Beta
বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ২৭ মার্চ, ২০২৫

ইসরায়েলে ইরানের হামলা : এরপর কী

ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ছোড়া ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র।
ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ছোড়া ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র।
[publishpress_authors_box]

দীর্ঘদিন ধরেই ‘ছায়াযুদ্ধ’ চলছিল ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে। তেহরান ও তেল আবিব একে অন্যকে আক্রমণে ব্যবহার করত ছায়াবাহিনী।

এক্ষেত্রে তেহরান ব্যবহার করত মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীকে। আর তেল আবিব ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের হত্যা করত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ও যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা নিয়ে।

এতদিনের সেই ছায়াযুদ্ধ এবার প্রত্যক্ষ যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। শনিবার রাতে ইরান তিন শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থাপনায়। এতে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়।

এপ্রিলের শুরুতে ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানের কনস্যুলেটে বিমান হামলা চালিয়েছিল। এতে ইরানের ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ডের (আইআরজিসি) সাত সদস্য নিহত হয়। ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ইরান প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়েছিল।

এখন প্রশ্ন হলো- ইসরায়েল কী করবে? একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধ কী শুরু হতে যাচ্ছে? আর সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী হবে?

ইরানের এই ‘ট্রু প্রমিজ’ নামের অভিযানের ফলে গোটা মধ্যপ্রাচ্য আঞ্চলিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। যদিও এমনটা হোক, তা কোনও পক্ষই চায় না। গত ছয় মাসে যুক্তরাষ্ট্র, আরব রাষ্ট্রগুলোর পাশাপাশি হিজবুল্লাহও এই যুদ্ধ এড়াতে চেয়েছে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, এটা গাজার যুদ্ধের সম্প্রসারণ নয়; এটা প্রতিফলন মাত্র। প্রায় দুই সপ্তাহ আগে সিরিয়ায় মোহাম্মদ রেজা জাহেদি এবং ছয়জন আইআরজিসি কর্মকর্তাকে ইসরায়েলের হত্যার ফলে এই পরিস্থিতির সূত্রপাত। এর প্রতিক্রিয়ায় হিজবুল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে ইরান পাল্টা পদক্ষেপ নিয়েছে।

এবারই প্রথমবারের মতো ইরান সরাসরি ইসরায়েলে আক্রমণ করল। এর মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যকার চলমান ছায়াযুদ্ধ এবার আলোতে চলে এসেছে। আর এ নিয়েই নতুন করে যুদ্ধের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

তেহরানে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ।

নিশ্চিতভাবেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইরানের হামলার প্রতিক্রিয়া জানাবেন। এখন ইসরায়েল যদি ইরানে পাল্টা হামলা চালায়, সেক্ষেত্রে ইরানও বসে থাকবে না। ফলে পরিস্থিতি সম্মুখ সমরে রূপ নিতে পারে। বলা হচ্ছে, ইসরায়েলও ইরানের মতো হামলা করেই প্রতিক্রিয়া জানাবে।

সাধারণ ইসরায়েলিদের মধ্যে ইরানের হামলা নিয়ে কেমন প্রতিক্রিয়া হবে, এর ওপর অনেকাংশে নির্ভর করছে নেতানিয়াহু কীভাবে সমস্যার মোকাবেলা করবেন। সেনাসদস্য, বিশেষ করে বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যু ও ধ্বংস ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়ার মাত্রা ব্যাপকভাবে বাড়াবে।

পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা একে এক নতুন যুগের সূচনার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। তাদের মতে, ইরান এখন আগের মতো ছায়াযুদ্ধ চালানোর বদলে সরাসরি যুদ্ধে আগ্রহী। আর এতে যদি নিজেদের ভূখণ্ডকে ঝুঁকিতেও ফেলতে হয়, তবুও তারা সরাসরি লড়াইয়েরই পক্ষে।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে মধ্যপ্রাচ্যে ভারসাম্য রক্ষা ও পারস্পরিক প্রতিরোধের পরবর্তী ধাপ বলা হচ্ছে।

গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইরানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা বাড়ানোর অব্যাহত চেষ্টা হিসেবে ইসরায়েল এপ্রিলের শুরুতে সিরিয়ায় হামলা করে।

ইসরায়েল ভালো করেই জানে, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা উপস্থিতির সুবিধা বেশিদিন থাকবে না। তেল আবিব যুক্তরাষ্ট্রের এই সেনাদেরকে নিজেদের নিরাপত্তা বিমা হিসেবে ব্যবহার করে। এখানে উল্লেখ্য যে, এক বছর আগেও এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বিমান ও যুদ্ধজাহাজের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না।

ইসরায়েলে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের (পেন্টাগন) উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বারবার বলেছেন যে, তারা মধ্যপ্রাচ্য থেকে তাদের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে ইন্দো-প্যাসিফিক ও ইউরোপে নিযুক্ত করতে চান।

যুক্তরাষ্ট্রের এই চাওয়া ইসরায়েলের জন্য উদ্বেগের। কারণ ইসরায়েল চায় মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর উপস্থিতিকে কাজে লাগাতে। ফলে এটা বোঝা যাচ্ছে, শনিবারের আক্রমণ এখানেই শেষ হবে না।

পরিস্থিতি পরবর্তীতে কোথায় যাবে তা নির্ভর করবে শনিবারের ইরানি আক্রমণের আপেক্ষিক সাফল্যের ওপর। ইরান যদি মনে করে যে, তারা ইসরায়েলি হামলার পর্যাপ্ত জবাব দিয়েছে, তাহলে অঞ্চলটি বৃহত্তর যুদ্ধ এড়িয়েও যেতে পারে। তবে ইরানের আক্রমণ মাত্রাতিরিক্ত সফল হলে ইসরাইল জবাব দেবে।

এমন চক্র চলতে থাকলে এতে যুক্তরাষ্ট্র জড়াবে। তখন গোটা অঞ্চলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। ইরানি আক্রমণের আপেক্ষিক সাফল্য যাই হোক না কেন, এর কোনও নিশ্চয়তা নেই যে আর হামলা-পাল্টা হামলা হবে না।

ইরানের ক্রমাগত হুমকি ছাড়া দ্বিতীয় বৃহত্তম অমীমাংসিত সমস্যা হলো ইসরায়েলের স্বচ্ছতার অভাব। ইসরায়েলি নেতারা কিন্তু এপ্রিলের শুরুর হামলার বিষয়ে মিত্র যুক্তরাষ্ট্রকে কিছুই জানায়নি। অথচ গাজায় যখন ইসরায়েল হামলা চালাতে শুরু করে, তখন ইসরায়েলকে রক্ষায় ওই অঞ্চলে সেনা মোতায়েন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।

আঞ্চলিক ভূরাজনীতি বিষয়ক বিশ্লেষকরা মনে করেন, ইসরায়েলের উচিত ছিল তার পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো। এমনটা হলে শনিবারের হামলার ঘটনা এড়ানো যেত।

সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনা।

ইসরায়েলে ইরানের হামলার ফলে এখন কী ঘটবে, তা নির্ভর করছে তিনটি ফ্যাক্টরের ওপর। ইরানের ছায়াযোদ্ধা অর্থাৎ হুতি ও হিজবুল্লাহ যুদ্ধে যোগ দেবে কিনা, ইসরায়েলে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে কিনা এবং যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে পাল্টা হামলায় যোগ দেবে কিনা; তার ওপর।

ইসরায়েলের প্রতি বৈশ্বিক সহানুভূতি হ্রাস এবং বাইডেন ও নেতানিয়াহুর মধ্যকার সম্পর্কের টানাপোড়েনের পটভূমিতে ইরানের হামলার ঘটনা ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে এই হামলার ক্ষেত্রে। কিন্তু এই দেশগুলোই আবার গাজা প্রশ্নে ইসরায়েলকে চাপে রেখেছে। কারণ এই ইস্যুতে দেশগুলোর নেতারা জনসমর্থন হারিয়েছে।

শনিবার ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সৌদি আরব এবং জর্ডানও প্রতিহত করেছে। দেশগুলো বলছে, তারা তাদের আকাশপথের সুরক্ষার জন্য ওই পদক্ষেপ নিয়েছে। এর বাইরে তারা এমন কোনও বিবৃতি দেয়নি, যাতে মনে হয় তারা ইসরায়েলের পক্ষে রয়েছে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে ক্ষমতাধররা এই যুদ্ধে নাও জড়াতে পারে। কারণ এতে বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধ লাগার ঝুঁকি তৈরি হবে। তাই কৌশলগত অবস্থান থেকে তারা শুরুতে পর্যবেক্ষকের ভূমিকা নিতে পারে। তবে ইরানকে শিক্ষা দিতে যদি ইসরায়েল লেবাননে হামলা করে অতীতের মতো জায়গা দখল করে, সেক্ষেত্রে সৌদি আরব, মিশর ও ইরাকের মতো আরও কিছু দেশ যুদ্ধে জড়াবে।

আঞ্চলিক দেশগুলোর মধ্যে এই সংকটে বেকায়দায় পড়েছে জর্ডান। গত ছয় মাস ধরে জর্ডানের নেতৃত্ব গাজায় যুদ্ধবিরতির পক্ষে আওয়াজ তুলে যাচ্ছে। দেশটিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ফিলিস্তিনি শরণার্থী অনেকদিন ধরেই রয়েছে। ফলে দেশটি সবসময়ই চায় শান্তিপূর্ণ সমাধানের মাধ্যমে ওই ফিলিস্তিনিদের তাদের ভূখণ্ডে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ও দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সখ্যতার কারণে পুরনো হিসাব-নিকাশ পাল্টে যাবে, মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত