বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ইন্দোনেশিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ১৪ ফেব্রুয়ারি। ২০ কোটির বেশি নাগরিক ভোটের মাধ্যমে তাদের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবেন। এদের মধ্যে অনেকেই এবার প্রথম ভোট দেবেন।
১৭ হাজার দ্বীপের এ দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন হেভিওয়েট তিন প্রার্থী- সাবেক স্বৈরশাসক সুহার্তোর জামাতা প্রভাবো সুবিয়ান্তো, জাভার বর্তমান গভর্নর গানজার প্রানোও এবং জাকার্তার সাবেক গভর্নর আনিস বাসওয়দান।
নির্বাচনে কোন প্রার্থী কেমন ভোট পেতে পারেন, এনিয়ে সম্প্রতি জরিপ করেছে ইন্ডিকেটর পলিটিক ইন্দোনেশিয়া নামের একটি জরিপকারী সংস্থা। এতে দেখা গেছে, তিনজনের মধ্যে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে আছেন প্রভাবো।
সংস্থাটি বলছে, তারা ১,২০০ জনের ওপর জরিপ চালিয়েছে। অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে প্রভাবো প্রায় ৩০ পয়েন্ট এগিয়ে আছেন। ৫১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোটার তাকে সমর্থন করছেন। আনিস বাসওয়দান ও গানজার প্রানো পেতে পারেন ২৪ দশমিক ১ ও ১৯ দশমিক ৬ শতাংশ ভোট।
তবে সবার চেয়ে বেশি ভোট পেলেও প্রভাবোর জয় নিশ্চিত হবে না। নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট পদে জয়ী হতে হলে প্রার্থীকে অবশ্যই মোট ভোটের ৫০ শতাংশের বেশি এবং দেশটির অর্ধেকেরও বেশি প্রদেশে কমপক্ষে ২০ শতাংশ ভোট পেতে হবে।
প্রভাবো এই শর্ত পূরণ করতে না পারলে দ্বিতীয় স্থান অর্জনকারীর সঙ্গে ২৬ জুন দ্বিতীয় দফায় নির্বাচনে মুখোমুখি হতে হবে তাকে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে জয় পাওয়া কঠিন হতে পারে প্রভাবোর।
তরুণ ভোটাররাই ফ্যাক্টর
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, তরুণ ভোটাররাই নির্ধারণ করবেন- কে হতে যাচ্ছেন ইন্দোনেশিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট। দেশটির ২৭ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ১৭ বছরের বেশি বয়সী ২০ কোটি ৫০ লাখ। নিয়ম অনুসারে তারা এই নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বুধবারের নির্বাচনে ইন্দোনেশিয়ার ৭৫ শতাংশ মানুষ ভোট দিতে পারবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভোটারদের মধ্যে ১০ কোটি ৬০ লাখের বয়স ৪০ বছরের নিচে, যা মোট ভোটারের ৫২ শতাংশ। এর মধ্যে ৩০ বছরের কম বয়সী ভোটার এক তৃতীয়াংশ। তরুণ এই ভোটারদের আকর্ষণ করতে প্রার্থীরা নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ইন্দোনেশিয়া জুড়েই এখন নির্বাচনের জোয়ার। রাস্তা, ফুটপাত, এমনকি বাড়ির বাইরেও লাগানো আছে ব্যানার। সোশাল মিডিয়া ফিড যেন পরিণত হয়েছে নির্বাচনী রণক্ষেত্রে। প্রচারের ভিডিও, প্রার্থীদের প্রশংসায় লেখা ফ্যান আর্ট, আর মতামতের ঢল- সব মিলিয়ে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সোশাল মিডিয়ায়। ভোটে তরুণদের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এ নিয়ে চলছে জোর আলোচনা।
১৮ বছর বয়সী নাফিস আতাল্লাহ এবার প্রথমবার ভোট দেবেন। উত্তর সুমাত্রার মেদান অঞ্চলের নাফিস বলেন, “অর্ধেক সক্রিয় ভোটারই তরুণ।”
ইন্দোনেশিয়ার ভোটাররা কেবল তাদের পরবর্তী প্রেসিডেন্টই নয়, দেশজুড়ে সব প্রশাসনিক স্তরে নির্বাহী ও আইনসভার প্রতিনিধিও নির্বাচিত করবেন।
সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের গবেষক নূরী ওকথারিজা বলেন, “কোনও প্রার্থীর সঙ্গেই তরুণ ভোটারদের তেমন সম্পর্ক নেই। তরুণদের সমর্থন সব প্রার্থীর মধ্যে রয়েছে মনে হচ্ছে। তাই প্রার্থীরা তরুণ ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর নানা চেষ্টা করছেন। তরুণরা যেভাবে কথা বলে, যেভাবে পোশাক পরে, যেভাবে টিকটকের মতো সোশাল মিডিয়া প্লাটফর্ম ব্যবহার করে, এসব দিকে বিশেষ খেয়াল রাখছেন তারা।”
তরুণদের আকর্ষণ করতে কে-পপ কনসার্টের টিকেট বিতরণ, ভাইরাল নাচের ভিডিও দিয়েও সোশাল মিডিয়া ফিড সাজাচ্ছেন প্রার্থীরা।
যোগাযোগবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী নাফিস জানান, তিনি নাগরিক অধিকার রক্ষার বিষয়ে সচেতন। দেশের যেসব আইন বাক স্বাধীনতা দমনে ব্যবহৃত হয়, সেগুলো পছন্দ করেন না।
বিতর্কিত প্রভাবো
একসময় উগ্র জাতীয়তাবাদী বক্তব্য দেওয়া সামরিক কর্মকর্তা প্রভাবো তার নির্বাচনী প্রচারে ‘আদুরে দাদার’ চেহারায় আবির্ভূত হয়েছেন। সোশাল মিডিয়ায় চালাচ্ছেন ‘চটকদার’ সব প্রচার। তবে অন্ধকার অতীত পিছু ছাড়ছে না তার, চলছে তার কর্মকাণ্ডের নানা সমালোচনা।
প্রভাবো ছিলেন স্পেশাল ফোর্সেস কমান্ডার। বহু কারণে তিনি ইন্দোনেশিয়ায় বিতর্কিত। ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে অ্যাক্টিভিস্ট শিক্ষার্থীদের অপহরণ ও গুমের ঘটনায় তার জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। এসব কারণে তাকে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়। কিন্তু তাকে কখনও ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত করা হয়নি। সব অভিযোগই অস্বীকার করে আসছেন প্রভাবো।
পাপুয়া ও পূর্ব তিমুরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। পূর্ব তিমুরের বেসামরিক নাগরিকদের পরিকল্পিতভাবে হত্যার, বিশেষ করে ১৯৮৩ সালে ক্রারাস গ্রামে শতাধিক মানুষকে হত্যার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। ওই ঘটনার পর থেকে গ্রামটিকে ‘বিধবাদের গ্রাম’ বলা হয়। তিনি এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগকে ‘অপ্রমাণিত’ ও তৃতীয় পক্ষের উসকানি বলে অভিহিত করেন প্রভাবো।
জাকার্তার বাসিন্দা পাইয়ান সিয়াহান বলেন, “আমি প্রভাবোকে জিজ্ঞাস করতে চাই, আমার ছেলে কোথায়? যদি সে মারা যায়, তাহলে আমাকে তার মরদেহ কোথায় আছে- তা বলো। যদি জীবিত থাকে, তাহলে সে কোথায়?”
১৯৯৮ সালে সুহার্তো সরকারের শেষ দিকে পাইয়ানের ছেলে উকোক রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন। প্রভাবো যে ইউনিটের কমান্ডার ছিলেন, সেই ইউনিটকে ২৩ জন অ্যাক্টিভিস্টকে অপহরণের জন্য দায়ী করা হয়। তাদের মধ্যে একজন মারা যান এবং ১৩ জনকে আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
জাকার্তার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের বাইরে গত ১৭ বছর ধরে প্রতি বৃহস্পতিবার নিখোঁজ অ্যাক্টিভিস্টদের পরিবারের সদস্যরা জড়ো হচ্ছেন। তাদের অনেকেই বয়স্ক। তারা প্রভাবোর কাছে উত্তর চান। সেসব ঘটনার জন্য অন্য কারও চেয়ে তারা প্রভাবোকেই বেশি দায়ী করেন।
৭৮ বছর বয়সী বিধবা পাইয়ান সিয়াহান প্রতি সপ্তাহে দেপক অঞ্চল থেকে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের সামনে বিক্ষোভে যোগ দিতে আসেন। বিক্ষোভস্থল থেকে নিচের টি-শার্টের পেছনটা দেখালেন তিনি। সেখানে লেখা, “নিখোঁজদের ফিরিয়ে দাও। তাকে (প্রভাবো) দেশ শাসন করতে দিও না।”
প্রশ্নবিদ্ধ জোকো উইদোদো
প্রভাবো বর্তমান প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদোর বড় ছেলে গিবরান রাকাবুমিং রাকাকে নিজের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড় করিয়েছেন। জোকোর রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগাতেই প্রভাবো এমন করেছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
জোকো উইদোদো ছিলেন ইন্দোনেশিয়ার প্রথম নেতা, যার সঙ্গে রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণির কোনও সম্পর্ক ছিল না। দরিদ্র পরিবার থেকে আসা পটভূমিই ছিল তার জনপ্রিয়তার মূল কারণ। তার নিজের কোনো রাজনৈতিক দল না থাকায়, প্রশাসন পরিচালনা ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে প্রতিদ্বন্দ্বীদের সমর্থন নিতে হতো তাকে।
জোকো উইদোদোর কিছু সিদ্ধান্ত প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি একসময় স্বাধীন দুর্নীতিবিরোধী কমিশনকে দুর্বল করেন। সরকারের সমালোচনাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে সাইবার অপরাধ আইনও তিনিই চালু করেন। সাংবিধানিক আদালতে বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে নিজের ছেলেকে তিনি প্রভাবোর সহযোগী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে নামান। ওই আদালতের বিচারকও ছিলেন তার শ্যালক।
ভোটারদের প্রত্যাশা
মধ্য জাভার ওনোসোবোর ১৯ বছর বয়সী তেতে এবার প্রথম ভোট দেবেন। ইনস্টাগ্রামে তিনি প্রভাবোর ফলোয়ার।
তেতে মনে করেন, সাবেক জেনারেল প্রভাবো শক্ত হাতে দেশের নেতৃত্ব দিতে পারবেন। প্রভাবো নির্বাচিত হলে জোকোর কর্মসূচি, বিশেষ করে স্টেডিয়াম ও মহাসড়কের মতো অসমাপ্ত প্রকল্পগুলো চালিয়ে যাবেন বলে তার বিশ্বাস।
তেতে আরও জানান, এসব প্রকল্প থেকে তিনি উপকৃত হয়েছেন। তার বাড়ির কাছে একটি নতুন বাস টার্মিনাল এবং ইয়োগাকার্তা ও জাকার্তার মধ্যে নতুন মহাসড়ক হয়েছে। আগে এই পথে যাতায়াতে ১২ ঘণ্টা লাগত, এখন লাগে আট ঘণ্টারও কম।
তরুণ ভোটারদের অনেকেই চান জোকোর আমালের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকুক। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে আরও অবকাঠামো চান তারা। নতুন সরকার পাপুয়ার মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার প্রসারে কাজ করুক, তাও চাইছেন অনেকে।
সেন্টার ফর স্ট্রাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ বলছে, তরুণ ভোটাররা তাদের চাকরির নিশ্চয়তা, বেকারত্বের হার নিয়ে চিন্তিত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুও।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রভাবো কী গণতন্ত্র সুরক্ষিত রাখতে পারবেন
১৯৪৫ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ইন্দোনেশিয়া অনেক ঝড়ঝাপটা সহ্য করে টিকে আছে। এর মধ্যে আছে, নব্বইয়ের দশকে সুহার্তোবিরোধী আন্দোলন ও সহিংসতা, এর পরের দশকের গোড়ার দিকে জিহাদি সন্ত্রাসবাদের উত্থানের মতো ঘটনা। তাই অনেকেই মনে করেছিলেন, এসব কারণে দেশটির গণতন্ত্র ব্যাহত হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
অবশ্য এই স্থিতিশীলতার জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়েছে ইন্দোনেশিয়াকে। জনগণকে অনেক নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতা ত্যাগ করতে হয়েছে। সুহার্তোর আমলের নির্যাতনের বিচার হয়নি, এ জন্য কাউকে জবাবদিহিও করতে হয় না।
ইন্দোনেশিয়ার অনেক নাগরিকই মনে করেন, তাদের দেশ আরও ভালো হতে পারত। কিন্তু তারা এও মনে করেন, অনেক খারাপও হতে পারত। মিয়ানমার পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে এই নির্বাচনকে তারা মন্দের ভালো হিসেবে দেখছেন।
তথ্যসূত্র : বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান, নিউ ইয়র্ক টাইমস।