পণ্য নিয়ে একটি জাহাজ বাংলাদেশে এসেছে সরাসরি পাকিস্তান থেকে। তা নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা। কারণ ১৯৭১ সালের পর এই প্রথম করাচি থেকে কোনও জাহাজ সরাসরি ভিড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে।
জাহাজের সরাসরি এই চলাচল পণ্য বাণিজ্য ছাপিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্কের নতুন সূচনা হিসাবে দেখছে পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম। ভারতের সংবাদমাধ্যমে এই খবর এসেছে উদ্বেগের সংমিশ্রণে।
অন্য দেশগুলোর সংবাদমাধ্যমে এই খবরটি এসেছে বাংলাদেশ-পাকিস্তান কূটনৈতিক সম্পর্কের পালাবদলের দৃষ্টিতে।
দীর্ঘ শোষণ-বঞ্চনার অবসানে নয় মাসের রক্তাক্ত যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন দেশ হিসাবে বিশ্বের মানচিত্রে ঠাঁই নেয় বাংলাদেশ।
তারপর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক টানাপড়েনের মধ্য দিয়েই গড়িয়েছে। গত দেড় দশকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগের শাসনকালে সেই সম্পর্ক নাজুক হয়ে পড়েছিল।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব আসা নাহিদ ইসলামের সঙ্গে গত সেপ্টেম্বরে দেখা করে ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার সৈয়দ আহমদ মারুফ বলেন, একাত্তর প্রশ্নের মীমাংসা করে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী।
জবাবে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদও সম্মতির সুরে বলেন, সরকারও পাকিস্তানের সঙ্গে একাত্তর প্রশ্নটির সমাধান করতে চায়। সেই সঙ্গে একটি গণতান্ত্রিক দক্ষিণ এশিয়ার জন্য পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করা প্রয়োজন।
এরপর নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকেও সম্প্রীতির বার্তা আসে।
তবে দেশে ফিরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্ন বাদ রেখে সম্পর্কোন্নয়নের কোনও বার্তা পাকিস্তানকে দেওয়া হয়নি।
আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বদাতারা ‘রিসেট বাটন’ চেপে দিয়েছে বলে ড. ইউনূসের দেড় মাস আগের বক্তব্য আবার সামনে আসছে পাকিস্তান থেকে সরাসরি জাহাজ আসার পর।
পাকিস্তানের চোখে ইতিবাচক কূটনীতি
বাংলাদেশের বন্দরে করাচি থেকে জাহাজ ভেড়ার তথ্যটি পাকিস্তান হাইকমিশন গত বুধবার তাদের ফেইসবুক পাতায় পোস্ট দিয়ে জানিয়েছিল।
সেই পোস্টে বলা হয়, করাচি থেকে একটি কার্গো ভেসেল চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়েছে, যার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে এই প্রথম সরাসরি সামুদ্রিক সংযোগ স্থাপিত হলো।
দুই দেশের সরাসরি পণ্য আনা-নেওয়ার যে চাহিদা তৈরি হয়েছে, তা এর মাধ্যমে ফুটে উঠেছে বলে সেই পোস্টে মন্তব্য করা হয়।
এটাকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক সর্ম্পক বাড়ানোর ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ বলেও মন্তব্য করেন হাই কমিশনার সৈয়দ মারুফ।
তিনি বলেন, “এ উদ্যোগ শুধু বিদ্যমান বাণিজ্যই বাড়াবে না, ক্ষুদ্র থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ীদের ব্যবসা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে নতুন সুযোগ তৈরি করবে।”
পাকিস্তানের সংবাদপত্র দ্য নিউজ এই সংবাদ দেওয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, এটা দুই দেশের সম্পর্ক পুনর্নির্মাণে একটি ইতিবাচক অগ্রগতি।
ভারতের উদ্বেগ কোথায়
অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভারতের আশ্রয় দেওয়াকে কেন্দ্র করে নয়া দিল্লির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে। এরমধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সরাসরি জাহাজ চলাচলকে ভারতের সংবাদ মাধ্যম দেখছে সন্দেহের চোখে।
কলকাতার বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা এই খবরের শিরোনাম করেছে- ‘পাকিস্তানের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ছেন ইউনূস, চট্টগ্রাম-করাচি সরাসরি জাহাজ চলাচল চালু’।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “পালাবদলের বাংলাদেশ এ বার পাকিস্তানের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্রিয় হলো।
“শেখ হাসিনার সরকারের আমলে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ বাংলাদেশের সরকারি নীতির একাধিক ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাক সেনার অত্যাচার, গণধর্ষণ, হত্যালীলার কথা বারে বারে প্রকাশ্যেই বলেছে ঢাকা। কিন্তু গত ৫ আগস্ট গণবিক্ষোভের জেরে হাসিনার প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা এবং ভারতে চলে আসার পরে অনেক কাছাকাছি এসেছে ইসলামাবাদ-ঢাকা।”
অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে এক সভা থেকে পাকিস্তানের জাতির জনক মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে বাংলাদেশেরও জাতির পিতা করার দাবি ওঠার বিষয়টি তুলে ধরে আনন্দবাজার লিখেছে, “এবার সেই নৈকট্যের প্রতিফলন দেখা গেল নৌবাণিজ্যে।”
ভারতের সংবাদপত্র দ্য টেলিগ্রাফ লিখেছে, বাংলাদেশের বন্দরে পাকিস্তান থেকে সরাসরি জাহাজ ভেড়া ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসাবে দেখছেন নয়া দিল্লির বিশেষজ্ঞরা।
ভারতের দুই পাশের দুই প্রতিবেশী দেশের সরাসরি নৌ যোগাযোগ দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে বলে ভারতের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা।
একজন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ টেলিগ্রাফকে বলেন, “বাংলাদেশের প্রধান দুটি সমুদ্রবন্দর, চট্টগ্রাম ও মোংলা। এতদিন পাকিস্তান থেকে জাহাজ সরাসরি এই দুই বন্দরে ভিড়তে পারত না। সিঙ্গাপুর কিংবা কলম্বো হয়ে চলত পণ্য আনা-নেওয়া।
“এখন পাকিস্তানের জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ার সুযোগ পেলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অবৈধ সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”
এই প্রসঙ্গে ২০০৪ সালে উলফা বিদ্রোহীদের জন্য চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র খালাসের কথা বলেন ওই বিশেষজ্ঞ, যার নাম প্রকাশ করেনি টেলিগ্রাফ।
আরেক বিশেষজ্ঞ বলেন, “ড. ইউনূস ক্ষমতায় বসার পর বাংলাদেশ ‘রিসেট মোড’ এ রয়েছে, এখন এই পদক্ষেপে দেখা যাচ্ছে, তারা ভারতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ হতে চাইছে।”
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার শাসনামলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া এবং তা নিয়ে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়ার বিষয়গুলো তুলে ধরে বলা হয়েছে, জাহাজ চলাচলের এই ঘটনাটি দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে দুর্বল সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিতে পারে।
বর্তমান অবস্থা বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ হাত প্রসারিত করার জন্য পাকিস্তানের পক্ষে আদর্শ পরিস্থিতি গড়ে তুলেছে, বলছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস।
অন্যরা দেখছে যে চোখে
পাকিস্তান থেকে সরাসরি বাংলাদেশে জাহাজ ভেড়ার এই খবর চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়াও প্রকাশ করেছে।
তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আনাদোলু নিউজ সংবাদটির শিরোনাম করেছে- ‘সম্পর্ক ভাঙার পর এই প্রথম সরাসরি সামুদ্রিক যোগাযোগ স্থাপন করল পাকিস্তান ও বাংলাদেশ’।
যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্র দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট তাদের প্রতিবেদনে দেখাতে চেয়েছে, কেন পাকিস্তান থেকে সরাসরি বাংলাদেশে একটি জাহাজ আসাকে ঐতিহাসিক বলা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সম্পর্কের পূর্বাপর তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কের দীর্ঘ জটিলতা পেরিয়ে ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে সরাসরি জাহাজ চলাচল।
ড. ইউনূসের সঙ্গে নিউ ইয়র্কে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের বৈঠকের বিষয়টিও তুলে ধরেছে ইন্ডিপেন্ডেন্ট।
তাদের প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার পররাষ্ট্র নীতি থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মোড় বদলের ইঙ্গিত পাওয়ার কথা বলা হয়।
যুক্তরাজ্যের দৈনিকটি শেখ হাসিনার শাসনকালে ২০২২ সালে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর ফ্রিগেট পিএনএন তৈমুরকে চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ার অনুমতি না দেওয়ার তথ্যটি উল্লেখ করা হয়।
চীনের তৈরি ওই যুদ্ধ জাহাজটি ক্যাম্বোডিয়া ও মালয়েশিয়ার নৌবাহিনীর সঙ্গে এক যৌথ মহড়ায় যাচ্ছিল। বাংলাদেশ অনুমতি না দেওয়ার পর সেটি শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে ভিড়েছিল।
বাণিজ্য কতটুকু
পণ্যভরতি ২৭০টি কন্টেইনার নিয়ে করাচি থেকে রওনা হয়ে গত সোমবার চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ে পানামার পতাকাবাহী জাহাজ ‘ইউয়ান শিয়াং ফা ঝাং’। জাহাজটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই থেকে করাচি হয়ে বাংলাদেশে আসে।
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুক সাংবাদিকদের জানান, ১৮০ মিটার দৈর্ঘ্যের ও ৩০ মিটার প্রস্থের জাহাজটি কন্টেইনার খালাসের পর মঙ্গলবার ইন্দোনেশিয়ার পথে ছেড়ে যায়।
ইন্দোনেশিয়ার পথে চলা পণ্যবাহী জাহাজটির শনিবার অবস্থান ছিল থাইল্যান্ডে।
‘ইউয়ান শিয়াং ফা ঝাং’ এর স্থানীয় শিপিং এজেন্ট রিজেন্সা লাইন্স লিমিটেড জানিয়েছে, জাহাজটি করাচি থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে এসে ৩৭০ টিইইউ কন্টেইনার খালাস এবং রপ্তানি পণ্যবাহী ৩১৯ টিইইউ কন্টেইনার বোঝাই করে।
সাধারণত পাকিস্তান থেকে সুতা, কাপড়ের রং, ইলেকট্রিক পণ্য, ফল সমুদ্রপথে আমদানি হয়ে থাকে। এই জাহাজে কী পণ্য এসেছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের পণ্য বাণিজ্য এখনও সরাসরি জাহাজ চলাচলের জন্য অবস্থায় যায়নি বলে মত জানাচ্ছে দেশের ব্যবসায়ীরা।
দৈনিক প্রথম আলো ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের চিত্র তুলে ধরে বলেছে, এই সময়ে পাকিস্তান থেকে আমদানি হয়েছে ৭৪ কোটি ৪৫ লাখ ডলারের পণ্য। এর মধ্যে রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল সুতা-কাপড় ও প্রস্তুত চামড়া ছিল ৭৯ শতাংশ বা ৫৯ কোটি ডলার। এছাড়া সিমেন্টশিল্পের কাঁচামাল ক্লিংকার, ফল, শুঁটকি ও মেয়েদের থ্রি–পিস আমদানি হয়েছে।
আবার একই সময়ে পাকিস্তানে রপ্তানি হয়েছে ৬ কোটি ২৪ লাখ ডলারের পণ্য। রপ্তানির তালিকায় রয়েছে কাঁচা পাট, ওষুধ, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, চা ও তৈরি পোশাক।
প্রথম আলো লিখেছে, গত অর্থবছরে পাকিস্তান থেকে মোট আমদানি পণ্যের পরিমাণ ছিল ১৬ লাখ টন, এর মধ্যে কনটেইনারে আনা হয়, এমন পণ্যের পরিমাণ ছিল তিন লাখ টনের কম। পাকিস্তান থেকে মাসে সর্বোচ্চ এক-দেড় হাজারের বেশি কনটেইনারে পণ্য আমদানি হয় না, যা দিয়ে একটি জাহাজসেবা চালু করা যাবে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ প্রথম আলোকে বলেন, “পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য খুব বেশি নয়। আমদানিতে কড়াকড়ি শিথিল করায় হয়তো সামনে বাড়তে পারে, এ জন্যই এই সেবা চালু হতে পারে।”
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসার পর পাকিস্তানের সঙ্গে পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি শিথিল করা হয়েছে। আগে দেশটির পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর পর শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করা হতো। গত ২৯ আগস্ট জাতীয় রাজস্ব বোর্ড তা তুলে নিয়েছে।