Beta
শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৫

বাজেটের আগে মূল্যস্ফীতিও উঠছে তেঁতে

খাদ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে বাজারে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
খাদ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে বাজারে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
[publishpress_authors_box]

এই সময়ে অর্থনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত প্রপঞ্চ মূল্যস্ফীতি বাজেটের আগে আরও চড়েছে। এপ্রিলের চেয়ে মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি তো বেড়েছেই খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশের দিকে ছুটছে।

বিদায়ী অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য থাকলেও তা আটকে রাখা যায়নি; গত ১৫ মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে।

এর মধ্যে গত এপ্রিলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি খানকিটা কমলেও মে মাসে ফের বেড়েছে বলে দেখা যাচ্ছে সরকারি পরিসংখ্যান সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সোমবার প্রকাশিত হালনাগাদ তথ্যে।

সদ্য শেষ হওয়া মে মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত খাতে ৯ দশমিক ১৯ শতাংশ।

আগের মাস এপ্রিলে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যে ছিল ১০ দশমিক ২২ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত খাতে ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

তার আগের মাস মার্চে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ; যার মধ্যে খাদ্যে ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ; খাদ্যবহির্ভূত খাতে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

মে মাসে ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ সার্বিক মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো ২০২৩ সালের মে মাসে বাংলাদেশের মানুষ যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পেয়েছিল, গত মে মাসে তা কিনতে ১০৯ টাকা ৮৯ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। সেই হিসাবে খাদ্যপণ্য কিনতে বেশি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে দেশের মানুষকে।

আর দুদিন পরই ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব সংসদে উঠতে যাচ্ছে। টানা চতুর্থ মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর দিক-নির্দেশনা প্রত্যাশা করছেন অর্থনীতিবিদরা।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডি একদিন আগেই বলেছিল, মূল্যস্ফীতির অভিঘাত দেশে গরিব মানুষের ওপরই পড়ছে বেশি।

তারা হিসাব দেখিয়েছে, গত ৫ বছরে গরিব-নিম্নবিত্তের খাওয়া মোটা চালের দাম ৩০ শতাংশ বেড়েছে। সে তুলনায় ধনীদের আহার্য চালের দাম ততটা বাড়েনি।

খাদ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ে বিবিএসের চেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য গত মাসেই দিয়েছিল সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। তাদের হিসাবে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে।

সেই হিসাব দিয়ে বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেছিলেন, নিম্ন আয়ের মাসুষ এখন চরম অসুবিধায় রয়েছে।

শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি

মে মাসে পল্লী এলাকায় বা গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে প্রায় ১০ শতাংশে উঠেছে। এপ্রিলে গ্রামে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। মে মাসে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশে উঠেছে।

এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৭৩ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ।

মে মাসে শহর এলাকায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৮৬ শতাংশ; খাদ্যবহির্ভূত খাতে ৯ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ।

খাদ্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে টিসিবির ট্রাকের সামনে লাইন হচ্ছে দীর্ঘ। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

১৫ মাস ধরে ৯ শতাংশের বেশি

গত বছরের মার্চ মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ শতাংশে ওঠে। এরপর তা আর কোনও মাসেই এর নিচে নামেনি।

গত বছরের আগস্টে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে ওঠেছিল। খাদ্য মূল্যস্ফীতি এক লাফে বেড়ে হয়েছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

পরের মাস সেপ্টেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশে নেমে আসে। খাদ্য মূল্যস্ফীতিও নেমে আসে ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশে।

অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশে ওঠে; খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

নভেম্বরে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ সার্বিক মূল্যস্ফীতির মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।

ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশে নেমে আসে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে নেমে আসে ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশে। তবে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৮ দশমিক ৫২ শতাংশে ওঠে।

এর পর গত কয়েক মাস খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বাড়লেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি দু্ই অঙ্কের নিচেই ছিল। এপ্রিলে এসে তা ফের ১০ দশমিক ২২ শতাংশে উঠে। মে মাসে তা আরও বেড়ে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশে উঠল।

গড় মূল্যস্ফীতি ৯.৭৩ শতাংশ

১২ মাসের গড় হিসাবে (২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের মে) দেশে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

গত অর্থবছরের একই সময়ে (২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের মে) গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ।

৯ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ গড় মূল্যস্ফীতি নিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছর (২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন) শেষ হয়েছিল।

তার আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার।

কিন্তু অর্থবছর শেষে দেখা যায়, বাজেটের লক্ষ্যের চেয়ে ৩ দশমিক ৪২ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়।

২০১০-১১ অর্থবছরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ। এর পর তা দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) নিচে নেমে আসে। ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত এই সূচক ৯ শতাংশের ওপরে ওঠেনি।

লক্ষ্য ছিল ৬ শতাংশ

চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরে; যদিও দেশের সব অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থাগুলো বলে আসছিল যে বাজারের যে অবস্থা তাতে সরকারের এই আশা কখনই পূরণ হবে না।

ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ

দুই বছরের কোভিড মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতির বেহাল হয়ে পড়ায় আর সব দেশের মতো বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতির পারদ চড়তে থাকে।

তবে বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি বেশ দ্রুত গতিতে কমলেও বাংলাদেশে সেই লক্ষণ নেই। এমনকি অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কায়ও মূল্যস্ফীতি কমে ৪ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।

মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে দুই বছর ধরে। যার আওতায় ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানোসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু তারপরও মূল্যস্ফীতি কমেনি।

বাংলাদেশে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭-০৮ সালে বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়তে বাড়তে ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছিল। এরপর মূল্যস্ফীতির হার এখনই সবচেয়ে বেশি।

২০০৯ সালের প্রথম দিকে আওয়ামীলীগ সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখনও মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের উপরে ছিল। পরে অবশ্য তা কমতে কমতে সহনীয় পর্যায়ে নেমে এসেছিল। দীর্ঘদিন ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করেছে।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি চড়তে থাকে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত