Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

অপুর স্বেচ্ছাচারিতায় ডুবছে শুটিং

বাংলাদেশ শুটিং স্পোর্ট ফেডারেশনের মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ। ছবি: সংগৃহীত।
বাংলাদেশ শুটিং স্পোর্ট ফেডারেশনের মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ। ছবি: সংগৃহীত।
Picture of বদিউজ্জামান মিলন

বদিউজ্জামান মিলন

ভারতের অভিনব বিন্দ্রাকে হারিয়ে ২০০২ ম্যানচেষ্টার কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জেতেন আসিফ হোসেন খান। কিন্তু সেই বিন্দ্রা পরে জিতেছিলেন অলিম্পিকে সোনা। অথচ আসিফ হারিয়ে গেছেন। ঘটনাকে প্রতীকি হিসেবে দেখা যেতে পারে। একটা নষ্ট কাঠামোর ভেতর দিয়ে কোনও শুটারের বড় হওয়ার সুযোগ নেই। অযোগ্য সংগঠকের হাতে পড়ে দেশের স্বর্ণ-প্রসবা শুটিং দিনে দিনে বিবর্ণ হচ্ছে।

এর দায় অনেকাংশে শুটিং স্পোর্ট ফেডারেশনের মহসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ অপুর। তার কথাই এতদিন শুটিংয়ে শেষ কথা ছিল। ক্ষমতার পালা বদলে পালিয়ে বেড়ানো সাবেক জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ক্ষমতায় মহাবলীয়ান ছোট ভাই অপু রীতিমতো স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিলেন ফেডারেশনে। কাজের চেয়ে অকাজই করেছেন বেশি। এসব করেই খেলাটির বারোটা বাজিয়ে তিনিও পালিয়ে গেছেন।   

শুটিং স্পোর্ট ফেডারেশনে শুরু হওয়া ক্যাম্পে কর্মকর্তাদের সঙ্গে শুটারদের মত বিনিময় সভা। ছবি: সংগৃহীত।

অপুর ১২ বছরে পদকে ভাটা

একটা সময় পর্যন্তু শুটিং ছিল বাংলাদেশের স্বর্ণপ্রসবা ডিসিপ্লিন। কমনওয়েলথ গেমস, এসএ গেমসে একাধিকবার বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে শুটিং। এসএ গেমসের কথায় ধরা যাক। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত শুটিং থেকে এসেছে ৮৯টি পদক। যার মধ্যে সোনার পদক  ২১টি। কিন্তু অপু ২০১২ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর পদকে ভাটার টান। ২০২৪ সাল পর্যন্ত ধরলে, ১২ বছরে এসএ গেমসে মাত্র ১টি সোনা জিতেছে বাংলাদেশ ! সেটিও শাকিল আহমেদ জেতেন ২০১৬ সালের গুয়াহাটি এসএ গেমসে। পরের ৮ বছরে বাংলাদেশ কোনও সোনা না জিতলেও ২০২২ এসএ গেমসে রুপা জেতেন আরদিনা ফেরদৌস।

মাঝে দুই বিদেশী কোচ ক্লাভস ক্রিস্টেনসেন ও মার্কো সকিচের কাজের সুফল পেয়েছিল ২০১৮ গোল্ডকোস্ট কমনওয়েলথ গেমসে। রুপা জেতেন আবদুল্লাহ হেল বাকি ও শাকিল আহমেদ। অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলো, ওই গেমসের পরপরই দুই সফল কোচকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ফেডারেশন।

কোচ মার্কো সকিচ ও শাকিল আহমেদের সঙ্গে ইন্তেখাবুল হামিদ অপু। ছবি: সংগৃহীত।

আসলে মহাসচিব অপু শুধু মুখে মুখে অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জনের কথাসহ নানা কিছু বলে বেড়াতো। বাস্তবে শুটিং উন্নয়নের কোনও পরিকল্পনাই ছিল না তার। এই কর্মকর্তার স্বৈরাচারী মানসিকতাই পিছিয়ে দিয়েছে খেলাটিকে।         

পাইপলাইন শূন্য

বাংলাদেশের শুটিং পিছিয়ে পড়ার পেছনে রয়েছে একাধিক কারণ। নেই নিয়মিত প্রতিযোগিতা, যে কারণে পাইপলাইনে উঠে আসছে না নতুন শুটার। সার্ভিসেস সংস্থা সেনাবাহিনী, নৌ বাহিনী ও বিকেএসপি নির্ভর হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের শুটিং। 

সাবেক তারকা শুটার সাইফুল আলম রিংকি ক্ষোভের সুরে বলছিলেন, “দেশে ৬২টি রাইফেলস ক্লাব থাকলেও তাদের কোনও যত্ন নেই। ক্লাবগুলো আর্মসও পায় না। অনেকগুলো নিষ্ক্রিয়। শুটিংটা সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিকেএসপির ওপর নির্ভরশীল। অথচ এই কমিটি নির্বাচিত হয়ে এসেছে ওই ৬২ ক্লাবের প্রতিনিধির মাধ্যমে। এই ক্লাবগুলোকে সচল রাখলেই দেশে প্রতিভাবান শুটারের অভাব হয় না।”

দুর্নীতিতে ডুবছে শুটিং

২০১৯ সালের জুলাইয়ে শুটিংয়ে অভ্যন্তরীণ তদন্তে উঠে এসেছিল ফেডারেশন মহাসচিব অপুর মহা দুর্নীতি কাণ্ড। ২০১৬ সালে শুটিংয়ের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং সংস্কার কাজের জন্য প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। সে টাকায় ১০টি ডিজিটাল টার্গেট চেঞ্জার স্থাপনের কাজ নেয় মহাসচিবেরই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ডেলকো বিজনেস অ্যাসোসিয়েশন লিমিটেড। যেখানে প্রতিটি টার্গেট চেঞ্জারের মূল্য দেখানো হয় প্রায় ২৬ লাখ টাকা। অথচ একই যন্ত্র পরবর্তী সময়ে ফেডারেশনসহ আর্মি, বিকেএসপি শুটিং ক্লাব আমদানি করে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকায়।

এছাড়া শুটিং ফেডারেশনের গুদাম থেকে বেশ কিছু অস্ত্র ও গুলি গায়েব হয়ে যাওয়ার অভিযোগ আছে। আবার রেজিস্ট্রার খাতায় বেশ কিছু গোলাবারুদ বেশি পাওয়া যায়। শুটিংয়ে এরকম নানা অনিয়মের ঘটনা উঠে এসেছিল ওই তদন্ত প্রতিবেদনে।

দিনকে দিন শুধু পিছিয়েই পড়ছে বাংলাদেশের শুটিং।

ফেডারেশনের সেইফ কাস্টডিতে একটা ট্রাঙ্ক আছে মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ অপুর। ট্রাঙ্কটি খুলে দেখানোর জন্য তদন্ত কর্মকর্তারা বারবার বললেও তিনি এড়িয়ে গেছেন।

এছাড়া শুটিং ফেডারেশনের অস্ত্র ও সরঞ্জাম সংরক্ষণাগার প্রতিবেদনে আসমঞ্জস্যতা পাওয়া যায়। ওই তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় সংস্থাটির মহাসচিব ইন্তেখাবুল হামিদ অপু ও তার ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তি ফেডারেশন থেকে নানা সুযোগ সুবিধা নিয়েছেন। কিন্তু তারা গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও নিজেদের দায়িত্ব পালন করেননি। সাবেক শুটাররা মনে করছেন, “যেহেতু মহাসচিবের ভাই মন্ত্রী (নসরুল হামিদ বিপু)। তার ছত্রছায়ায় এত অনিয়ম করার দুঃসাহস দেখাতেন অপু।”

অপুর স্বজনপ্রীতির বলি অনেক শুটার

দল গঠনে অনেক সময় নিয়মকানুন মানা হতো না। এমনকি নিজের মেয়ে আমিরা হামিদকে নিয়মবহির্ভূতভাবে বিভিন্ন সময়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় খেলিয়েছেন অপু। ২০১৮ সালে প্রতিভাবান শুটারকে উপেক্ষা করে আমিরাকে পাঠানো হয় বুয়েন্স এইরেসের যুব অলিম্পিক গেমসে। সেখানে বাছাইপর্বে ১৭তম হয়ে বাদ পড়েন মাত্র ৬০৯ স্কোর করে! এসবের বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গেমসে নিয়মতান্ত্রিকভাবে দল গঠন না করার অভিযোগ আছে অপুর বিরুদ্ধে। অনেকের অভিযোগ, “অপু ও স্থানীয় কোচ গোলাম মহিউদ্দিন শিপলু মিলে এই অপকর্ম করত। যেসব শুটারদের পছন্দ করতো না তাদের বাতিলের তালিকায় ফেলে দিত।”   

কোনও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ২০১৮ যুব অলিম্পিকে পাঠানো হয় অপুর মেয়ে আমিরা হামিদকে। সেখানে অংশগ্রহণের সার্টিফিকেট নিচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে। ছবি: সংগৃহীত।

বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পে শুটারদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কথা বলতেন ইসলামিক সলিডারিটি গেমসে রুপাজয়ী রাব্বি হাসান মুন্না। এরপর ক্যাম্প থেকে কৌশলে তাকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বলে মুন্নার দাবি, “আমাকে বিভিন্ন সময় পেছন থেকে অনেক শুটার ঠেলে দিতেন, নিজেদের দাবির কথা বলতে। এই করতে গিয়ে আমি দল থেকে বাদ পড়ি। কষ্টের ব্যাপার হচ্ছে পরের একটা গেমস সিলেকশনে আমার যে খারাপ পারফরম্যান্স হয়েছিল, সেটা দিয়েই আমাকে ১১ মাস বাতিলের খাতায় রেখে দেয়।”

কনভেনশন সেন্টারের ভাড়ার টাকা নয়-ছয়

শুটিং ফেডারেশনের আয়ের একটা বড় অংশ কনভেনশন সেন্টার ভাড়া দেওয়া। সেখান থেকে বছরে ফেডারেশনের আয় তিন থেকে সাড়ে তিন কোটি টাকা। কিন্তু সাবেক কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ কায়সার বলেছেন এই ভাড়ার টাকা নিয়ে অপুর নয়-ছয়ের কথা, “কনভেশন ভাড়ার টাকাও পুরোপুরি ফেডারেশন পেতো না। মাসে যদি ১৫টা অনুষ্ঠান হতো, কাগজে-কলমে দেখানো হতো ১০টা। বাকি ৫টার ভাড়া সে হাতে হাতে নিত। তবে আমাদের কাছে বলতো, বিভিন্ন পরিচিতজনকে বিনামূল্যে ভাড়া দেওয়া হয়েছে।” অথচ মহাসচিব বিভিন্ন সময় বলতেন, অর্থাভাবে ভাল কোচ আনতে পারছি না। ‍দুষতেন ক্রীড়া পরিষদ, মন্ত্রণালয় ও অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনকে। তারা শুটিং উন্নয়নে টাকা-পয়সা দিচ্ছে না। 

ফেডারেশনের ডরমেটরি ঘিরে মুখরোচক গল্প 

শুটিং ভবনে শুটারদের আবাসিক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা আছে। তৃতীয় তলায় এক পাশে মেয়ে শুটাররা আর অন্য পাশে ছেলে শুটারদের থাকার ব্যবস্থা আছে। এটা অবশ্যই একটা ভাল উদ্যোগ। কিন্তু এই ডরমেটরি নিয়ে নানা মুখরোচক গল্প আছে ক্রীড়াঙ্গনে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মেয়ে শুটার বলেছেন, “এই ডরমেটরিতে অনৈতিক কার্যকলাপ চলে, কয়েকজন কর্মকর্তাও এর সুযোগ নেয়। এখানকার একজন নারী শুটারকে  অনেকবার গর্ভপাত করাতে হয়েছে। এই ঘটনা এক রকম ওপেন-সিক্রেট। এক শুটিং ক্লাবের সেক্রেটারির সঙ্গে ওই শুটারের অনৈতিক সম্পর্ক ছিল।”

এরকম আরও অঘটনের গল্প শোনা যায়। এমনকি বাইরে থেকে বোরকা পরিয়ে মেয়েদের ডরিমেটরিতে ছেলে ঢোকানোর ঘটনাও ঘটেছে।

এসএ গেমসের শুটিংয়ে বাংলাদেশের সর্বশেষ সাফল্য আসে আরদিনা ফেরদৌসের হাত ধরে। শুটিং ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন তিনি। ছবি; সংগৃহীত।

সুন্দরী মেয়ে শুটার দেখলেই কিছু কর্মকর্তা সুযোগ নেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যান। এমন এক অঘটনের শিকার হওয়া আরেক নারী শুটার এক ক্লাব কর্মকর্তার অনৈতিক প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় হুমকির মুখে পড়ে তার ক্যারিয়ার। তিনি বলেছেন, “ওই কর্মকর্তার কু-প্রস্তাবে সাড়া না দেওয়ায় তারা আমাকে ক্যাম্প থেকে সরাসরি বের করে দেয়নি। আমার রেজাল্ট যাতে খারাপ হয় এজন্য যা যা করা দরকার তাই করেছে। শুটিং করার সময় আমার পেছনে দাঁড়িয়ে বাজে মন্তব্য করতো। এমন হলে কিভাবে একজন শুটার মনোঃসংযোগ ধরে রাখবে?”

অস্থির সময়ে ক্যাম্পের উদ্দেশ্য ভিন্ন  

এই প্রতিবেদন করার সময় একাধিকবার শুটিং ফেডারেশনের মহাসচিব অপুর মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রতিবারই মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। তিনি দৃশ্যমান না থাকলেও ফেডারেশনে তার অনুসারীরা ঠিকই আছেন। এবং তার চেয়ার রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সেটারই অংশ হিসেবে দেশের অস্থির এই সময়ের মধ্যে ৯ আগস্ট থেকে নতুন করে শুটিং ক্যাম্প ডেকেছে ফেডারেশন। যে ক্যাম্পে ডাকা হয়েছে নানা সময়ে বৈষ্যম্যের শিকার হওয়া শুটারদের। আছেন খেলা ছেড়ে কোচ হয়ে যাওয়া শুটারও। অর্থাৎ এতদিনের অপকর্ম ঢেকে সবার মন ভজানোর চেষ্টা করছে অপুর সঙ্গী-সাথীরা।   

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত