Beta
শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫
Beta
শনিবার, ২২ মার্চ, ২০২৫

শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ আর অসম্পূর্ণ তালিকার বেদনা

শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। স্থপতি: ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ও মো. জামী-আল-সাফী। আলোকচিত্র: উইকমিডিয়া কমন্স।

স্বাধীনতার পর থেকে অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশে এখনও আমরা একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে পারিনি। এই বেদনা আরও বেশি বুকে বাজে যখন দেখি বিগত পাঁচ দশকে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে বারংবার জালিয়াতি হয়; মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা বেশি জরুরি ছিল নাকি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজাকারদের তালিকা তৈরি বেশি জরুরি সেসব নিয়ে বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক কুতর্ক চলতে থাকে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যার শিকার শহীদদের তালিকা তো দূরের কথা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের শিকার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকাও আলোর মুখ দেখে না। বুঝতে পারি, আসলে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার হীন উদ্দেশ্য ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় কারুরই কোনও দায়বদ্ধতা নেই।       

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে আজই জানা গেল এ বছরের বিজয় দিবসের মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নে নেওয়া উদ্যোগটিও স্থগিত করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। আগামী ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে এই কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখন তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নে ২০২০ সালে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করেছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য জাতীয় কমিটির একটি উপ-কমিটিও ছিল। ওই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে গত চার বছরে মন্ত্রণালয় ৫৬০ জন বুদ্ধিজীবীর নাম তালিকাভুক্ত করে চারটি গেজেটও প্রকাশ করে। জাতীয় কমিটির সর্বশেষ সভা হয়েছিল চলতি বছরের ১৮ মার্চ এবং উপ-কমিটির সভা হয়েছিল ১ জুলাই। কিন্তু এরপর কমিটির কার্যক্রমই স্থগিত হয়ে যায়। এই অবস্থায় কমিটির দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন এই বিজয় দিবসেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ হচ্ছে না। (তথ্যসূত্র: দ্য ডেইলি স্টার)   

আজ এই বেদনাদায়ক সংবাদের সঙ্গে সকাল সন্ধ্যার পাঠকদের জন্য শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিজে কাজ করতে গিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতার খানিকটা শেয়ার করছি। আমাদের রচনা আর সম্পাদনায় ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালের একুশের বইমেলায়। এ বইটার কাজ আমরা শুরু করি এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সে পটভূমিটাও সামান্য বলতে হয়।

শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগার থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ

ঢাকার তেজগাঁও থানার নাখালপাড়া এলাকার বাম-প্রগতিশীল তরুণরা মিলে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে, ১৯৮৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিল ‘শহীদ শহীদুল্লা কায়সার স্মৃতি পাঠাগার’। কিছুদিন পর পাঠাগারের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগার’। পাঠাগারের নিয়মিত কাজের একটা হলো পাঠচক্র। প্রতি শুক্রবার কোনও বই বা কোনও বিষয় নিয়ে পাঠাগারের সদস্যরা আলোচনা করেন।

২০১৬ সালের আগস্ট মাসের দিকে সিদ্ধান্ত হলো যে প্রতি শুক্রবার তিন-চারজন করে শহীদ বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। এর উদ্দেশ্য ছিল পাঠাগারের সদস্যদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে জানা-বোঝা বাড়ানো। সদস্যদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হলো। কিন্তু এ-কাজটা করতে গিয়ে আমরা ভীষণ বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়ি। আমরা আবিষ্কার করি যে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে উল্লেখ করার মতো কোনও বই নেই।

বাংলা একাডেমির উদ্যোগে ১৯৮৫ সালে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ প্রকাশিত হয়েছিল। এ বইটাতে মাত্র ২০১ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম-পরিচয় আছে, খুব সংক্ষিপ্ত আকারে। এরপর ১৯৮৮ সালে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করতে শুরু করে ‘স্মৃতি : ১৯৭১’। ১৯৯৭ সালের ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বইটির দশটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। বইটা মূলত স্মৃতিচারণমূলক। কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দারের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘স্মৃতি : ১৯৭১’ বইয়ের দশটি খণ্ডে ২৩৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু এ-বইগুলোর সবগুলো তখন মুদ্রিত অবস্থায় পাওয়া যাচ্ছিল না। এর বাইরে কয়েকজন খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে বই লেখা হয়েছে, যা বাজারে পাওয়া যায়। এ অবস্থায়, পাঠাগারের সংগ্রহে থাকা বইগুলো দিয়েই আমরা কাজ শুরু করি।

এটা সবাই জানেন যে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত তাজউদ্দীন আহমদ ১৪ ডিসেম্বরকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ঘোষণা করেছিলেন। এরপর সে-বছরই সদ্য স্বাধীন দেশের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ’ পুস্তিকায় ১০৭০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর কথা বলা হয়। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ১২ শতাধিক শহীদ বুদ্ধিজীবীর কথাও এসেছে। ওই বছরই সরকারিভাবে প্রকাশিত এক স্মরণিকায় শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১১১৮ জন উল্লেখ করা হয়। এসব তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে আছেন ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ৪৯ জন চিকিৎসক, ৪২ জন আইনজীবী, ১৩ জন সাংবাদিক, এবং ৯ জন শিল্পী-সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, পাঁচ (৫) জন প্রকৌশলী এবং অন্যান্য দুই (২) জন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জহির রায়হান দেশে ফিরে এসে তাঁর ভাই শহীদুল্লা কায়সারসহ অন্যান্য শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন। প্রধানত জহির রায়হানের উদ্যোগে ১৯৭১ সালের ২৯ ডিসেম্বর বেসরকারিভাবে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। জহির রায়হান ছিলেন কমিটির চেয়ারম্যান এবং বাশারত আলী ছিলেন সদস্য সচিব। জাতীয় প্রেসক্লাবের একটা ঘরে কমিটির দফতর স্থাপন করা হয়।

এই তদন্ত কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘রাও ফরমান আলী এ দেশের বিশ হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এ পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব হয়নি। ফরমান আলীর টার্গেট ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের গভর্নর হাউসে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে হত্যা করা।’’

জহির রায়হান বলেছিলেন যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পেছনের নীল নকশা উদঘাটনসহ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বহু নথিপত্র এখন তাঁর হাতে। তিনি শিগগির তা উদঘাটন করবেন। জহির রায়হান বলেছিলেন, ‘‘এরা নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রমনস্ক বুদ্ধিজীবীদের বাছাই করে আঘাত হেনেছে।’’

কিন্তু জহির রায়হানও ভাই শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গেলেন ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি। তখন থেকে কমিটির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্তের বিষয়টিও ধামাচাপা পড়ে যায়।

এরপর বিভিন্ন সময় একাত্তরের ঘাতক-দাললদের বিচার, গণআদালাত, গণজাগরণ মঞ্চ ইত্যাদি নানা আন্দোলনের ঘটনা ঘটলেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম-তালিকা চূড়ান্ত করা কিংবা তাদেরকে নিয়ে প্রামাণ্য কোনও বই রচনা করার কাজটি হয়নি। এ বিষয়টা ভীষণ বেদনাদায়ক এবং লজ্জাজনক। অথচ দেশে তখন (২০১৭/১৮ সালে) মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসাবে পরিচিত আওয়ামী লীগ দশ বছর ধরে ক্ষমতায়। এমন পরিস্থিতিতে আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করি।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এসে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে আমরাই একটা বই প্রকাশ করব। বাংলা একাডেমির প্রকাশিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’কে ধরে আমরা কাজ শুরু করি। আমাদের প্রাথমিক ভাবনা ছিল ২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর বইটি প্রকাশ করার। কিন্তু পাঠাগারের সে আর্থিক সামর্থ্য ছিল না যে নিজেরাই বইটা প্রকাশ করি। শেষ পর্যন্ত ২০১৯ সালের একুশের বইমেলায় আগামী প্রকাশনী থেকে বইটা বের হয়।

আমাদের তথ্যের একটা বড় উৎস ছিল বিভিন্ন দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত, বিশেষত দৈনিক প্রথম আলোতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে প্রকাশিত ধারাবাহিক ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী’। কিন্তু প্রথম আলোর ওই প্রতিবেদনও পরে আর প্রকাশিত হয়নি। এছাড়া আমরা সহযোগিতা পেয়েছি ‘গুণীজন ডট ওআরজি’, বাংলাপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, ‘ইন্টেলেকচুয়ালসমার্টায়ার্স ডট কম’ ইত্যাদি ওয়েবসাইট থেকে। আমরা বুদ্ধি-পরামর্শ পেয়েছি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক স্যারের কাছ থেকে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ। সম্পাদক: আলী মো. আবু নাঈম, ফাহিমা কানিজ লাভা। প্রকাশক: আগামী প্রকাশনী।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করার পর সেগুলো যখন যাচাই করার প্রশ্ন আসল, তখনও কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজনের তথ্য আমরা ঘুরেফিরে সব জায়গায় দেখি এবং তাদের তথ্যই আমরা বেশি পেয়েছি এবং সেভাবে সন্নিবেশিত করেছি। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে যারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছেন, তাদের তথ্য তেমন না পেলেও আমরা যতটা সম্ভব চেষ্টা করেছি। কারও তথ্য বেশি না পেলেও তাদের  নাম অন্তর্ভুক্ত করেছি। যেখানে দুই রকমের তথ্য আছে সেসব ক্ষেত্রে তথ্য যাচাই করার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায় হলো পরিবারগুলোর সাথে যোগাযোগ করে তাদের কাছ থেকে নিশ্চিত হওয়া। অনেক পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার উপায় নেই, আবার কিছু পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেও কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। এভাবেই আমাদের কাজ এগিয়ে নিতে হয়েছে।

বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর কয়েকজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর পরিবার আমাদের সাথে যোগাযোগ করেছেন। তাদের অনেকের কাছ থেকে আমরা নাম প্রস্তাব পেয়েছি, কারও কাছ থেকে নতুন তথ্য যুক্ত করার প্রস্তাব পেয়েছি। শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মর্তুজার স্ত্রী সাঈদা মর্তুজা এখনও বেঁচে আছেন। তিনি তাঁর ছেলেমেয়ের সঙ্গে বিদেশে থাকেন। দেশে আসার পর আমরা যখন ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ’ নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি, তখন সাঈদা মর্তুজা আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর (প্রয়াত) কাছে আমরা যখন এ কোষগ্রন্থটি নিয়ে যাই, তিনি আমাদের বসিয়ে রেখে সময় নিয়ে বইটি দেখলেন এবং বিভিন্ন পরামর্শ দিলেন।

রাষ্ট্র ও সমাজের যারা কর্ণধাররা যে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না

‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ’ বইটা করতে গিয়ে যে বিষয়টা আমরা প্রবলভাবে বুঝতে পেরেছি সেটা হলো মুক্তিযুদ্ধ বা শহীদ বুদ্ধিজীবীদেরকে সবাই নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ বা প্রয়োজনের দিক থেকে ব্যবহার করেছে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটা জনযুদ্ধ। এ সত্যকে উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অত্যন্ত সরলরৈখিকভাবে দেখানোর একটা চেষ্টা আছে। আর মুক্তিযুদ্ধের তিরিশ লাশ শহীদ কিংবা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কোনও দলীয় ছকে ফেলা যায় না।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে অনুসন্ধান করলেই মুক্তিযুদ্ধের অনেক বাঁক, অনেক চড়াই-উৎরাই চোখে পড়ে— যা অনেকেই প্রকাশ করতে চায় না। আর অন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হলো, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জীবন ও চিন্তা বার বার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়— কেমন সমাজ ও দেশ তাঁরা চেয়েছিলেন, আর আমরা কেমন সমাজ ও দেশ নির্মাণ করেছি। আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের যারা কর্ণধার, তারা এ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চায় না।

উদাহরণ হিসাবে বহুল উচ্চারিত ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র কথাটাই ধরা যাক। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ কথাটা খুব ব্যবহার করা হয়? কিন্তু এর মানে কি? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কথাটার মানে কি পাকিস্তানি শাসকদের বদলে বাঙালি শাসক? তা তো নয়। মুক্তিযুদ্ধের আগে একটা কথা প্রবলভাবে উঠেছিল যে ‘২২ পরিবারের শাসনের অবসান চাই’। এই ২২ পরিবার মানে পাকিস্তানের ২২টা বড় পুঁজিপতি-শিল্পপতি গোষ্ঠী। মানুষ এদের শোষণের অবসান চেয়েছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হলো, ২২ পরিবারের পরিবর্তে বাংলাদেশে আরেকদল নতুন পরিবার গড়ে উঠল যাদের হাতে দেশের সম্পদ জমা হতে শুরু করল।

অক্সফামের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালে সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ বাংলাদেশি জাতীয় সম্পদের ১৬ দশমিক ৩ শতাংশের মালিক ছিলেন। আর সবচেয়ে দরিদ্র ৫০ শতাংশ মানুষের মালিকানা ছিল মাত্র ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খানার আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে বেশি ধনী ৫ শতাংশ মানুষের হাতে এখন দেশের মোট আয়ের ৩০ দশমিক ০৪ শতাংশ পুঞ্জীভূত। ক্রেডিট সুইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের দেওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে দেশে ৫০ কোটি ডলার বা ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিমাণের সম্পদ আছে ২১ ব্যক্তির কাছে।

পাকিস্তানের হাত থেকে মানুষ মুক্তি চেয়েছিল মানে তারা বৈষম্যের অবসান চেয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে কি তা হয়েছে? উপরের তথ্য বলছে যে তা হয়নি। বৈষম্যের এই চিত্র কিন্তু সমাজে, রাষ্ট্রে— সবখানেই। অর্থনৈতিক বৈষম্যের পাশাপাশি এখানে জাতিগত, লৈঙ্গিক এবং ধর্মীয় বৈষম্য ব্যাপক মাত্রায়। তাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তো বাংলাদেশ চলেনি, চলছে না। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কথা হয়, অনেক বিতর্ক হয়, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে কিভাবে সাধারণ মানুষ, ৮০ ভাগ মানুষের স্বার্থে পরিচালিত হবে তা আলোচিত হয় না।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যখন আমরা স্মরণ করি, তখন তাদের নানা লেখা ও চিন্তা আমাদের এসব প্রশ্নের মুখোমুখি করে। তাঁদের লেখা, তাঁদের জীবন আমাদের সামনে গণতান্ত্রিক চেতনা, পরমতসহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের, সমাজের জন্যে, মানবজাতির মুক্তির জন্যে সংগ্রামের শিক্ষা দেয়। এখানেই আমাদের কাছে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রয়োজনীয়তা।

‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ’ বইটা আসলে একেবারেই প্রাথমিক কাজ। আরও অনেক কাজ এখনও বাকি। বিদ্বৎসমাজ, গবেষক, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্য এবং পাঠকদের মতামত-পরামর্শের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে এই বইটিকে আরো সমৃদ্ধ এবং নির্ভুল করার ইচ্ছা আছে।

লেখক: শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি পাঠাগারের সংগঠক।
ইমেইল: nayeem.mb.76@gmail.com

ad

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত