Beta
শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১২ জুলাই, ২০২৫

ঘূর্ণি হাওয়ায় গোত্তা খাচ্ছে সংস্কারের ঘুড়ি

‘সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ’ বাতিলের দাবিতে ‘বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরাম’ ব্যানারে চলছে আন্দোলন।
‘সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ’ বাতিলের দাবিতে ‘বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরাম’ ব্যানারে চলছে আন্দোলন।
[publishpress_authors_box]

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারের যে ঘুড়ি উড়িয়েছে, তা টলমলো এখন ঘূর্ণি বাতাসে।  

সংস্কার কমিশনগুলো তাদের সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর এগুলো নিয়ে ওঠে আপত্তি। সুপারিশ বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে ধাক্কা খাচ্ছে সরকার।

সুপািরশ মেনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে অধ্যাদেশ জারির পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরোধিতায় অচল হয়ে পড়ে রাজস্ব আদায়ের সরকারি সংস্থাটি। তাদের দাবির মুখে পিছু হটে অর্থ উপদেষ্টাকে এই অধ্যাদেশ সংশোধনে রাজি হতে হয়েছে।

একইভাবে সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ জারির পর তাও পড়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরোধিতায়। তাতে তিন দিন ধরে অচল হয়ে আছে জনপ্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়। সেই আন্দোলন এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে।

‘ধ্বংস’ হয়ে যাওয়া দেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে জুলাই অভ্যুত্থান ‘মহাসুযোগ’ এনে দিয়েছে মন্তব্য করে সেই লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার কথা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলার মধ্যেই এই অস্থিরতা চলছে।

অভ্যুত্থানে গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের তিন দিন পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নিয়ে ড. ইউনূস বলেছিলেন, “তারা (ছাত্ররা) এই দেশকে রক্ষা করেছে এবং পুনর্জন্ম দিয়েছে। এখন আমাদের ব্রত হল নতুন বাংলাদেশকে দ্রুত এগিয়ে নেওয়া।”

‘রাষ্ট্র সংস্কারে’ এগিয়ে যাওয়ার সেই প্রক্রিয়ায় এক মাস পর ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করেন তিনি। সেগুলো হলো- নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুদক সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও সংবিধান সংস্কার কমিশন।

প্রথম গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যানদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

এরপর গণমাধ্যম, স্বাস্থ্য, শ্রম, নারী বিষয়ক এবং স্থানীয় সরকার সংস্কারে আরও পাঁচটি কমিশন গঠন করা হয়।

সংস্কার কমিশনগুলো এরই মধ্যে প্রতিবেদন দিয়েছে। তাদের সুপারিশের প্রশংসা করে আশু বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের নির্দেশও দেন ড. ইউনূস।

এরমধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশনের বিভিন্ন সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দল ও আইনজ্ঞদের মধ্য থেকে আপত্তি এসেছে। নির্বাচনী সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে আপত্তি তুলেছে খোদ নির্বাচন কমিশন।

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিরোধিতায় সরব হয়েছে ইসলামী দলগুলো। তারা এই কমিশন বাতিল করে দিতে চাপ দিচ্ছে।

নারী কমিশনের সুপারিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট আবেদনও হয় আদালতে। তবে সোমবার তা খারিজ করে দিয়ে হাই কোর্ট বলেছে, যেহেতু কমিশনের সুপারিশ সরকার এখনও বাস্তবায়ন করেনি। তাই আবেদনের কোনও যৌক্তিকতা নেই।

কিন্তু সংস্কারের যে দুই সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে এগিয়েছে সরকার; তার দুটোই পড়েছে বাধার মুখে এবং তা সরকারি কর্মচারীদের মধ্য থেকেই।

অচল সচিবালয়, আন্দোলন ছড়াচ্ছে

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপাররিশ অনুসরণে গত বৃহস্পতিবার অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’ সংশোধন করে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ এর খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়।

তানিয়ে কর্মচারীদের অসন্তোষের মধ্যে রবিবার অধ্যাদেশ জারি করা হয়। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে ‘বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরাম’ গঠন করে আন্দোলনে নেমে পড়েছেন সরকারি চাকুরেরা।

বর্তমানে বাংলাদেশে ১৫ লাখের মতো সরকারি কর্মচারী আছেন। সচিবালয়ে টানা তিন দিনের আন্দোলনের পর মঙ্গলবার থেকে সারাদেশে কর্মচারীদের আন্দোলনে নামতে ডাক দেওয়া হয়েছে।

কর্মচারীদের অভিযোগ, সাড়ে চার দশক আগের বিশেষ বিধানের কিছু ‘নিবর্তনমূলক ধারা’ সংযোজন করে অধ্যাদেশটি করা হয়েছে।

অধ্যাদেশে সরকারি কর্মচারীদের চারটি বিষয়কে অপরাধের আওতাভুক্ত করা হয়। তার মধ্যে রয়েছে- সরকারি কর্মচারী যদি এমন কোনও কাজে লিপ্ত হন, যা অনানুগত্যের শামিল বা যা অন্য যেকোনো সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে, কাউকে কাজ করতে বাধা দেওয়া, ছুটি ছাড়া বা যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকা, অন্য কাউকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে উসকানি দেওয়া ইত্যাদি।

উপদেষ্টা পরিষদে অধ্যাদেশ অনুমোদনের পর থেকেই ক্ষোভ-বিক্ষোভ জানিয়ে আসছিল সচিবালয়ের সরকারি কর্মচারীরা। অধ্যাদেশ জারির পর তা প্রত্যাহারের দাবিতে সোমবার টানা তৃতীয় সচিবালয়ের ভেতর বিক্ষোভ চলে।

মঙ্গলবা আবারও বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি দিয়ে একই ধরনের কর্মসূচি সারা দেশের সরকারি দপ্তরের পালনের জন্য কর্মচারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ‘বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরাম’।

ফোরামের কো চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের একাংশের সভাপতি মো. বদিউল কবীর সমাবেশে বলেন, “কর্মসূচি ততক্ষণ পর্যন্ত চলমান থাকবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত এই কালো আইন বা অধ্যাদেশ সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার না করা হবে।”

ঐক্য ফোরামের কো চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের আরেকাংশের সভাপতি মুহা. নূরুল ইসলাম বলেন, সারাদেশের কর্মচারীরা তাদের আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন।

আন্দোলনের মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী রবিবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে আইনটি সংশোধন করেছিল। এখন আইনটি আগের মতোই করা হয়েছে।

তারপরও কর্মচারীদের আপত্তি থাকলে আলোচনার মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা রাখেন উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর।

সোমবার আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের সঙ্গে সচিবালয়ের কর্মচারীদের বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও তার ব্যস্ততার কারণে হয়নি।

এনবিআরে পিছু হটা

কর কাঠামো সংস্কারের অংশ হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করে দুই স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে গত ১২ মে অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। তাতে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে দুটি বিভাগ চালু করা হয়।

ওই অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’ নামে প্রথমে আন্দোলনে নামে এনবিআরের কর্মচারীরা। এরপর ঢাকা কাস্টম হাউস, চট্টগ্রাম বন্দর, বেনাপোল, ভোমরা স্থলবন্দরসহ দেশের অন্যান্য শুল্ক স্টেশনেও শুরু হয় আন্দোলন।

তাদের কয়েকদিনের কর্মবিরতিতে শুল্ক-কর কার্যালয়গুলো অচল হয়ে পড়ে। অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ এক দফা বৈঠক করলেও অধ্যাদেশের বাতিল না করার পক্ষে অবস্থান জানালে এনবিআর কর্মচারীরাও আন্দোলনে অটল থাকে।

শেষে রবিবার বিকালে অর্থ মন্ত্রণালয় জানায়, আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এনবিআর নিয়ে জারি করা অধ্যাদেশের প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে। তার আগ পর্যন্ত অধ্যাদেশ স্থগিত থাকবে।

এরপর সোমবার কাজে ফিরলেও পুরোপুরি শান্ত হয়নি রাজস্ব দপ্তর। এদিন সংবাদ সম্মেলন করে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’র নেতারা তাদের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের অপসারণ দাবি করে।

আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে তাকে অপসারণের সময় বেঁধে দিয়ে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে এনবিআর চেয়ারম্যানকে লাগাতার অসহযোগিতা করার কর্মসূচি ডাকা হয়েছে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত