Beta
মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫
Beta
মঙ্গলবার, ১৩ মে, ২০২৫

ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার আকারে ছাড়িয়েছে আগের সব ক’টিকে

শপথ নিচ্ছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি : সকাল সন্ধ্যা
গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
[publishpress_authors_box]

গণআন্দোলনে এইচ এম এরশাদের পতনের পর প্রথম অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেখেছিল বাংলাদেশ; তার তিন দশকের বেশি সময় পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিরার পতনের পর সেই ধরনের আরেকটি সরকার গঠিত হলো।

এই সময়কালের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামে আরও চারটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল। তবে সরকারের আকারের দিক থেকে এবারেরটিই সবচেয়ে বড়।

১৯৯০ সালে অন্তর্বর্তীকালীন বা অস্থায়ী সরকারে সদস্য সংখ্যা ছিল ১৮। এরপর ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল ১১ জনকে নিয়ে। ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্যও ছিল ১১ জন।

২০০৬ ও ২০০৭ সালে পরপর দুটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল। প্রথমটির সদস্য সংখ্যা ছিল ১১; পরেরটিতে ছিল ১৫ জন।

এবার ড. ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্য সংখ্যা ২১ জনে গিয়ে ঠেকেছে। শুরুতে ১৭ জনকে নিয়ে গঠিত হলেও শুক্রবার আরও চারজন শপখ নেন।   

ফলে এই পর্যন্ত গঠিত ছয়টি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে সদস্য সংখ্যার ভিত্তিতে ১৯৯০ সালে গঠিত বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সরকারকে ছাড়িয়ে গেছে ড. ইউনূসের সরকার।

আন্দোলনে সরকার পতনের পর ১৯৯০ সালে বিশেষ পরিস্থিতিতে অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছিল। তাদের দায়িত্বই ছিল নির্বাচন করা। তা করে কয়েক মাসের মধ্যে তারা দায়িত্ব হস্তান্তর করে।

এরপর ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধকায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল সংবিধান সংশোধনের পর তার আলোকে। সংবিধানেই ওই সরকারের মেয়াদ তিন মাস ঠিক করে দেওয়া ছিল।

১৯৯৬, ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাস মেয়াদের মধ্যে নির্বাচন করে ক্ষমতা ছেড়ে দেয় নির্বাচিত সরকারের কাছে।

২০০৬ সালে রাজনৈতিক বিরোধের ধাক্কা লাগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে। প্রথমে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলেও তা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি সব দলের কাছে। সেই সরকারের চারজন উপদেষ্টা পদত্যাগও করেন।

এরপর ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারির পর নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। সেই সরকার দুই বছর দায়িত্ব পালন করে। তারপর নির্বাচন দিয়ে সরে গিয়েছিল।

এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিই বাতিল করে দেয়। দেড় দশক পর আন্দোলনের মুখে সরকারের পতন ঘটলে দেখা দেয় শূন্যতা।

বিশেষ এই পরিস্থিতিতে আন্দোলনে নেতৃতব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রস্তাবে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার পর গঠিতটি বাদে অন্য সব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই নির্বাচন আয়োজন করে কয়েক মাসের মধ্যে বিদায় নিয়েছিল।

ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন সরকার ব্যতিক্রম হিসাবে দুই বছর ছিল, তারা নির্বাচনী আইন, রাজনতিক দল পরিচালনার আইনের কিছু সংস্কার এনেছিল।

ড. ইউনূসের এবারের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কত দিন থাকবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে উপদেষ্টার কথায় ধারণা পাওয়া যাচ্ছে, এই সরকার বেশ কিছুদিনই থাকবে।

বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের সরকার

সাহাবুদ্দীন আহমদ

গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গঠিত হয়েছিল বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অস্থায়ী সরকার।

সেই সরকারে রাষ্ট্রপতি ছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। উপদেষ্টা হিসাবে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন ১৭ জন।

তারা হলেন- বিচারপতি এম এ খালেক, কফিলউদ্দিন মাহমুদ, ফখরুদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক রেহমান সোবহান, অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক ইয়াজউদ্দীন আহম্মেদ, আলমগীর এম এ কবীর, এ কে এম মুসা, ডা. এম এ মাজেদ, অবসরপ্রাপ্ত মেজর রফিকুল ইসলাম, এ বি এম জি কিবরিয়া, কাজী ফজলুর রহমান, ইমাম উদ্দিন আহমদ চৌধুরী; বি কে দাস, এ এম আনিসুজ্জামান, চৌধুরী এম এ আমিনুল হক।

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এই সরকার পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার পর নতুন সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে।

বিচারপতি হাবিবুর রহমানের সরকার

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান

স্বল্প মেয়াদী ষষ্ঠ সংসদ সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যোগ করার পর তার অধীনে ১৯৯৬ সালের ৩ এপ্রিল বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন আবদুর রহমান বিশ্বাস। প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে সরকার প্রধানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন হাবিবুর রহমান।

১০ জন উপদেষ্টা ছিলেন সেই সরকারে । তারা হলেন- ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, ড. মুহাম্মদ ইউনূস, অধ্যাপক মো. শামসুল হক, সেগুফতা বখত চৌধুরী, এ জেড এম নাছিরুদ্দীন, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুর রহমান খান, অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, ড. নাজমা চৌধুরী, ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী।

১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠিত হলে হাবিবুর রহমানের সেই সরকার দায়িত্ব হস্তান্তর করে।

বিচারপতি লতিফুর রহমানের সরকার

লতিফুর রহমান

বিচারপতি লতিফুর রহমান নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার শপথ নেয় ২০০১ সালের ১৫ জুলাই। তখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ।

সেই সরকারে ১০ জন উপদেষ্টা ছিলেন। তারা হলেন- ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, বিচারপতি বিমলেন্দু বিকাশ রায় চৌধুরী, সাবেক আইজপি এ এস এম শাহজাহান, সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, এ কে এম আমানুল ইসলাম চৌধুরী, এম হাফিজ উদ্দিন খান, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অধ্যাপক আবদুল মালেক, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী, রোকেয়া আফজাল রহমান।

২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এই সরকার নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা ছেড়ে বিদায় নেয়।

ইয়াজউদ্দিনের সরকার

২০০৬ সালের অক্টোবরে বিএনপি বিদায় নেওয়ার পর সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতি কে এম হাসানকে প্রধান করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাকে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় আওয়ামী লীগ।

কে এম হাসান তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানালে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন আহম্মেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন।

ইয়াজউদ্দীন আহম্মেদ

সেই সরকারে উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করে মোট ১৪ জন। তবে মাঝে চারজন পদত্যাগ করলে নতুন চারজন আসে। একসঙ্গে ১০ জনের বেশি ছিল না।

শুরুতে উপদেষ্টা ছিলেন- বিচারপতি ফজলুল হক, ড. আকবর আলি খান, সাবেক সেনাপ্রধান হাসান মশহুদ চৌধুরী, সি এম শফি সামী, আজিজুল হক, ধীরাজ কুমার নাথ, সাংবাদিক মাহবুবুল আলম, সুফিয়া রহমান, ইয়াসমিন মুরশিদ, অধিকারকর্মী সুলতানা কামাল।

মাসখানেক পর পদত্যাগ করেন আকবর আলি খান, হাসান মশহুদ চৌধুরী, সি এম শফি সামী ও সুলতানা কামাল। তখন সফিকুল হক চৌধুরী, অধ্যাপক এম মইনউদ্দিন খান, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রুহুল আমিন চৌধুরী ও ড. শোয়েব আহমেদকে উপদেষ্টা করা হয়।

এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঠিক করেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মতানৈক্য না হওয়ায় পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে গড়ালে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি নির্বাচন স্থগিত করে জরুরি অবস্থা জারি করেন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন। তিনি প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়ালে সেই সরকারের অবসান ঘটে।

ফখরুদ্দীনের সরকার

ফখরুদ্দীন আহমদ

জরুরি অবস্থা জারির পর ইয়াজউদ্দীন আহম্মেদ রাষ্ট্রপতির পদে থেকে যান। সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদকে প্রধান উপদেষ্টা করে নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয় ২০০৭ সালের ১২ জানুয়ারি।

দুই বছর দায়িত্ব পালনের সময় এই সরকারে মোট ১৫ জন উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেন। তারা হলেন- ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এম এ মতিন, তপন চৌধুরী, গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মতিউর রহমান, আইয়ুব কাদরী, আনোয়ারুল ইকবাল, ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী, ড. চৌধুরী সাজ্জাদুল করিম (সি এস করিম), ড. এ এম এম শওকত আলী, এ এফ হাসান আরিফ, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল গোলাম কাদের, রাশেদা কে চৌধুরী, ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।

তাদের মধ্যে আইয়ুব কাদরী মাঝ পর্যায়ে পদত্যাগ করেন।

২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব দিয়ে বিদায় নেয় সেনা সমর্থিত এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

ইউনূসের সরকার

ড. ইউনূসের নেতৃত্বে ২০২৪ সালের ৮ আগস্ট গঠিত হয় নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাদের শপথ পড়ান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।

তার সরকারের উপদেষ্টারা হলেন- অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, সাবেক সচিব মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, অধিকারকর্মী আদিলুর রহমান খান, আইনজীবী এ এফ হাসান আরিফ, সাবেক সচিব মো. তৌহিদ হোসেন, পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, শারমিন এস মুরশিদ, ফারুক–ই–আজম বীরপ্রতীক, সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন, সুপ্রদীপ চাকমা, ডা. বিধান রঞ্জন রায়, হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির আ ফ ম খালিদ হোসেন, ফরিদা আখতার, নুরজাহান বেগম, মো. নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।

গত ৮ আগস্ট ড. ইউনূসের সঙ্গে শপথ নিয়েছিলেন ১৪ উপদেষ্টা। এরপর ১১ আগস্ট দুজন এবং ১৩ আগস্ট একজন শপথ নেন।

১৬ আগস্ট আরও চারজন শপথ নিলে উপদেষ্টা পরিষদে সদস্য সংখ্যা ২১ জনে গিয়ে ঠেকে।

নতুন সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন তিনটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হয়ে রেকর্ড গড়লেন। তিনি ১৯৯০, ১৯৯৬ সালের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেও ছিলেন। কয়েকজন দুই বার উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করলেও এ দায়িত্বে তিনবার কেউ আসেননি।   

এবারে ওয়াহিদ উদ্দিনের সঙ্গে থাকা এ এফ হাসান আরিফও দুই বার উপদেষ্টা হলেন। তিনি এর আগে ফখরুদ্দীনের সরকারে ছিলেন।

এবারের প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস ১৯৯৬ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে উপদেষ্টা ছিলেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত