‘ফেঁসে গেছি’- এই একটি কথাই তেহরানে অনেকের কাছ থেকে শুনতে হলো বিবিসির সাংবাদিককে। ইসরায়েলের গোলা থেকে বাঁচতে ইরানের রাজধানী ছেড়ে এখন পালাতে চাইছে সবাই।
“সবাই কোনো না কোনোভাবে তেহরান থেকে পালানোর চেষ্টা করছে,” বলছিলেন শহরটির এক বাসিন্দা।
কারণ একটাই, প্রাণটা যদি বাঁচানো যায়। গত শুক্রবার থেকে ইসরায়েল একের পর এক হামলা চালাচ্ছে ইরানের বিভিন্ন শহরে। তাতে এরই মধ্যে ২ শতাধিক নিহত হয়েছে। তাই প্রাণ বাঁচানোই এখন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ইরানিদের কাছে।
ইরানিরা যখন শঙ্কায়, ইসরায়েলের মানুষ কি স্বস্তিতে? না, সেখানেও একই আতঙ্ক। ইসরায়েলের হামলার জবাবে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে ইরানও। তাতে গোটা ইসরায়েলে কেউ নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারছেন না।
রাজধানী তেল আবিবও নিরাপদ নয়। ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কখন কোন বাড়ি ধসে পড়ে, তার কোনও ঠিক-ঠিকানা নেই। যেমন সোমবার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের একটি অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
শনিবার তামরা শহরে এক হামলায় পরিবারের সবাইকে হারিয়ে আইনজীবী রাজা খাতিব বললেন, “এমন ঘটনা আমার চরম শত্রুর সঙ্গেও না ঘটে।”
যখন-তখন সাইরেন বেজে উঠছে, তাতে ইসরায়েলিরা প্রাণ বাঁচাতে ছুটছে শেল্টারগুলোতে।
গোলার আঘাত থেকে বাঁচতে ইসরায়েলের মানুষ সাইরেন শুনে শেল্টারে ভূগর্ভস্থ শেল্টারে যেতে পারলেও ইরানিদের সেই সুবিধাটুকুও অপ্রতুল।
তেহরানের বাসিন্দা একজন বললেন, “আমরা কোনও অ্যালার্ম বা সাইরেন শুনতে পাই না। শুধু শুনি বিস্ফোরণের শব্দ, আর আশা করি যে গোলা যেন আমার বাড়িতে না পড়ে।”
তেহরানের পেট্রোল পাম্পগুলোতে এখন গাড়ির দীর্ঘ সারি, সবাই চাইছে দূরে কোথাও সরে যেতে, যেখানে গোলা এসে পড়বে না। কিন্তু সবাই একসঙ্গে ছুটতে শুরু করায় পাম্পগুলোতে, সড়কে দেখা দিয়েছে যানজট।
কিন্তু নিরাপদ স্থান কোথায়? সেটাও ইরানিরা এখন বুঝতে পারছেন না। জর্ডান-ইরাক পেরিয়ে দেশের মধ্যবর্তী স্থানের শহর তেহরানে যখন হামলা হয়, তখন কোথায় গোলা এসে পড়বে না?
যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি, তারা বর্তমান সময়ের সঙ্গে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়ের মিল খুঁজে পাচ্ছেন।
তেমনই একজন বলেন, “পার্থক্য হলো, তখন অন্তত যখন একটি হামলা হতো, আমরা সাইরেন শুনতাম বা হামলার আগে সতর্কতা পেতাম। কিন্তু এখন এই বোমা হামলা বা বিমান হামলার সময় কোনও সাইরেন বা সতর্কতা পাচ্ছি না।”
গত শতকের ৮০ এর দশকজুড়ে ইরান-ইরাক যুদ্ধ চলে। তবে তার পরে জন্ম নেওয়া কারও মনে সেই যুদ্ধের কোনও স্মৃতি নেই। ফলে তেমন যুদ্ধ তাদের এবারই প্রথম দেখা।
একজন বলেন, “একটি যুদ্ধাঞ্চল আছি, সেটা মানতে আমার বেশ কষ্ট হচ্ছে। আমি জানি না, কখন আমি এটা মেনে নিতে পারব।
“এটা আমার যুদ্ধ নয়। আমি কোনও পক্ষের নই, আমি শুধু আমার পরিবারের সাথে বেঁচে থাকতে চাই।”
এই পরিবারের প্রতি দায়িত্ব বোধের কারণে অনেকে চাইলেই তেহরান ছাড়তে পরছে না। কারণ বয়স্ক লোকগুলোকে নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়াটা কঠিন এক ব্যাপার। তাই ভাগ্যে হাতেই নিজেদের সঁপে দিয়েছেন তারা।
তেমনই একজন বলেন, “আমি তেহরান ছাড়তে পারছি না। আমার বৃদ্ধ বাবা-মাকে রেখে কীভাবে যাব। তাদের নিয়ে যাওয়াটাও কঠিন। আমাকে আবার কাজেও যেতে হবে। এখন আমি কী করতে পারি?”
পরিবারের কারণে তেহরান ছাড়তে না পারা এক নারী বলেন, “আমরা সবাই ভয়, অবসাদ আর চাপের মধ্যে এই দিনগুলো পার করার চেষ্টা করছি। এটা অত্যন্ত কঠিন এবং বেদনাদায়ক।”
এমন পরিস্থিতিতে দুদিন ঘুমাতে না পারার কথা জানিয়ে আরেক ব্যক্তি বলেন, “আমি সত্যিই কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।”
ইসরায়েল এরইমধ্যে ইরানিদের সতর্ক করে বলেছে, তারা যেন সামরিক কিংবা পারমাণবিক স্থাপনার কাছাকাছি না থাকেন। যার অর্থ সেই স্থাপনাগুলোতে হামলা হবে।
এতে উদ্বিগ্ন এক তেহরানবাসী বলেন, “আমরা কীভাবে জানব যে কোথায় সামরিক স্থাপনা আছে আর কোথায় নেই?”
রবিবার বিকাল ৪টার দিকে তেহরানের একটি ভবনে ইসরায়েলি গোলা আঘাত হানে। সেই ভবনের বাসিন্দা নাহিদ বলেন, “ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে আকাশ, শিশুরা কাঁদছে, আমরা আশঙ্কা করছি বহু মানুষ নিহত হয়েছে। বাতাসে মৃত্যুর গন্ধ। আমি কান্না থামাতে পারছি না।”
২৫ বছর বয়সী নাহিদ তেহরানের একটি ই-কমার্স কোম্পানিতে কাজ করেন। তেহরানে শেল্টার না থাকায় মেট্রো স্টেশনগুলো ও স্কুলে আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে নাগরিকদের।
নাহিদ বলেন, “আমরা নিশ্চিত নই যে মসজিদ, স্কুল বা মেট্রো স্টেশন নিরাপদ থাকবে। আমরা কি নিচে চাপা পড়ব?”
তেহরানের রাস্তায় এখন বিশৃঙ্খল এখ অবস্থা। পেট্রোল পাম্পের মতো খাবার দোকান, ব্যাংকের এটিএমগুলোতে মানুষের দীর্ঘ লাইন। মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক মাঝে-মধ্যেই হারিয়ে যাচ্ছে। তাতে মানুষের যোগাযোগ রাখাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ইরান যখন অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে, তখন ইসরায়েলের হামলা সেই সঙ্কটকে চরম করে তুলেছে।
এক বছর ধরে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশচুম্বী। ইরানের মুদ্রার দর দ্রুত পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় তেল বাণিজ্যও সীমিত করেছে।
ইসরায়েলের হামলার পর সরকারের প্রস্তুতির অভাবের বিষয়টি সামনে এনে সোশাল মিডিয়ায় উপহাস করছেন অনেক ইরানি। ইসরায়েল কখনও ইরানে হামলার সাহস করবে না, ইসরায়েলকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সক্ষমতা ইরানের রয়েছে- সামরিক কর্মকর্তাদের পুরনো সব বক্তব্যের ভিডিও নতুন করে পোস্ট করে চলছে এই উপহাস।
নিজেদের সক্ষমতার জানান দিতে ইরান একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ছুড়ছে ইসরায়েলের বিভিন্ন শহর লক্ষ্য করে।
শনিবার রাতে বন্দরনগরী হাইফার দিকে ছোড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্র লক্ষ্যভ্রস্ট হয়ে আঘাত হানে তামরা শহরে, বিস্ফোরণে ছোট্ট ওই শহর আলোকিত হয়ে ওঠে।
ক্ষেপণাস্ত্রটি আঘাত হানে তিনতলা একটি পাথরের বাড়িতে। বাড়িটি গুঁড়িয়ে যায়, নিহত হন মানার খাতিব, তার মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী শাদা, আরেক মেয়ে স্কুলছাত্রী হালা এবং ননদ মানাল।
মজবুত এই বাড়িতে দুটি আরও মজবুত ও নিরাপদ কক্ষ ছিল। কিন্তু সেগুলোও তাদের রক্ষা করতে পারেনি। বিস্ফোরণে ভবনের মূল অংশ উড়ে যায়।
“বিস্ফোরণের শব্দ এত জোরালো ছিল যে মনে হচ্ছে এখনও তা আমার কানে বাজছে,” বলছিলেন আজমে কিওয়ান (৫০), যিনি মানারের বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে থাকেন।
উদ্ধারকর্মী খায়ের আবু-এলহিজিয়া তার ২০ বছরের অভিজ্ঞতায় এমন ঘটনা আগে কখনও দেখেননি।
“সবকিছু পিষে ফেলেছিল। আমরা মানালের দেহাবশেষ খুঁজে পেয়েছিলাম, তাও রক্তের চিহ্ন ধরে।”
ইসরায়েল ও ইরান যুদ্ধাস্ত্র আধুনিকায়ন করতে করতে এমন সব অস্ত্র তৈরি করেছে, যা মানুষকে হাওয়া করে দিতে পারে মুহূর্তেই।
ইসরায়েলের তিন-চতুর্থাংশ শহরে বাংকার রয়েছে, যাতে যুদ্ধকালে সেখানে আশ্রয় নেওয়া যায়। কিন্তু তামরায় কোনও বাংকার নেই। কেননা শহরটি মূলত ইসরায়েলে থাকা ফিলিস্তিনিদের আবাস।
তামরার মেয়র মুসা আবু রুমি বলেন, “ইসরায়েল সরকার সমাজের আরব অংশের জন্য একটিও আশ্রয় কেন্দ্র তৈরি করেনি।”
তেল আবিব, রিশন ও বাত ইয়ামে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা যেখানে হয়েছে, সেখানে উদ্ধারকর্মী, সেনা, পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকদের ভিড় থাকলেও তামরার সেই কাজটি মূলত করতে হচ্ছে পরিচ্ছন্নতাকর্মী আর সাধারণ মানুষকে।
সেই কাজে থাকা আজমে কিওয়ান ও তার বড় ভাই বাসাম নিজেদের ইসরায়েলি আরব হিসাবে পরিচয় দিয়ে বলেন, তামরা একটি প্রাচীন আরব গ্রাম। তারা এখানেই জন্মেছেন এবং এখানেই মরতে চান।
ইসরায়েলি ইহুদিদের নির্দয় আচরণের কথাও বলেন তামরার বাসিন্দা আরব ইসরায়েলিরা, যারা এখন ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আঘাতও সইছেন।
মেয়র বলেন, “আমরা সব সময় ইসরায়েলি সমাজে অংশ থাকার চেষ্টা করছি। কিন্তু বিনিময়ে যা পাই, তা হলো ঘৃণা।”
ইসরায়েলি পার্লামেন্ট নেসেটের সদস্য আয়মান ওদেহ, যিনি খাতিব পরিবারের বন্ধু, বলেন, “সবকিছু ফিলিস্তিন সঙ্কটের সঙ্গে যুক্ত। যতক্ষণ না আমরা ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান করছি, ততক্ষণ আমরা চিরকাল চক্রাকারে ঘুরতে থাকব।”
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ক্ষমতা ধরে রাখার অভিলাষও এমন যুদ্ধের মুখে মানুষকে দাঁড় করিয়ে দেয় বলে তার মন্তব্য।
ওদেহ বলেন, “নেতানিয়াহু এই যুদ্ধকে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার করছেন। এই যুদ্ধ এবং গাজা যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি এই অঞ্চলের সবাইকে বিপদে ফেলছেন। এটি আমাদের এ যাবৎকালের সবচেয়ে ফ্যাসিবাদী এবং বিপজ্জনক সরকার। এটি সবার জন্য বিপজ্জনক।”
তামরা শহরের মতো বাংকারহীন নয় তেল আবিবের কাছের রেহোভোত শহর। তবে শহরবাসীর উদ্বেগ একটুও কম নয়।
এই শহরের বাসিন্দা ৮৪ বছর বয়সী দেবোরা ফেইতকে শনিবার রাতে সাইরেন শুনে ছুটতে হয় তাদের অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের বেইসমেন্টে শেল্টারে।
ফেইত বলেন, “আমি আমার প্রতিবেশীদের সাথে নিচে গিয়েছিলাম এবং কিছুক্ষণ পর যখন পরিস্থিতি নিরাপদ মনে হলো, তখন অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসি।”
ফেইত ১৯৯৫ সালে ইতালি থেকে ইসরায়েলে চলে আসেন এবং একাই থাকেন তিনি। সেদিন তার গভীর ঘুম ভেঙেছিল সাইরেনে। উঠেই ছুট লাগান বেইসমেন্টে।
তবে সেখান থেকে ফিরে অ্যাপার্টমেন্টে তার ঘরটি আর আগের অবস্থায় পাননি। বিস্ফোরণে ছাদ উড়ে গিয়েছিল। যে সোফায় তিনি ঘুমাচ্ছিলেন, তা চৌচির। জানালাগুলো ভেঙে পড়েছিল। ধুলোর কারণে ঠিকমতো শ্বাসও নেওয়া যাচ্ছিল না।
“বেঁচে আছি, তাই ভাগ্যবান। যদি আমি সোফায় থাকতাম, তাহলে মরে যেতাম। আমরা ভালো আছি, যদি আপনি উদ্বেগটুকু বাদ দেন,” বলেন এই ইসরায়েলি।
ফেইত যেখানে থাকেন তার কাছাকাছি ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স। ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে তাদের ক্যাম্পাসের কিছু ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে একটি ভবনে কয়েক ঘণ্টা ধরে আগুনও জ্বলছিল।
ইসরায়েলের জরুরি সেবা সংস্থা জানিয়েছে, রেহোভোতে অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে হামলায় অন্তত ৪২ জন আহত হয়েছে।
এই পরিস্থিতির মধ্যেও এখানে থাকার কথাই ভাবছেন ফেইত। ছেড়ে যাবেন কি না- এই প্রশ্নে জাতীয়তাবাদী সুরে তিনি বলেন, “ইসরায়েল আমার বাড়ি এবং এখানে ফিরে আসা নিয়ে আমার কোনও অনুশোচনা নেই।”
তেহরানে পালানোর মিছিলের মধ্যেও শোনা যায় একই রকম জাতীয়তাবাদী সুর।
তেহরানের ষাটোর্ধ্ব একজন বাসিন্দা হাদি বলেন, তার বন্ধুদের মধ্যে যারা এতদিন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির বিরুদ্ধে ছিল, তারাও এখন অনুভব করছে যে ইসরায়েল থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য তাদের পারমাণবিক বোমা প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র : বিবিসি, গার্ডিয়ান, টাইমস অব ইসরায়েল