Beta
শুক্রবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ৭ নভেম্বর, ২০২৫

ডলার কেনায় মূল্যস্ফীতি বাড়ার শঙ্কা

SS-US-dollars-120824
[publishpress_authors_box]

দাম ধরে রাখতে নিলামে ডলার কিনেই চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) আরও ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার কেনা হয়েছে। গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) কেনা হয় ১০ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

এ নিয়ে তিন মাসে ১৫ দফায় সব মিলিয়ে ২১২ কোটি ৬০ লাখ (২.১৩ বিলিয়ন) ডলার কিনল বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এই ডলার কেনার কারণে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ বাড়ছে; বিপিএম-৬ হিসাবে ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। গ্রস হিসাবে প্রায় ৩২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

ডলার কেনার বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে প্রায় ২৬ হাজার কোটির বেশি টাকা দিয়েছে। এতে ডলারের দর স্থিতিশীল থাকার পাশাপাশি বাজারে টাকার সরবরাহ বেড়েছে। যদিও ডলার কিনে বাজারে টাকা সরবরাহ করায় মূল্যস্ফীতিতে কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা ধারণা করছেন।

এ প্রসঙ্গে বিশ্ব ব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলোর কাছে থাকা অতিরিক্ত ডলার কেনা ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনও উপায় নেই। কেননা, বাজারে এখন ডলারের সরবরাহ বেশি। এ অবস্থায় না কিনলে ডলারের দর কমে যাবে। তাতে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

“তবে, এটাও ঠিক যে, ডলার কেনার কারণে বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা আছে। তারপরও আমি বলব- অর্থনীতির অন্যতম প্রধান এই দুই সূচকের উর্ধ্বমুখী ধারা বজায় রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিক কাজটি করছে।”

মুদ্রাবাজারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পর ডলারের দর নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত ১৩ জুলাই ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে নিলামের মাধ্যমে ডলার কেনা শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় বাজার স্থিতিশীল রাখতে অর্থাৎ ডলারের দর যাতে কমে না যায় সেজন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ডলার কেনা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান।

সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেন, বাজার স্বাভাবিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক নিলামের মাধ্যমে ডলার কিনছে। মঙ্গলবার ১২১ টাকা ৭৫ পয়সা দরে ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার কেনা হয়েছে।

আগের মতোই বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ (এফএক্স) নিলাম কমিটির মাধ্যমে মাল্টিপল প্রাইস অকশন পদ্ধতিতে এই ডলার কেনা হয়েছে বলে জানান তিনি।

আরিফ খান বলেন, “ডলার দর বেড়ে যাওয়াও অর্থনীতির জন্য ভালো নয়, আবার কমে যাওয়াও ভালো নয়। তাই এ বাজারকে ‘সুস্থির’ রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিলামে ডলার কিনছে। তাতে ব্যাংকগুলোতে তারল্য প্রবাহ বাড়ছে।”

এর আগে ১৩ দফায় ১৯৮ কোটি ১০ লাখ (১.৯৮ বিলিয়ন) ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ১৩ জুলাই ১৮টি ব্যাংক থেকে ১২১ টাকা ৫০ পয়সা দরে ১৭ কোটি ১০ লাখ ডলার কেনা হয়েছিল। ১৫ জুলাই একই দরে ৩১ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ২৩ জুলাই ১২১ টাকা ৯৫ পয়সা দরে ১ কোটি ডলার কেনা হয়।

গত ৭ আগস্ট ১২১ টাকা ৪৭ পয়সা থেকে ১২১ টাকা ৫০ পয়সা দরে ৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার, ১০ আগস্ট ১২১ টাকা ৫০ পয়সা দরে ৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ১৪ আগস্ট ১২১ টাকা ৫০ পয়সা দরে ১৭ কোটি ৬৫ লাখ ডলার, ২৮ আগস্ট ১২১ টাকা ৬৬ পয়সা থেকে ১২১ টাকা ৭০ পয়সা দরে ১৪ কোটি ৯৫ লাখ ডলার কেনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গত ২ সেপ্টেম্বর ১২১ টাকা ৭৫ পয়সা দরে ৪ কোটি ৭৫ লাখ ডলার, ৪ সেপ্টেম্বর ১২১ টাকা ৭৫ পয়সা দরে ১৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার, ৯ সেপ্টেম্বর ১২১ টাকা ৭৫ পয়সা দরে ২৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার, ১৫ সেপ্টেম্বর ১২১ টাকা ৭৫ পয়সা দরে ৩৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার এবং ২২ সেপ্টেম্বর ১২১ টাকা ৭৫ পয়সা দরে ১২ কোটি ৯০ লাখ ডলার কেনা হয়।

চলতি অক্টোবর মাসে দুই দফায় ২১ কোটি ১০ লাখ ডলার কেনা হয়েছে। এর মধ্যে গত ৬ অক্টোবর ১২১ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে ১২১ টাকা ৮০ পয়সা দরে ১০ কোটি ৪০ লাখ ডলার কেনা হয়। গত ৯ অক্টোবর কেনা হয়েছে ১০ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

সবশেষ মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) ৬ ব্যাংকের কাছ থেকে আরও ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তিন বছর আগে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ডলারের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। ডলারের দাম ৮৫ টাকা থেকে বাড়তে বাড়তে ১২২ টাকায় গিয়ে ঠেকে।

ডলারের বাজারের অস্থিরতার আঁচে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করে দিয়েছিল।

মুদ্রাবাজারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার পর ডলারের দর নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত ১৩ জুলাই ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে নিলামের মাধ্যমে ডলার কেনা শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

টাকার অবমূল্যায়ন ঠেকাতে এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে আমদানি বিল পরিশোধে সহায়তা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগে ডলার বিক্রি করছিল, সেখানে এখন চলছে উল্টো প্রবাহ।

গত ২০২৪-২৫ অর্থ বছর পর্যন্ত গত তিন বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ২৫ বিলিয়নের বেশি ডলার বিক্রি করে, যা মূলত জ্বালানি, সার ও খাদ্য আমদানি বিল মেটাতে ব্যবহার হয়েছে।

রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল

অর্থনীতির সামর্থ্য প্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ সূচক রিজার্ভ নিয়ে বাংলাদেশে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা চলছে আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময় থেকেই। অভ্যুত্থানের পর গত বছর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলেও উদ্বেগ কাটছিল না।

তবে বছর পার হওয়ার পর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স, রপ্তানি আয় এবং বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবিসহ অন্যান্য দাতা সংস্থার বাজেট সহায়তার ঋণে রিজার্ভ স্বস্তির জায়গায় এসেছে।

এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ডলার কেনার কারণেও রিজার্ভ বেড়েছে।

গত ৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে আকুর জুলাই-আগস্ট মেয়াদের ১৫০ কোটি (১.৫০ বিলিয়ন) ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ২৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার, গ্রস বা মোট হিসাবে ছিল ৩০ দশমিক শূন্য চার বিলিয়ন ডলার।

গত এক মাসের কিছু বেশি সময়ে সেই রিজার্ভ বেশ খানিকটা বেড়েছে। গত সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়ে ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ২৭ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। গ্রস হিসাবে ছিল ৩১ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার।

২০২৩ সালের ১২ জুলাই থেকে আইএমএফের কথা মতো রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গ্রস হিসাবের পাশাপাশি বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুসরণ করেও রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। ওই দিন বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। গ্রস হিসাবে ছিল ২৯ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার।

১২ জুলাইয়ের আগে শুধু গ্রস হিসাবের রিজার্ভের তথ্য প্রকাশ করত বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২১ সালের আগস্টে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করেছিল, তা গ্রস হিসাবেই।

ব্যাংকাররা বলছেন, রেমিটেন্স ও রপ্তানির প্রবাহ বাড়ার পাশাপাশি নিলামে ডলার কেনাও রিজার্ভ বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।

রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়। এছাড়াও বিদেশি ঋণ ও অনুদান (যেমন- বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার ঋণ-সহায়তা) এবং সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) রিজার্ভ বৃদ্ধিতে অবদান রাখে।

রিজার্ভের এই উৎসগুলোর মধ্যে রেমিটেন্স ছাড়া অন্যান্য সূচক এখন ভালো নেই। আগস্টের পর সেপ্টেম্বর মাসেও রপ্তানি আয় কমেছে। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৬২ কোটি ৭৫ লাখ (৩.৬২ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ।

এই আয় পাঁচ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম। আর গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে কম ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। এই মাসে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

উন্নয়ন সংস্থাগুলো থেকে ঋণ-সহায়তাও তেমন আসছে না। এফডিআইও আশানুরূপ নয়।

এখন অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক রিজার্ভ যেটা বাড়ছে সেটা মূলত ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে কেনা ডলার ও রেমিটেন্স বৃদ্ধির কারণেই বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথম তিন মাসে অর্থাৎ প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসীরা ৭৫৮ কোটি ৫৬ লাখ (৭.৫৮ বিলিয়ন) ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, যা গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি।

চলতি অক্টোবর মাসেও সেই ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত রয়েছে। এই মাসের প্রথম ১৩ দিনে (১ থেকে ১৩ অক্টোবর) ১২৭ কোটি (১.২৭ বিলিয়ন) ডলার দেশে এসেছে, যা গত বছরের অক্টোবর মাসের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৭ শতাংশ বেশি।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত