ঢাকার মালিবাগে ২৩ বছর আগে বিএনপির মিছিলে গুলি চালিয়ে ৪ জনকে হত্যার অভিযোগে করা মামলায় আওয়ামী লীগের সাবেক দুই সংসদ সদস্য ডা. এইচবিএম ইকবাল ও নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনসহ খালাস পাওয়া ১৫ আসামিকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।
এক আবেদনের শুনানি নিয়ে বুধবার বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও বিচারপতি সগীর হোসেন লিয়নের হাই কোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেয়। নিহত একজনের পরিবারের পক্ষ থেকে আসামিদের খালাস দিয়ে বিচারিক আদালতের দেওয়া আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সম্প্রতি এ আবেদনটি করা হয়।
আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আমিনুল ইসলাম। আদেশের বিষয়ে তিনি সাংবাদিকদের জানান, হাই কোর্ট আদেশে ডা. এইচবিএম ইকবালসহ ১৫ আসামিকে অবিলম্বে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছে।
“আদেশ পাওয়ার পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তারা আদালতে আত্মসমর্পণ না করলে তাদের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করবে।”
‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বিবেচনায় ২০১০ সালে এই মামলা থেকে ইকবাল ও শাওনসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহারের পর তারা খালাস পেয়েছিলেন। আলোচিত মামলাটি বর্তমানে ঢাকা মহানগর অষ্টম দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন।
২০০১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ডা. ইকবালের নেতৃত্বে হরতালবিরোধী একটি মিছিল এবং হরতালের পক্ষে মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে বিএনপির একটি মিছিল মালিবাগ মোড়ে মুখোমুখি হয়। এ সময় ইকবালের মিছিলের মধ্য থেকে গুলি চালানো হলে ঘটনাস্থলে তিনজন এবং পরে আরেকজনসহ বিএনপির চার কর্মী নিহত হয়।
নিহতরা হলেন– জসিম উদ্দিন, খোকন, আব্দুর রশিদ মোল্লা ও নাজমা আক্তার। এ ঘটনায় একই দিনে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মতিঝিল থানায় মামলা করে পুলিশ। এছাড়া নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে তৎকালীন খিলগাঁও থানা বিএনপির সভাপতি মো. ইউনূছ মৃধা বাদী হয়ে আরেকটি মামলা করেন।
ঘটনার পরদিন বিভিন্ন দৈনিকে সন্ত্রাসী লন্ড্রী দুলাল এবং খোরশেদ আলম মিছিলের মধ্যে থেকে পিস্তল দিয়ে গুলি করছে এমন ছবি ছাপা হয়।
পরে ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলে দুই মামলা একত্রে তদন্ত ২০০২ সালের ২৯ ডিসেম্বর ডা. ইকবাল-শাওনসহ ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।
মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছিল। এরপর উচ্চ আদালতের আদেশে মামলার কার্যক্রম দীর্ঘদিন আটকে ছিল।
পরে ওয়াল-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। পরের বছর ২০১০ সালে মামলা থেকে ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক’ বিবেচনায় ইকবাল-শাওনসহ ১৫ জনের নাম প্রত্যাহারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ট্রাইব্যুনালে আবেদন জানানো হয়।
ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ২৬ আগস্ট এবং ২৯ সেপ্টেম্বর ১৫ জনকে খালাস দিয়ে তৎকালীন ঢাকা ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শামসুন নাহার বেগম দুটি আদেশ দেন।
ইকবাল ও শাওন ছাড়া খালাস পাওয়া অপর আসামিরা হলেন– শওকত হোসেন নান্নু, কবীর উদ্দিন আহমেদ, আব্দুস সালাম, মুন্সী কামরুজ্জামান কাজল, মো. মনিরুজ্জামান লিটন, এমদাদুল হক বাচ্চু, আব্দুল হালিম, আবুল বাশার, মো. জসিমউদ্দিন, লন্ড্রী দুলাল, তারেক শামসুল খান মোমেন ও মো. কামরুল মোরশেদ খোকা।
নিহতদের পরিবারের পক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, “৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর দেশে আইনের শাসন কায়েম হওয়ায় ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষে নিম্ন আদালতের ওই দুই আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করা হয়।
“আজকে আবেদনটি শুনানি শেষে আদালত ওই দুটি আদেশের কার্যক্রম স্থগিত করে। পাশাপাশি ওই ১৫ আসামিকে বিচারিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এ আদেশের ফলে তারা যে অব্যাহতি নিয়েছিল, তা আর থাকল না। এখন তাদের বিরুদ্ধে এ মামলার বিচার কার্যক্রম আগের ন্যায় যথারীতি চলবে।”
ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৫ ধারামতে, সরকার মামলা থেকে যেকোনো অভিযোগ প্রত্যাহার করতে পারে। এ ক্ষেত্রে মামলার আইনগত নথিপত্রসহ এবং অন্যান্য দলিলাদি বিবেচনায় নিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহার করে আদেশে আদালতকে অভিমত ব্যক্ত করতে হয়।
আইনজীবী আমিনুল বলেন, “আইনে পরিষ্কার করে বলা আছে, সরকারের এ প্রত্যাহারের প্রেক্ষিতে মেকানিজম (কলাকৌশল) বা সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কোনও আদালত ৪৯২ ধারার বিধান অনুযায়ী কোনও আসামিকে অব্যাহতি দিতে পারেন না। কোর্টকে তার স্বাধীনভাবে মতামত ব্যক্ত করতে হয়।
“কিন্তু ২০১০ সালের ২৬ আগস্ট এবং ২৯ সেপ্টেম্বর দেওয়া দুটি আদেশে তৎকালীন বিচারক আদেশে কোনও কারণ উল্লেখ না করে, কোনও মতামত না লিখে এই প্রত্যাহারপত্রে সম্মতি দিয়েছেন। ডা. ইকবালসহ ১৫ জন আসামিকে অব্যাহতি দিয়েছেন।”
১৫ জন ছাড়া অন্যান্য আসামিদের বিরুদ্ধে মামলাটি আদালতে বিচারাধীন রয়েছেন বলেও জানান তিনি।