চিকিৎসা কিংবা ভ্রমণ কিংবা কেনাকাটা, দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশিদের প্রিয় গন্তব্য ভারত। ২০২৩ সালে ১৪ লাখের মতো বাংলাদেশি ভ্রমণে গিয়েছিল প্রতিবেশী দেশটিতে।
সহজ ভিসা প্রাপ্তি, কম ভ্রমণ ব্যয় এবং কম খরচে ভালো চিকিৎসা, মূলত এসব কারণেই বাংলাদেশিদের প্রিয় গন্তব্য ভারত।
কিন্তু প্রায় দুই মাস ধরে পর্যটক ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে ভারত। মেডিকেল ভিসাও দেওয়া হচ্ছে খুবই কম, আছে কড়াকড়িও।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নয়া দিল্লির এই কড়াকড়ি বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সেই ১৪ লাখ যাত্রীর গন্তব্য এখন কোথায়?
ট্রাভেল এজেন্ট, আইভ্যাক এবং ভিএফএস গ্লোবাল, এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, ভারতে ভিসা দেওয়া বন্ধ থাকলে চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশিদের একটি বড় অংশই যাবে থাইল্যান্ডে। ভ্রমণ, কেনাকাটার জন্যও একটি অংশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটিকেই বেছে নেবে।
থাইল্যান্ডগামী ফ্লাইটে যাত্রীর চাপ এরইমধ্যে কিছুটা বেড়ে গেছে, যা সেই কথাকেই ভিত্তি দিচ্ছে।
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সপ্তাহে ১৪টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে থাই এয়ারওয়েজ। প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশের সেলস এজেন্ট এয়ার গ্যালাক্সির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ ইউসুফ ওয়ালিদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ভারতের পর পর্যটক গন্তব্যের জন্য থাইল্যান্ড সব দিক থেকেই ভালো বিকল্প হতে পারে। কম খরচে ভ্রমণ এবং সেবা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশিদের জন্য থাইল্যান্ড সবচেয়ে উপযুক্ত।”
তবে ভারত পথ না খুললে ওই বাংলাদেশিরা থাইল্যান্ডকে বেছে নেবে কি না, তা স্পষ্ট হতে আরও সময় লাগবে বলে মনে করেন ওয়ালিদ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের এখনকার যা পরিস্থিতি, তাতে সব ধরনের নাগরিক এখনই ভ্রমণের কথা বিবেচনা করছে না। ব্যবসায়ীরা অনেকটা নিশ্চল রয়েছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীও ভ্রমণ নিয়ে আছে দ্বিধায়। সব মিলিয়ে সবাই ‘হোল্ডিং মুড’এ আছে। কয়েকমাস পরই বোঝা যাবে ভ্রমণকারীরা কোথায় ঝুঁকছে।
ভারতে ভিসা কড়াকড়ি থাকলে চিকিৎসা, পর্যটনের জন্য কি থাইল্যান্ড বিকল্প হতে পারে?
উত্তরে দেশের প্রথম অনলাইন ট্রাভেল এজেন্ট বি ফ্রেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামসুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ভারতের ভিসা বন্ধ থাকলে বাংলাদেশি যাত্রীদের একটি শ্রেণী কেবল থাইল্যান্ড যাবেন। সবাই না।”
এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “ভারতে সড়ক-ট্রেনে গিয়ে যত কম খরচে একজন বাংলাদেশি ট্রিটমেন্ট করে আসতে পারছেন, থাইল্যান্ডে এ গিয়ে একই চিকিৎসা করাতে অনেক টাকাই লাগবে। তাই থাইল্যান্ড মেডিকেল পারপাসে কিছু মানুষের জন্য বিকল্প হতে পারে, কিন্তু সবার জন্য না।”
ভ্রমণের জন্য বিকল্প হিসাবে দুবাই জনপ্রিয় গন্তব্য হলেও সেখানেও ভিসা বন্ধ থাকার কথা বলেন শামসুল।
পর্যটন, চিকিৎসা এবং কেনা-কাটার জন্য থাইল্যান্ড আগে থেকেই জনপ্রিয় গন্তব্যের একটি। তবে এখন দেশটির প্রতি ঝোঁক বেড়েছে, তা তুলে ধরেন বাংলাদেশে থাইল্যান্ডের অনারারি কনসাল আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, ” বাংলাদেশে কোনও প্রচার চালায় না থাইল্যান্ড। এরপর এখন প্রতিদিন সারাদেশ থেকে ৬০০ আবেদন জমা নেয়, সমপরিমাণ ইস্যু করে। ফলে বুঝতেই পারছেন চাপ কতটা বেড়েছে। কিন্তু লোকবল তো বাড়েনি।
“নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমি নিজে তাদের কাছে চিঠি লিখছি ভিসার হার বাড়ানোর জন্য। প্রয়োজনে লোকবল বাড়িয়ে হলেই বাংলাদেশিদের জন্য বাড়তি ভিসা ইস্যু করতে। একইসাথে চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি ফ্লাইট চালু করতে চিঠি লিখছি।”
ভারতমুখিতা কেন
ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২৩ সালে ১৪ লাখের বেশি বাংলাদেশি ভারত ভ্রমণে গেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যত পর্যটক ভারত যায়, তারমধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে। প্রথম স্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র। কোভিড মহামারির আগপর্যন্ত এই তালিকায় শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে সাড়ে ২১ লাখ পর্যটক ভারত গিয়েছিল।
বাংলাদেশিদের বড় অংশই ভারতে যায় চিকিৎসার জন্য। কারণ সেখানে চিকিৎসা খরচ অনেক সময় দেশের চেয়েও কম।
ট্রাভেল এজেন্টগুলো বলছে, ভারতকে বেছে নেওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ হচ্ছে ফ্লাই টাইম কম হওয়া। পাশাপাশি অনেক ভিসা দেওয়া হয়, আর ভিসা পাওয়াও সহজ।
জানতে চাইলে মুভ অন ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈকত বড়ুয়া সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ভারতে এত যাত্রী যাওয়ার হার কিন্তু একদিনে বাড়েনি। চিকিৎসা সেবা পেতে পেতে মুখে মুখে এক ধরনের প্রচার পেয়েছে, যাতে অন্যরা যেতে উৎসাহিত হয়েছে।
“বাংলাদেশ থেকে ভারতে যাওয়ার জন্য সড়ক, রেল এবং বিমানে সরাসরি সার্ভিস আছে। ফলে যে যার আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী ভারতে গেছে। আবার আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী কেউ ভেলোরে সরকারি হাসপাতালে গেছে, আবার কেউ দ্রুত চিকিৎসা পেতে বেসরকারি হাসপাতালে গেছে।”
ইন্ডিয়ান ভিসা প্রসেসিং সেন্টারের (আইভ্যাক) এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, বাংলাদেশে তাদের ১৬টি ভিসা সেন্টার রয়েছে, ফলে যে কাউকে ভিসার জন্য ঢাকায় ছুটতে হয় না। আর ভিসা ফিও মাত্র ৮০০ টাকা। ভিসা প্রক্রিয়াও সহজ।
ভারতের যাতায়াতের সুবিধাগুলো তুলে ধরে ট্রেফেল ট্যুরস এন্ড ট্রাভেল এজেন্সির কর্মকতা গোলাম রাব্বানি বলেন, মাত্র ৪০ মিনিটে উড়াল দিয়ে কলকাতা পৌঁছনো যায়। আবার ঢাকা থেকে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টায় চেন্নাই, ব্যাঙ্গালুর, দিল্লি, মুম্বাই পৌঁছনো যাচ্ছে। রেলপথেও সরাসরি কলকাতা যাওয়া যায়, বাসেও যাওয়া যায়। এসব মিলিয়ে ভারতে যাওয়ার হার বেড়েছে।
থাইল্যান্ড কি বিকল্প হতে পারে
থাইল্যান্ডের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন দেশ থেকে সেদেশে ২০২৩ সালে ২ কোটি ৮০ লাখ পর্যটক ভ্রমণে গেছে। এর মধ্যে শীর্ষে ছিল মালয়েশিয়া। শীর্ষ ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ নেই।
২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে কত পর্যটক থাইল্যান্ডে গেছে, তার পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ১ লাখ ৪০ হাজার জন থাইল্যান্ডে গিয়েছিল। তারমধ্যে চিকিৎসার জন্য গিছিল ৪৩০০ জন। বাকিরা গিয়েছিল কেনাকাটা কিংবা ভ্রমণের উদ্দেশ্যে।
বাংলাদেশ থেকে থাইল্যান্ড যেতে আকাশপথের বিকল্প নেই। আর শুধু ঢাকা থেকেই রয়েছে ফ্লাইট।
ঢাকা থেকে থাইল্যান্ড বিমানে পৌঁছাতে সময় লাগে আড়াই ঘণ্টা। সময়ের বিবেচনায় থাইল্যান্ড হতে পারে ভারতের বিকল্প।
কারণ ঢাকা থেকে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, সৌদি আরব সবই ৫ ঘণ্টার বেশি সময়ের পথ। আবার বিমানভাড়াও অনেক বেশি।
যেমন, ঢাকা থেকে ভারতের চেন্নাইয়ে আসা-যাওয়া মিলিয়ে বিমানভাড়া ২২ হাজার টাকা। থাইল্যান্ডে যেতে খরচ আসা-যাওয়া মিলিয়ে খরচ ২৭ হাজার টাকা। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই আসা যাওয়া মিলিয়ে ভাড়া লাগবে ৪৩ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৬০ হাজার টাকা।
থাইল্যান্ডে পরিবার নিয়েই নিয়মিত চিকিৎসা করতে যান চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “থাইল্যান্ডে চিকিৎসার মান একেবারে আন্তর্জাতিক মানের এবং চিকিৎসা খরচ সেই তুলনায় কম। বিমান ভাড়াটা যদি কিছুটা কমানো যায়, তাহলে বিপুল বাংলাদেশি সেখানে যাবেন।”
ভারতের ভিসা বন্ধের প্রেক্ষাপটে অনেক ট্রাভেল এজেন্সি থাইল্যান্ডে মেডিকেল ট্যুরিজমে গুরুত্ব দিচ্ছে। ভারতের চিকিৎসা খরচের সঙ্গে মিল রেখে অনেকগুলো হাসপাতালের সঙ্গে তারা চুক্তি করেছে। তারা বামরুনগ্রাদের মতো বড় হাসপাতালে যেমন চিকিৎসা প্যাকেজ দিচ্ছে, তেমনি একেবারে কমদামে সরকারি বা মিশনারি হাসপাতালগুলোর সঙ্গেও কথা বলেও চিকিৎসা সেবার সুযোগ দিচ্ছে।
ট্রেফেল ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মামুন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ভারতের বিকল্প হিসাবে এখন থাইল্যান্ড সবদিক থেকেই আমাদের কাছে ভালো মনে হচ্ছে।
“মূলত খরচ সাশ্রয় করতে বাংলাদেশিরা ভারত যেতেন, একই ধরনের খরচে যাতে থাইল্যান্ডের হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা দেওয়া যায়, সেই প্যাকেজ আমরা নিয়েছি। আবার মাঝারি মানের হাসপাতাল এবং একেবারে ভালো মানের হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা আমরা করে দিচ্ছি।”
থাইল্যান্ডের বিভিন্ন প্যাকেজ নিয়ে বেশ সাড়া পাচ্ছেন বলেও জানান মামুন।
তিনি বলেন, “থাইল্যান্ড সরকার যদি ভিসা সহজ করে, বিমান সংস্থাগুলো যদি চট্টগ্রাম, সিলেট থেকে সরাসরি ফ্লাইট চালু করে, তাহলে আশা করছি, থাইল্যান্ড ভালো বিকল্প হয়ে উঠবে।”
পর্যটনের দেশ থাইল্যান্ড ২০২৪ সালে ৩৬ লাখ ৭০ হাজার পর্যটক আকর্ষণের লক্ষ্য ঠিক করেছে। জুন পর্যন্ত ছয় মাসে লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছেছে। এই সময়ে সাড়ে ১৭ লাখ পর্যটক থাইল্যান্ড গেছে, এর মাধ্যমে দেশটির রাজস্ব আয় হয়েছে সাড়ে ২২ বিলিয়ন ডলার।
কিন্তু বাংলাদেশ থেকে থাইল্যান্ডের ভিসা দেওয়া হয় বেশ কম। ভিসা ফিও ভারতের চেয়ে অনেক বেশি, ৭ হাজার টাকা। আবার ভিসার আবেদন করা যায় শুধু ঢাকা, চট্টগ্রামে গিয়ে। অবশ্য থাইল্যান্ডের ভিসার জন্য কাউকে নিজে উপস্থিত থেকে আঙুলের ছাপ দিতে হয় না। ভারতের ক্ষেত্রে সরাসরি ভিসা সেন্টারে গিয়ে আঙুলের ছাপ দিতে হয়।
থাইল্যান্ডের ভিসা সেন্টার ভিএফএস’র এক কর্মকর্তা সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “২০২৪ সালের পর্যটক লক্ষমাত্রা পুরণে বাংলাদেশ অনেক ভূমিকা রাখতে পারে। এজন্য ভিসা প্রদানের হার বাড়াতে হবে এবং কম সময়ে ভিসা দিতে হবে। ইতোমধ্যেই আমরা উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি নোট দিয়েছি। সেটি অনুমোদন মিললে ভালো সংখ্যক পর্যটক থাইল্যান্ডে যাবেন; যারা আগে ভারতে যেতেন।”
ঢাকা থেকে তিনটি বিমান সংস্থা ব্যাংককে সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা করছে। থাই এয়ারয়েজের পাশাপাশি ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স ও বাংলাদেশ বিমান ফ্লাইট পরিচালনা করে। তবে সবই ঢাকা থেকে।
চট্টগ্রাম কিংবা সিলেট থেকে যদি ব্যাংককে ফ্লাইট পরিচালনা করা যায়, তাহলে যাত্রী আকর্ষণ করা অনেক বেশি সহজ বলে মনে করেন ট্রাভেল এজেন্টের কর্মকর্তারা।