জুলাই আন্দোলনের মধ্যে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যেখানে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে।
চেয়ারম্যান হিসাবে পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে নেতৃত্ব দেবেন হাইকোর্টের বিচারক গোলাম মর্তুজা মজুমদার। সদস্য থাকছেন হাইকোর্টের আরেক বিচারক শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সোমবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের কথা জানিয়ে বলেন, একটা ‘বিগ নিউজ’ তিনি দিলেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিচার বিভাগে পরিবর্তনের ধারায় গত ৮ অক্টোবর হাইকোর্ট বিভাগে যে নতুন ২১ জন অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়, তাদের দুজন হলেন বিচারপতি গোলাম মর্তুজা ও বিচারপতি শফিউল আলম।
ফেনীর ফুলগাজীর বাসিন্দা বিচারপতি গোলাম মর্তুজা পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে। ১৯৯৩ সালে তিনি বিচারক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করে ২০১৯ সালে জেলা ও দায়রা জজ হিসাবে অবসরে যান।
অবসর থেকে হাইকোর্টে ফেরার এক সপ্তাহ পরই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে পেলেন তিনি।
ট্রাইব্যুনাল গঠনে কেন দেরি
দায়িত্ব নেওয়ার পরের মাসে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন বিভাগ এবং তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করলেও বিচারক নিয়োগ হচ্ছিল না।
এই দেরির কারণ ব্যাখ্যা করে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, “অনেকের অপেক্ষা ছিল, অনেকের প্রশ্ন ছিল, আন্তর্জাতিক আদালত গঠিত হচ্ছে না কেন?
“আসলে এটা গঠিত হচ্ছিল না, কারণ আমরা বিচারপতি পাচ্ছিলাম না। হাইকোর্ট থেকে এখানে (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল)…… সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে এটা নিয়োগ করতে হয়। সুপ্রিম কোর্টে পর্যাপ্ত বিচারপতি ছিলেন না বা অন্য কোনও কারণে আমরা পাচ্ছিলাম ( বিচারক) না।”
হাইকোর্ট বিভাগে নতুন বিচারক নিয়োগ ট্রাইব্যুনাল গঠনের কাজ সহজ করে দিয়েছে জানিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, “হাইকোর্ট বিভাগে নতুন বিচারপতি নিয়োগ হবার পরবর্তী সময়ে তাৎক্ষণিকভাবে মানে খুব অল্প দিন বোধহয় দুইদিন আগে বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে আমরা সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে হাইকোর্টের দুইজন বিচারক এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা এবং দায়রা জজকে নিয়ে মানবতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধবিরোধী ট্রাইব্যুনাল গঠনের কাজ আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যা করার ছিল সম্পন্ন করা হয়েছে।”
এখন ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা যদি বাড়াতে হয় কিংবা প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থায় লোকবল যদি আরও প্রয়োজন হয়, তবে পরিস্থিতি দেখে সেটাও করা হবে বলে জানান তিনি।
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল হাইকোর্ট বিভাগের তিন বিচারককে নিয়ে।
তদন্ত শেষে বিচারে আসা মামলার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় দুই বছর পর ২০১২ সালের ২২ মার্চ আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। দুজন বিচারপতির নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ নাম নিয়ে কাজ চলছিল তখন।
অনেকগুলো মামলার রায় হয়ে যাওয়ায় ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটি ট্রাইব্যুনালকে একীভূত করে পুনরায় একটি করা হয়।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা তদন্তে
ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনের সরকারি অভিযানে গত ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও অপরাধের ঘটনার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এই আন্দোলনে কয়েকশ মানুষ নিহত হন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের খসড়া হিসাবে নিহতের সংখ্যা ৭ শতাধিক। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দেড় সহস্রাধিক নিহতের হিসাব করেছে।
হতাহতের ঘটনাগুলোতে গণহত্যার অভিযোগ এনে মামলা হয়েছে। এসব মামলার অধিকাংশগুলোতে ক্ষমতা ছেড়ে দেশছাড়া হওয়া শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার উপ পরিচালক (প্রশাসন) মো. আতাউর রহমান গত মাসেই জানিয়েছিলেন, তারা তদন্ত কাজ শুরু করেছেন।
জুলাই-আগস্টের ৩৬ দিনে কোন কোন স্থানে গণহত্যা হয়েছে, সেই স্থানগুলো দেখা; কারা আহত-নিহত হয়েছে, তাদের তথ্য সংগ্রহ করা; কারা দায়ী, তাদের চিহ্নিত করার কাজটি করছে তদন্ত সংস্থা।
“এইসব কাজগুলো করে আমরা তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রসিকিউশন বরাবর দাখিল করব। তারপর ট্রাইব্যুনাল ফাংশন শুরু করলে বিচার শুরু হবে,” বলেছিলেন তিনি।
এই ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর হিসাবে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়োগ দিয়েছে অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামকে, যিনি আগে এই ট্রাইব্যুনালেই একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের জন্য দণ্ডিত জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের আইনজীবী ছিলেন।
ট্রাইব্যুনাল গঠনের খবর জানিয়ে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “এই বিচারকার্যের প্রাথমিক যে ‘প্রি ট্রায়াল’ স্টেজ যেটা, যেখানে ইনভেস্টিগেশন করতে হয়, আলামত সংগ্রহ করতে হয়, সেটার কাজ আমাদের অত্যন্ত দক্ষ প্রসিকিউশন এবং ইনভেস্টিগেশন টিম ইতোমধ্যেই শুরু করেছে।
“এই বিচারের সবচেয়ে শক্তিশালী ফোরাম আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, সেটা ‘অ্যাক্টিভিটেড’ হয়ে যাবে আর দুই-একদিনের মধ্যে।”
পিপি-জিপি নিয়োগ চলছে
জেলা ও মহানগর আদালতগুলোতে সরকারি আইন কর্মকর্তা নিয়োগের কাজটিও এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
এসব আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের মামলা পরিচালনা করে থাকেন পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি), সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি), জেনারেল প্রসিকিউটর (জিপি) ও সহকারী জেনারেল প্রসিকিউটর (এজিপি)।
সরকার পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া এই আইন কর্মকর্তারা অনেকেই পদত্যাগ করেন। তবে অন্তর্বর্তী সরকার এখনও সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে পারেনি।
এই কারণে মামলা পরিচালনায় জটিলতা হচ্ছে স্বীকার করে উপদেষ্টা বলেন, “নিম্ন আদালতে অনেক মামলার কাজ ব্যাহত হচ্ছিল, পিপি, অ্যাডিশনাল পিপি ছিল না। ৫ আগস্টের পর দুই-একজন ছাড়া তাদের অধিকাংশ পালিয়ে গেছেন অথবা আত্মগোপন করেছেন। কেন করেছেন আপনারা বুঝতেই পারছেন।”
সরকারি এই আইন কর্মকর্তার সংখ্যা সাড়ে ৪ হাজার উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংখ্যাটি বিপুল হওয়ায় নিয়োগ দিতেও সময় লাগছে।
“সাড়ে চার হাজার সরকারি আইনজীবী নিয়োগ করার জন্য আমাদের কাছে আবেদন এসেছে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার। একটা মন্ত্রণালয় থেকে এগুলো স্ক্রুটিনি (যাচাই-বাছাই) করে সাড়ে চার হাজার বাছাই করা…বিভিন্ন তথ্য নিয়ে, এটা যে কী পরিশ্রম গেছে আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের …সন্ধ্যা ৭টা-৮টা পর্যন্ত কাজ হয়েছে, কখনও শনিবার কাজ হয়েছে, শুক্রবারও কাজ হয়েছে।”
“যথেষ্ট দ্রুত কাজ করছি। আজকেই আমি ঢাকা জেলার সরকারি কৌঁসুলি যারা আছেন, তাদের নিয়োগের কাগজে স্বাক্ষর করেছি,” বলেন আসিফ নজরুল।