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা বিস্ময়কর লাগতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন তো তুলেছে তার ধারাবাহিক ব্যর্থতাই। টস জিতে রোহিত শর্মা যখন জানালেন একই একাদশ নিয়ে ফাইনালে নামছে ভারত, তখনই নিশ্চিত হওয়া যায় কোহলি খেলছেন। তিনি শুধু খেললেন না, আসল মঞ্চে জ্বলে উঠে ভারতকে এনে দেন বড় সংগ্রহ। তার আলোকিত ব্যাটিংয়ে নির্ধারিত ২০ ওভারে ৭ উইকেটে ১৭৬ রান করে ভারত।
২০২৪ সালের আইপিএলে রানের বৃষ্টি ঝরিয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নেমেছিলেন কোহলি। একসময় রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুতে তার সতীর্থ ছিলেন এবি ডি ভিলিয়ার্স। ওয়েস্ট ইন্ডিজ-যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বকাপ শুরুর আগে সাবেক প্রোটিয়া অধিনায়কের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, এবারের আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হবেন কোহলি। আইপিএলের ফর্ম বিবেচনায় কথাটা বলেছিলেন ডি ভিলিয়ার্স।
An action-packed first innings 💥
— T20 World Cup (@T20WorldCup) June 29, 2024
India have put on 176/7 on the board courtesy of Virat Kohli's fighting 76 in the all-important Final 👏#T20WorldCup | #SAvIND | 📝: https://t.co/AjkZFhTXML pic.twitter.com/oEJPAJ8WKc
কিন্তু বিশ্বকাপে অন্য চিত্র দেখতে হয় কোহলিকে। বাংলাদেশের বিপক্ষে ৩৭ রান ছিল ২০২৪ সালের আসরে তার সর্বোচ্চ সংগ্রহ। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেমিফাইনালেও যখন হাসলো না তার ব্যাট, তখনই শুরু হয় ফাইনালে কোহলির জায়গা হারানোর গুঞ্জন।
কে না জানে কোহলি বড় মঞ্চের খেলোয়াড়। সেটি তিনি আরেকবার প্রমাণ করলেন। তার দুর্দান্ত হাফসেঞ্চুরিতে লড়াকু সংগ্রহ পায় ভারত। প্রোটিয়া বোলারদের সামনে মাত্র ৩৪ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে বসে দলটি। রোহিত শর্মার (৯) পর বিদায় নেন ঋষভ পন্ত (০) ও সূর্যকুমার যাদব (৩)।
ওই জায়গা থেকে লড়াই শুরু কোহলির। পরিস্থিতির দাবি মিটিয়ে পেয়েছেন এবারের বিশ্বকাপের প্রথম হাফসেঞ্চুরি। চাপের সময় যেমন দেখেশুনে খেলেছেন, তেমনি চড়াও হয়েছেন হাফসেঞ্চুরি পূরণের পর। শেষ পর্যন্ত ৫৯ বলে ৬ বাউন্ডারি ও ২ ছক্কায় ৭৬ রানের ঝলমলে ইনিংস খেলে জিতেছেন ফাইনালের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার।
The man for the big occasion 👏
— T20 World Cup (@T20WorldCup) June 29, 2024
Virat Kohli raises the bat to celebrate an @MyIndusIndBank Milestone at the #T20WorldCup Final 🏏#SAvIND pic.twitter.com/T41OvkfKNZ
তাকে দারুণ সঙ্গ দিয়ে চমৎকার ইনিংস খেলেছেন ব্যাটিং অর্ডারে প্রমোশন পাওয়া অক্ষর প্যাটেল। পাঁচে নেমে ৩১ বলে ১ বাউন্ডারি ও ৪ ছক্কায় ৪৭ রান করে কুইন্টন ডি ককের দুর্দান্ত থ্রোতে দুঃখজনক রানআউটের শিকার তিনি।
ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়া শিবম দুবেও অবদান রেখেছেন ১৬ বলে ৩ চার ও ১ ছক্কায় ২৭ রান করে। হার্দিক পান্ডিয়া অপরাজিত থাকেন ৫ রানে।
দক্ষিণ আফ্রিকার আনরিখ নর্কিয়া ৪ ওভারে ২৬ রান দিয়ে নেন ২ উইকেট। বাঁহাতি স্পিনার কেশব মহারাজ ৩ ওভারে ২৩ রান খরচায় পেয়েছেন ২ উইকেট। একটি করে উইকেট শিকার কাগিসো রাবাদা ও মার্কো ইয়ানসেনের।