ইনডোর স্টেডিয়াম। কিন্তু এটা তৈরি কাপড় দিয়ে!
মাথার ওপর নেই আলোর ঝলকানি। নেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। দর্শকদের বসার জন্য গ্যালারিও নেই। তবুও এটি ইনডোর। যারা খেলেন তারা বলেন, ‘গরীবের ইনডোর।’
কল্পনাকে হার মানিয়ে বাগেরহাটের মোংলা শহরে এমন একটা অবিশ্বাস্য ইনডোর স্টেডিয়াম তৈরি করেছেন ব্যাডমিন্টন কোচ মিলন সর্দার। এলাকার লোকজন তাকে ডাকে জুস্ট জোন নামে, তবে এই নামের রহস্য অজানা।
কাপড়ের ইনডোরে এক ঝাঁক শাটলার
মোংলার ৩০-৩৫ জন ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় কাপড়ের তৈরি এই ইনডোরে নিয়মতি অনুশীলন করেন। এই ইনডোরে অনুশীলন করে জাতীয় পর্যায়ে উঠে এসেছেন লিকা পোদ্দার, স্বর্ণালী আক্তার, রোহানুল ইসলাম, বিথী আক্তার।
লিকা বঙ্গবন্ধু আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপের ব্যাডমিন্টনে মেয়েদের এককে ও দ্বৈতে চ্যাম্পিয়ন। এছাড়া ফেডারেশনের সিনিয়র র্যাঙ্কিংয়ে আছেন তৃতীয় স্থানে। স্বর্ণালী আক্তার বয়সভিত্তিক জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৪ পর্যায়ে রানার আপ। জাতীয় শিশু একাডেমি প্রতিযোগিতায় হয়েছেন চ্যাম্পিয়ন। পাশাপাশি ৫২ তম জাতীয় স্কুল ব্যাডমিন্টনে ব্রোঞ্জ জিতেছেন।
রোহানুল ইসলাম খেলেছেন জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৮ প্রতিযোগিতায়। ৫১তম শীতকালীন জাতীয় স্কুল চ্যাম্পিয়ন দুই ভাই হাসান হাওলাদার ও হোসেন হাওলাদারও এই ইনডোরে নিয়মিত অনুশীলন করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক শাটলার রহমান ঢালী, চাঁদনী হকসহ অনেকে এই ইনডোরে খেলেন। এখানে নিয়মিত খেলেন প্যারা ব্যাডমিন্টনে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হেলাল সানা, রানার আপ বিদ্যুৎ হালদার। ট্রেনিং করেন শেখ রাসেল জাতীয় স্কুল ব্যাডমিন্টনে দ্বৈতে রানার আপ রোহান-সাকিব জুটি।
কাপড়ের ইনডোর যেভাবে তৈরি
শুরুতে মোংলা শহরের পরিত্যক্ত রিমঝিম সিনেমা হলের মাটির কোর্টে অনুশীলন করতেন শাটলাররা। কিন্তু সম্প্রতি সেটাও ভেঙে ফেলা হয়েছে। মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনে থাকা পরিত্যক্ত এই সিনেমা হলটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে পৌরসভাকে। সেখানে তৈরি করা হবে পৌরভবন।
ওই ইনডোর ভেঙে ফেলার পর খেলোয়াড়েরা হতাশ হয়ে পড়েন। খেলার জায়গা না পেয়ে অনেকে কান্নাকাটি করতেন কোচের কাছে এসে। এরপরই এমন একটি ইনডোর তৈরির পরিকল্পনা করেন মিলন সর্দার। জায়গা বেছে নেন শহরের শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামের সীমানার ভেতরে। সেখানে ৫৫ ফুট বাই ৭০ ফুট আয়তনের একটি জায়গায় বাঁশ দিয়ে ঘিরে তৈরি করেছেন এই ইনডোর।
প্রথমে মাটি খুঁড়ে জায়গাটা নিচু বানানো হয়েছে। এরপর সেই মাটির কোর্টের চারপাশে ইট ও বালির গাঁথুনি দেওয়া হয়েছে। চারপাশে ৬০টি বাঁশের খুঁটি মাটিতে পুঁতে চারদিকে কাপড় দিয়ে ইনডোরের রূপ দেওয়া হয়েছে এটিকে।
শাটলারদের কথা ভেবেই এমন ইনডোর তৈরি করেছেন বলে জানালেন মিলন সর্দার, “যখন দেখি ওরা খেলতে পারছেনা তখন খেলোয়াড়দের মুখের দিকে তাকাতে পারি না। এই ইনডোর তৈরি করতে আমার বন্ধু অনেকগুলো বাঁশ দিয়ে সহযোগিতা করেছে। খুদে খেলোয়াড়েরা স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁশ গেড়েছে। এটা করতে গিয়ে অনেকের হাতে ফোসকা পড়েছে। হাত কেটে গেছে। ওরা অনেক কষ্ট করেছে।”
এই উদ্যোগে সহযোগী হয়েছিলেন রাহাত মান্নান নামের একজন ক্রীড়াপ্রেমী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। নিজে ব্যাডমিন্টন খেলতেন। এলাকার ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড়দেরও উৎসাহ দিতেন ও সহযোগিতা করতেন। রিমঝিম সিনেমা হল থেকে উৎখাত হওয়ার পর যখন কোনও আশ্রয় মিলছিল না শাটলারদের, তখন এই সরকারি কর্মকর্তা শেখ রাসেল স্টেডিয়ামের পাশে খেলার সুযোগ করে দেন। তিনি বদলি হওয়ার পর সেই সুযোগও হারিয়ে ফেলেন খেলোয়াড়েরা।
স্বপ্ন উড়ে গেছে ঝড়ে
এমনিতেই ভালো শাটলকক কেনার সামর্থ্য নেই খেলোয়াড়দের। বেশি দিন টেকে বলে প্লাস্টিকের শাটলকক দিয়ে অনুশীলন করেন খেলোয়াড়েরা। এলাকার অনেকে তাদের দিকে বাঁকা চোখে তাকান। যে ব্যাগে র্যাকেট নিয়ে আসেন, সেটা দেখে অনেকে গিটারের ব্যাগ বলে ভাবে। খেলোয়াড়েরা গান-বাজনা করে বলেই অনেকের ধারণা।
এলাকাবাসীর চোখ রাঙানি ও তাচ্ছিল্য উপেক্ষা করে খেলোয়াড়েরা নিয়মিত অনুশীলন করতেন এই ইনডোরে। কিন্তু এই সম্বলটুকুও উড়ে গেছে ঝড়ে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারির ঝড়ে পুরো কাপড়ের ইনডোর লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। এখন আর সেখানে ট্রেনিংয়ের উপায় নেই।
এই অবস্থায় কি করবেন সেটা কোচ নিজেও বুঝতে পারছেন না। অসহায়ের সুরে বলছেন, “এটা পশুর নদীর পাড়ে অবস্থিত। খোলা জায়গা। তাই সব সময় বাতাস থাকে। ১৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার সময় ঝড়ো হাওয়ায় ইনডোরটা উড়ে গেছে। কাপড় সব ছিঁড়ে গেছে। শাটলারদের অনুশীলন বন্ধ। এই অবস্থায় কার কাছে সাহায্য চাইব বুঝতে পারছি না। আমরা সবাই হতাশ।”
খেলোয়াড়রা তাকিয়ে সরকারের দিকে
দেশের প্রতিটি উপজেলায় ১টি করে মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণের প্রকল্প চলছে জাতীয় ক্রীড়াপরিষদের। শেখ রাসেলের নামে তৈরি এসব স্টেডিয়ামের অনেক জায়গায় করা হচ্ছে হালচাষ। অনেক জায়গায় লাগানো হয়েছে গাছের চারা।
অথচ মোংলায় অনেক ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় আছে, তাদের আগ্রহ আছে যদিও খেলার জায়গা নেই। কাপড়ের ইনডোরটাও উড়ে গেছে। হতাশ শাটলার লিকা পোদ্দার খেলোয়াড়দের অনুশীলনের জায়গার দাবি জানাচ্ছেন সরকারের কাছে, “ঝড়ে ইনডোর ভেঙে যাওয়ায় অনুশীলন করতে পারছি না। শুধু ফিটনেস ঠিক রাখতে মাঠে হালকা অনুশীলন করি। সামনে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা। অনুশীলন না করলে ভালো পারফরম্যান্স করাও সম্ভব না। এই অবস্থায় ক্রীড়া মন্ত্রণালয় যদি আমাদের অনুশীলনের জন্য একটা ইনডোরের ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে ভালো হতো। না হলে হয়তো খেলাটাই ছেড়ে দিতে হবে আমাদের।”