Beta
শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫

ভারতে নির্বাচনে দাতা কারা, কী পায় তারা

electoral-bonds-scheme-164733694-16x9
[publishpress_authors_box]

বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের লোকসভা নির্বাচন কদিন পরেই। নির্বাচন সামনে রেখে কেন্দ্রীয় দলগুলো এরই মধ্যে প্রচার চালানো শুরু করেছে নিজ নিজ জায়গা থেকে। পিছিয়ে নেই আঞ্চলিক দলগুলোও।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনার অরুণ গোয়েলের হঠ্যাৎ পদত্যাগে নির্বাচনী প্রক্রিয়া কিছুটা ধাক্কা খেয়েছিল। নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার ধারণাও করা হয়েছিল।

কিন্তু দেশটির নির্বাচন কমিশন সেই ধাক্কা কাটিয়ে আগামীকাল শনিবার বিকাল ৩টায় তফসিল ঘোষণা করবে। এর পরেই জানা যাবে, লোকসভা নির্বাচন কবে হবে।

দ্য হিন্দু বলছে, এবারের নির্বাচনে প্রার্থীদের জন্য নির্বাচনী ব্যয়ের সীমা লোকসভা কেন্দ্রপ্রতি ৯৫ লাখ ও ছোট রাজ্যে ৭৫ লাখ রুপি। কিন্তু বিষয়টি সবারই জানা যে, বড় রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা নিয়মিত এই সীমা অতিক্রম করে। এই কার্যকলাপের মধ্যে ভোটারদের অবৈধভাবে নগদ টাকা ও উপহার বিতরণও অন্তর্ভুক্ত। যেসব রাজ্য এই দুর্নীতিগ্রস্ত নির্বাচনী চর্চা করে, সেখানে ব্যয়ের আনুষ্ঠানিক সীমা প্রকৃত নির্বাচনী ব্যয়ের এক ভগ্নাংশও নয়।

ভারতে নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যয়ের কোনও সীমা নেই। ২০১৯ সালের নির্বাচনে বিজেপি ও কংগ্রেস যথাক্রমে ১ হাজার ২৬৪ কোটি ও ৮২০ কোটি রুপি আনুষ্ঠানিক ব্যয়ের ঘোষণা দিয়েছিল।

তবে সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজের (সিএমএস) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলো প্রায় ৫০ হাজার কোটি রুপি খরচ করেছিল। এর মধ্যে বিজেপি ৫০ ও কংগ্রেস ২০ শতাংশ খরচ করে।

প্রতিবেদন অনুসারে, রাজনৈতিক দলগুলো যে অর্থ ব্যয় করে এর ৩৫ শতাংশ প্রচারে যায়। আর ২৫ শতাংশ অবৈধভাবে ভোটারদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এই তহবিলের অধিকাংশই আসে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। ফলে এটি দাতাদের এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি অনৈতিক যোগসাজশ তৈরি করে।

সিএমএস চেয়ারম্যান এন ভাস্কর রাও বলেন, আসন্ন নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন রুপির (১৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার) বেশি ব্যয় করবে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

ভারতীয় মুদ্রা রুপি।

আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে দাতা কারা

২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকার নির্বাচনী বন্ড (ইলেকটোরাল বন্ড) প্রকল্প চালু করে।

তখন বিরোধী দলের সদস্য ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এই প্রকল্পকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। তাদের যুক্তি ছিল, এই প্রকল্পে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার বাড়াবে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোকে কে বা কারা অর্থায়ন করে সে সম্পর্কে জনগণকে বিভ্রান্তিকর ধারণা দেবে।

এখন রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচনী বন্ড ব্যবহার করা হয়। নির্বাচন কমিশন গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত তথ্যের তালিকা তাদের ওয়েবসাইটে আপলোড করেছে। এই তথ্য তারা পেয়েছে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া (এসবিআই) থেকে।

তালিকা অনুসারে, গত প্রায় পাঁচ বছরে ১ হাজার ৩০০’র বেশি কোম্পানি ১২ হাজার ১৫৬ কোটি রুপির বন্ড কিনেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নির্বাচনী বন্ড কিনেছে দেশটির কইমবাতরভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেস। এর মাধ্যমে তারা দলগুলোকে ১ হাজার ৩৬৮ কোটি রুপির তহবিল দিয়েছে। ২০১৯ সালের ১২ এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের ২৪ জানুয়ারির মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি এসব বন্ড কিনেছে।

এরপরেই আছে মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রাসট্রাকচারস লিমিটেড, ৯৬৬ কোটি রুপি।

তালিকার তৃতীয় অবস্থানে থাকা কুইক সাপ্লাই চেইন প্রাইভেট লিমিটেড ৪১০ কোটি রুপির বন্ড কিনেছে। এরপর রয়েছে পর্যায়ক্রমে বেদান্ত লিমিটেড (৪০০), হলদিয়া এনার্জি লিমিটেড (৩৭৭), ভারতি গ্রুপ (২৪৭), ইজেল মাইনিং অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড (২২৪), ওয়েস্টার্ন ইউপি পাওয়ার ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (২২০), কেভেনটার ফুডপার্ক ইনফ্রা লিমিটেড (১৯৫) ও মদনলাল লিমিটেড (১৮৫ কোটি রুপি)।

জিন্দাল স্টিল অ্যান্ড পাওয়ার ২০২২ সালের ৭ অক্টোবর বন্ডের মাধ্যমে ২৫ কোটি রুপি দান করেছিল। এর তিন দিন পর প্রতিষ্ঠানটি পালমা আইভি/৬ কয়লা খনির দায়িত্ব পায়।

বেদান্ত লিমিটেড ২০২১ সালের ৩ মার্চ রাধিকাপুরের একটি বেসরকারি কয়লা খনির দায়িত্ব পায়। এর এক মাস পরেই প্রতিষ্ঠানটি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে ২৫ কোটি রুপি দান করে।

একইভাবে ২০২০ সালের অক্টোবরে মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রা ২০ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড দান করার পর ৪ হাজার ৫০০ কোটি রুপির জোজিলা টানেল প্রকল্পটি পেয়েছিল। এছাড়া ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রতিষ্ঠানটি বিকেসি বুলেট ট্রেন স্টেশন তৈরির চুক্তি করে। ওই মাসেই প্রতিষ্ঠানটি নির্বাচনী বন্ডে ৫৬ কোটি রুপি দান করে।

ইকোনোমিক টাইমস বলছে, নির্বাচনী বন্ড দেওয়ার এই ধরনটির মাধ্যমে কোম্পানিগুলোকে দেওয়া সরকারি সুবিধা ও বিনিময়ে আর্থিক সহায়তার বিষয়টি নির্দেশ করে। একই সঙ্গে নির্বাচনী অর্থায়ন ব্যবস্থার সততা ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্নও উত্থাপন করে।

নির্বাচনী বন্ড প্রকল্পটি শুরু থেকেই উদ্বেগজনক ছিল। এর অন্যতম কারণ কর্পোরেট দানের ওপর নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নেওয়ায় কালো টাকা রাজনৈতিক তহবিলে প্রবেশের পথ উন্মুক্ত হয়ে যাওয়া।

উদাহরণ হিসেবে ভারতের কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের (এমওসিএ) একটি তথ্য উল্লেখ করা যায়। সেখানে বলা হয়, মাত্র ১৩০ কোটি রুপির শেয়ার মূলধন নিয়ে গঠিত কোম্পানি কুইক সাপ্লাই চেইন লিমিটেড ৪১০ কোটি রুপির বন্ড দান করেছে।

আরেকটি বড় সমস্যা হলো তথ্য ঘাটতি। নির্বাচনী বন্ড প্রকল্পটি ২০১৭ সালে শুরু হলেও এসবিআইয়ের কাছে শুধু ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে তথ্য আছে। ফলে আড়াই হাজার কোটি রূপির বন্ড লেনদেনের কোনও হিসাবই নেই।

এই ঘটনায় প্রকল্পটির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। উদাহরণস্বরূপ বন্ডের প্রথম কিস্তিতে বিজেপি ৯৫ শতাংশ তহবিল পায়। এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি করেছেন পর্যবেক্ষকরা।

সান্তিয়াগো মার্টিন।

ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেসের পরিচয়

১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেল সার্ভিসেসের আগের নাম ছিল মার্টিন লটারি এজেন্সি লিমিটেড। এটি ভারতের ‘লটারি কিং’ নামে পরিচিত সান্তিয়াগো মার্টিনের মালিকানাধীন।

মার্টিন ১৩ বছর বয়সে লটারি ব্যবসা শুরু করেন। তিনি দ্রুত পুরো ভারতে লটারির ক্রেতা ও বিক্রেতাদের একটি বিশাল বিপণন নেটওয়ার্ক তৈরিতে সক্ষম হন।

ফিউচার গেমিং ভারতের প্রথম লটারি কোম্পানি হিসেবে এশিয়া প্যাসিফিক লটারি অ্যাসোসিয়েশনের (এপিএলএ) সদস্য। ২০০১ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড লটারি অ্যাসোসিয়েশনেরও (ডব্লিউএলএ) সদস্য প্রতিষ্ঠানটি। ২০০৯ সালে ‘ডব্লিউএলএ রেসপনসিবল গেমিং ফ্রেমওয়ার্কের’ লেভেল ১ এর মানদণ্ড পূরণের স্বীকৃতি পায় ফিউচার গেমিং।

মার্টিন লাইবেরিয়ার কনসাল জেনারেল ছিলেন। সেখানে লটারি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান করেছিলেন। তিনি অল ইন্ডিয়া ফেডারেশন অফ লটারি ট্রেড অ্যান্ড অ্যালাইড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি। সংস্থাটি লটারি বিতরণকারী, মজুতদার ও এজেন্টদের একটি লবি।

২০১৫ সালে মার্টিনের ছেলে জোসে চার্লস মার্টিন কেরালা বিজেপিতে যোগ দেন। তার জামাই আধব অর্জুন এখন বিদুথলাই চিরুথাইগাল কাচির ডেপুটি জেনারেল সেক্রেটারি। মার্টিনের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

নির্বাচনী বন্ড থেকে প্রাপ্ত অর্থের মধ্যে বিজেপি ৬ হাজার ৬১, তৃণমূল কংগ্রেস ১ হাজার ৬১০, কংগ্রেস ১ হাজার ২১৫, বিজেডি ৭৭৬, ডিএমকে ৬৩৯, এএপি ৬৫ ও এআইএডিএমকে পেয়েছে ৬ কোটি রুপি।

বিজেপির এক সময়ের মিত্র শিব সেনা নির্বাচনী বন্ডের তালিকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। দলটির নেতা সঞ্জয় রাউত শুক্রবার এই ঘটনাকে ‘দেশের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, “কর্পোরেশনগুলো নির্বাচনী বন্ড কিনে সেগুলো সরকারি দলের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা দেয়। মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং বিভিন্ন চুক্তি পায় এবং এই সুবিধার বিনিময়ে লক্ষাধিক টাকার নির্বাচনী বন্ড ক্রয় করে। নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অর্থ কেনা এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়ার মতো অনেক কোম্পানি আছে। এটি দেশের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি।”

কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ নির্বাচনী বন্ডগুলোর ইউনিক আইডি নম্বর প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন।

তিনি বলেছেন, “২০১৯ সাল থেকে বিজেপিকে ১ হাজার ৩০০’র বেশি কোম্পানি ও ব্যক্তি নির্বাচনীয় বন্ডের মাধ্যমে ৬ হাজার কোটি রুপির বেশি অর্থ দিয়েছে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত