নব্বই দশকের টিনেজারদের বিকেলগুলো কেমন ছিল? দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেই বেজে উঠতো স্কুলে ছুটির ঘন্টা। আর বাড়ি ফিরে আমরা একেকজন বসে পড়তাম টিভির সামনে রিমোট হাতে। রিমোটে চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে আমাদের অনেকেরই তখন চোখ আটকে যেতো এমটিভিতে।
সে সময়ের এমটিভি হাল আমলের মতো বিভিন্ন রিয়েলিটি শো দিয়ে ঠাসা নয়। পাশ্চাত্যের রক-পপ গানের সাথে হিন্দি ফিল্মের নাচ-গান তো চলতোই। পাশাপাশি বহু হিন্দি পপ গান তখন আমাদের স্কুল ফেরা দুপুর আর বিকেলের সঙ্গী হতো। যার একক কৃতিত্ব দেওয়া যায় সে সময়ের ভারতীয় ইন্ডি-পপ জনরাকে।
আলিশা চিনয়, সুচিত্রা কৃষ্ণমূর্তি, রেমো ফার্নান্দেজ, বাবা সায়গল, বালি সাগু, ফাল্গুনি পাঠকসহ আরও অনেক শিল্পী ছিলেন সে সময়ের ভারতীয় ইন্ডি-পপ জনরার জনপ্রিয় মুখ। ‘মেইড ইন ইন্ডিয়া’, ‘দোলে দোলে’, ‘ও মেরি মুন্নি’ ও ‘গোরি নাল ইশক মিটা আয় হায়’ এই গানগুলো তখন টিনেজার আর তরুণ-তরুণীদের মুখে মুখে ফেরে।
নব্বই দশকের ভারতীয় পপ সঙ্গীত
গান সবসময়ই ভারতীয় সিনেমার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রতি দশক যেমন একটি বিবর্তন নিয়ে আসে, ঠিক তেমনি ৯০ এর দশক শ্রোতাদের চির-বিকশিত সঙ্গীত স্বাদে একটি নতুন পরিবর্তন দেখেছিল। আর কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই ইন্ডি-পপ মিউজিকের জন্ম হয়। কিন্তু ইন্ডি-পপ আসলে কী?
প্রতিটি দশকই সঙ্গীতে নিয়ে আসে নতুন কিছু। ভারতের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিও দেখেছে এমন বহু ‘নতুন’ এর আনাগোনা। যেমন ৯০ দশকেই ভারতের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি দেখেছিল ইন্ডি-পপ জনরার উত্থান।
কিন্তু কী এই ইন্ডি-পপ?
ইন্ডি-পপ হলো ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত এবং ওয়েস্টার্ন পপ, এই দুইয়ের ফিউশনে জন্ম নেওয়া এক ভারতীয় সাংগীতিক ধারা। নব্বই দশকের শুরুতে এই ধারাটি ভারতের মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে এক শক্তিশালী জনরা হিসেবে আবির্ভূত হয়।
এই ধারা শ্রোতাদের শুধুই যে সুরে আটকে রাখতো তা নয়। এই ধারায় ভারতীয় শ্রোতারা খুঁজে পেতেন পাশ্চাত্য এবং ভারতীয়, এই দুইয়ের সাংস্কৃতিক সংশ্লেষ। যা কিনা শ্রোতাদের দিত এক অনন্য অভিজ্ঞতা। শুধুই ভারত নয়, ভারতের সীমা পেরিয়ে এই সুর পৌছেছিল বাংলাদেশেও। ইন্ডি-পপের অনন্য অভিজ্ঞতার স্বাদ পেয়েছিল বাংলাদেশের কিশোর-তরুণরাও।
নব্বই দশকের মিউজিক নিয়ে ভারতের একসময়ের জনপ্রিয় শিল্পী বাবা সায়গল বলেন “৯০ দশকের মিউজিক ছিল দুর্দান্ত এবং চ্যালেঞ্জিং। আমার একাগ্রতা, মা-বাবার আশীর্বাদ এবং লেবেল প্রতিষ্ঠানের সহায়তা আমাকে ইন্ডি-পপের নব ধারায় নিয়ে যায়।”
ইন্ডি-পপকে শুধুমাত্র এর মিউজিক দিয়ে বিচার করলে হবেনা। এর আমেজ, শিল্পী এবং ইউফোরিয়া, বোম্বে ভাইকিংস, কলোনিয়াল কাজিনস, সিল্ক রুট-এর মত ব্যান্ড, সব মিলিয়ে ইন্ডি-পপ।
ইন্ডি-পপ মানেই ছিল হিট। যেমন আলিশা চিনয়, তার গান তো শুধুমাত্র গান ছিল না। আলিশাই মেয়েদের শিখিয়েছিল কিভাবে স্বপ্ন দেখতে হয়। আর শিখিয়েছিল নিজের পছন্দের মানুষটি না পাওয়া পর্যন্ত কখনোই যেন কারও সঙ্গে সংসার পেতে না বসে।
বাবা সায়গল, ইউফোরিয়া, আরিয়ানস, সুনিতা রাও, শ্বেতা শেঠি, সুচিত্রা কৃষ্ণমূর্তি এবং অন্যান্যদের শিল্পীদের সাথে আলিশাও আলাদা করে ইন্ডি-পপে তার জায়গা করে নিয়েছিল। তার বেশ কয়েকটি গান এমটিভির টপ চার্টে থাকতো সে সময়।
সেই সময়ের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে আলিশা বলেন, “ওই সময় (পপ সিনে) একটা শুন্যতা ছিল আর তরুণরা এমন মিউজিক চাইছিল যার সঙ্গে তারা একাত্ম বোধ করবে। যেটাকে তারা নিজেদের বলে দাবি করতে পারবে। ঠিক তেমন এক সময়ে ইন্ডি-পপ এলো। শুরুটা হয়েছিল খুব ধীরে। কিন্তু হঠাৎ যেন জ্বলে উঠেছিল।”
হিন্দি সিনেমার গানের ভরা জোয়ারে ইন্ডি-পপের আগমনকে আলিশা ‘বিপ্লবী’ অভিধা দিয়ে আরও বলেন, যখন তার মিউজিক ভিডিও চ্যানেলগুলোতে মুক্তি পেল, তখন দর্শক শ্রোতারা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে, অভিনেত্রী নিজেই এখানে শিল্পী।”
‘জাবসে দেখা’, ‘সোনা’ এবং আরও অনেক বিখ্যাত গানের শিল্পী সুচিত্রা কৃষ্ণমূর্তির কথা নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে? সেই সুচিত্রা ইন্ডিয়া টুডেকে একবার বলেছিলেন, “সে সময় দরকার ছিল নতুন তারকার। সময়টা ছিল ক্রিকেট আর বলিউডের, আর ছিল ভারতীয় অর্থনীতির জন্য এক নতুন সম্ভাবনার। আমরা পপ তারকারা ছিলাম অনেক বেশি ওয়েস্টার্নাইজড আর শহুরে শ্রোতারা আমাদের সঙ্গে অনেক বেশি একাত্ম বোধ করতো। তারুণ্যকে আমরা নতুন কিছু দিতে পেরেছিলাম।”
এক নতুন সাংস্কৃতিক ঢেউ
নব্বই দশকের ইন্ডি-পপ ছিল ভারতীয় সঙ্গীতের এক স্বর্ণালী অধ্যায়। ইন্ডি-পপ জাগরণের আগে, ভারতীয় শ্রোতারা কেবল সিনেমার গান দেখে, শুনেই অভ্যস্ত ছিল। যেখানে নায়ক-নায়িকা প্লেব্যাক সিঙ্গারের সঙ্গে ঠোট মেলাতো। ইন্ডি-পপ এই ধারণা একেবারে বদলে দিল। শ্রোতারা দেখল গায়ক-গায়িকারা নিজেরাই পারফর্কম করছেন মিউজিক ভিডিওতে। গানের লিরিকে ধ্বনিত হচ্ছে স্বাধীনতা, সম্মতি আর নারীর ক্ষমতায়ন। সুনিতা রাওয়ের ‘পারি হু ম্যায়’, ইউফোরিয়া ব্যান্ডের ‘মায়েরি’, বোম্বে ভাইকিংসের ‘কেয়া সুরত হ্যায়’, কলোনিয়াল কাজিনস এর ‘সা নি ধা পা’-এর মত গানগুলো সেই সাক্ষ্যই দেয়।
ইন্ডি-পপ জাগরণের অন্যতম আইকন হয়ে উঠেছিলেন বোম্বে ভাইংকিসের নিরাজ শ্রীধর। ‘কেয়া সুরত হ্যায়’ গানটির জন্য তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে সারাবিশ্বে।
ইন্ডিয়া টুডেকে তিনি বলেন, “মানুষ আসলে নতুন কিছু দেখতে চাইছিল কারণ বলিউডই তখন একমাত্র ধারা হয়ে উঠেছে। এটা অবশ্য স্বাভাবিক ছিল। কারণ মেগাস্টাররা বলিউডের গানের তালে অভিনয় করছে। তারপরও সে সময় দরকার ছিল ভিন্ন কিছু। এমন একটা সময়, যখন আপনি ঘুরে ফিরে সাত-আটটা শিল্পীর কন্ঠই কেবল শুনছেন, ফলে এটা (ইন্ডি-পপ) অবশ্যম্ভাবী ছিল।”
কিন্তু ইন্ডি-পপ যত দ্রুত সাফল্য পেল ঠিক ততোটা দ্রুতোই যেন হারিয়ে গেল। কী এর কারণ?
আলিশা চিনয়ের মতে, “ইন্ডি-পপ যখন শুরু হয়, দলে দলে সবাই এর অংশ হয়ে ওঠে। মানে একটা হইচইয়ে পরিণত হয়। দেখা গেল, এতো এতো ভিড়বাট্টায়, ভালো গান সত্যিই সেভাবে হয়নি।”
তিনি আরও বলেন, “এটা আসলে একটা মাঝারি মেধার ঘটনা হয়ে উঠেছিল। মানুষ খুবই স্মার্ট। তারা যা-তা জিনিস পছন্দ করে না।”
এ ব্যাপারে সুচিত্রা কৃষ্ণমূর্তি র মতামত বেশ ভিন্ন। তার মতে, মিউজিকের ডিজিটাল ডিস্ট্রিবিউশন ইন্ডি-পপের পতনের কারণ। ক্যাসেট ও সিডি সংস্কৃতি থেকে মিউজিক যখন ডাউনলোড এবং স্ট্রিমিংয়ের সংস্কৃতিতে প্রবেশ করলো, তখনই ইন্ডি-পপের বাজার ধসে গেলো। মূলত, অনেক ছোট ছোট লেবেল (প্রযোজনা সংস্থা) এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি। মানিয়ে নেওয়ার মতো অর্থনৈতিক সক্ষমতাও তাদের ছিল না।
নতুন দিনের ইন্ডি-পপ
ভারতের মিউজিক জগতে আবারও উঁকিঝুকি দিচ্ছে ইন্ডি-পপ। নতুন এক প্রজন্মের কাঁধে ভর দিয়ে আবারও দাঁড়াচ্ছে এই ধারা। ঝকঝকে সাউন্ড আর সমকালীন সঙ্গীত অনুষঙ্গ, এই দুইয়ের মিলনে শ্রোতাদের সামনে হাজির হচ্ছে ইন্ডি-পপ। ধীরে ধীরে বাড়ছে এর জনপ্রিয়তা। পশ্চিমেও ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছে এই জনরা।
সমসাময়িক ইন্ডি-পপ নিয়ে সুচিত্রা কৃষ্ণমূর্তি বলেন, “দারুণ কিছু গান হচ্ছে। আমিতো দিলজিৎ দোসাঞ্জের ভক্ত। কিং-এর মান মেরি জান গানটাও খুব পছন্দের। ইন্ডি-পপ এখন আরও বেশি আঞ্চলিক গানের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হচ্ছে। ইন্ডিয়ার প্রতিটি প্রদেশ তাদের নিজস্ব ভাষায় ইন্ডি-পপ তারকাদের সামনে নিয়ে আসছে।”
(ইন্ডিয়া টুডে-এর প্রতিবেদন অবলম্বনে)