ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া গত ৩১ জুলাই গুপ্তহত্যার শিকার হন ইরানের রাজধানী তেহরানে। ইরান ও হামাস এর জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে এবং প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দেয়।
মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই মনে করছে, ইরান যেকোনও সময় ইসরায়েলের ওপর হামলা চালাতে পারে। যেকোনও সময় আকাশে হাজার হাজার ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে পারে। এই আশঙ্কায় ইরান ও তার প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রচুর ফ্লাইট বাতিলও করা হয়েছে।
তবে তেহরান কি গাজা শান্তি আলোচনায় অগ্রগতির বিনিময়ে ইসরায়েলে হামলা থেকে পিছু হটতে পারে?
বুধবার সৌদি আরবের জেদ্দায় এক জরুরি শীর্ষ সম্মেলনে জড়ো হওয়া আঞ্চলিক নেতাদের মধ্যে এটাই ছিল আলোচনার বিষয়।
ইরানের ক্ষোভ নিরসনে এই শেষ প্রচেষ্টা হয়েছিল অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) সদর দপ্তর। এটি লোহিত সাগরের তীরবর্তী জেদ্দা শহরে অবস্থিত।
বুধবার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মধ্যপ্রাচ্যকে যুদ্ধ থেকে রক্ষায় সেখানে জড়ো হন।
এদিন জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা বন্ধ করতে হলে এর মূল কারণের অবসান ঘটাতে হবে। আর সেটি হল গাজায় ইসরায়েলের অব্যাহত আগ্রাসন।”
গত এপ্রিলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সময় জর্ডান ইসরায়েলের পাশে ছিল।
হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি আলোচনায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে তার অবস্থান নমনীয় করতে রাজি করানোর চেষ্টা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। তবে এবার হয়তো সেই প্রচেষ্টায় সাফল্য আসতে চলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ইসরায়েল ও ইরান উভয়ের সঙ্গেই সরাসরি যোগাযোগ করেছে। তাদের বলা হয়েছে, “কারো জন্যই এই সংঘাতকে আর বাড়ানো উচিৎ হবে না।”
ব্লিনকেন জানান, গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা ‘চূড়ান্ত পর্যায়ে’ প্রবেশ করেছে এবং নতুন করে কোনও যুদ্ধ শুরু হলে তা ভেস্তে যেতে পারে।
সাফাদি তেহরানে ছিলেন এবং বাঘেরি ও ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান উভয়ের সঙ্গেই সাক্ষাত করেন। এরপর ইরানও উত্তেজনা না বাড়ানোর কথা ভাবছে বলেই মনে হচ্ছে।
ইসরায়েলে হামলা থেকে ইরানকে বিরত থাকতে হলে একটি কূটনৈতিক আবরণ প্রয়োজন। আর সেটা হতে পারে গাজায় যুদ্ধবিরতি। তখন তেহরান নিজের জনগণকে বোঝাতে পারবে যে, প্রতিশোধ নেওয়ার চেয়ে ফিলিস্তিনিদের প্রাণ রক্ষা তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলেই ইসরায়েলে হামলা করা হয়নি। ইরানের সম্মান ও প্রতিরক্ষা ঝুঁকির মুখে থাকায় এর প্রতিদানও যথেষ্ট বড় হওয়া দরকার।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রোও বুধবার পেজেশকিয়ানের সঙ্গে এক ফোনালাপে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা ত্যাগের আহ্বান জানান।
পেজেশকিয়ানের প্রতিক্রিয়া থেকে বোঝা যায়, তিনি ম্যাঁক্রোর সেই আহ্বানে সাড়া দিচ্ছেন।
তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো যদি সত্যিই এই অঞ্চলে যুদ্ধ ও নিরাপত্তাহীনতা রোধ করতে চায় তাহলে তাদেরকে তার বাস্তব প্রমাণ দিতে হবে। এর জন্য তাদের অবিলম্বে ইসরায়েলের কাছে অস্ত্র বিক্রি এবং ইহুদিবাদী শাসনকে সমর্থন করা বন্ধ করতে হবে। আর গাজায় গণহত্যা ও হামলা বন্ধ এবং যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে ইসরায়েলকে বাধ্য করতে হবে।”
হিজবুল্লাহ কী একাই ইসরায়েলে হামলা করতে পারে
গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে আশার সঙ্গে বাস্তবতার অনেক ফারাক আছে। কারণ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকেও বিষয়টি মানাতে হবে।
ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যুর পর হামাস ইয়াহিয়া সিনাওয়ারকে তাদের রাজনৈতিক প্রধান হিসেবে নির্বাচন করায় বিষয়টি আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ সিনাওয়ার ইসরায়েলের প্রতি খুবই কঠোর মনোভাব লালন করেন। ইসরায়েলও গত ৭ অক্টোবরের হামলার জন্য সিনাওয়ারকেই প্রধান আসামী মনে করে।
গাজায় যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ওআইসিতে যে ঐকমত্য হয়েছে, সে ব্যাপারে নেতানিয়াহুকে রাজি করাতে পারে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
কিন্তু গত ১০ মাস ধরে গাজায় যুদ্ধ চলাকালে নেতানিয়াহুর সঙ্গে বাইডেনের টানাপোড়েন তৈরি হয়। আর বাইডেনও ইসরায়েলের ইতিহাসের সবচেয়ে কট্টর ডানপন্থী সরকারের সঙ্গে নিজেকে দেখাতে চান না। এটিও জেদ্দার হতাশা বাড়িয়েছে।
জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের স্থায়ী পর্যবেক্ষক রিয়াদ মনসুরও সেদিন ওআইসির ওই বৈঠকে ছিলেন।
তিনি বলেন, “এই অঞ্চলের উত্তেজনা বাড়ানোর আর দরকার নেই। এই অঞ্চলের যেটা দরকার তা হল যুদ্ধবিরতি এবং বৈধ অধিকার বাস্তবায়ন। আমার মনে হয় যে, নেতানিয়াহু প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধে নামাতে চান।”
জেদ্দায় ওআইসির বৈঠকে এ ব্যাপারে সবাই একমত হন যে, ইরানকে ইসরায়েলে হামলা না করার বিনিময়ে বড় কিছু একটা প্রতিদান দিতে হবে। ইরানের জন্য এটি একটি কূটনৈতিক অর্জন।
রিয়াদ মনসুর বলেন, “ইরান যা চায় তা সবাই জানে— নিজের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখা।”
চার ঘণ্টার জরুরি বৈঠকের পর ইরানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী তেহরানের উদ্দেশে রওনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার নজর এখন লেবাননের হিজবুল্লাহর দিকে। হানিয়াকে হত্যার কয়েক ঘণ্টা আগে ইসরায়েল বৈরুতেও হামলা চালায়। ওই হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ সামরিক কমান্ডার ফুয়াদ শুকুর নিহত হন। হিজবুল্লাহও তাই ইসরায়েলের ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়।
যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা এবং এক পশ্চিমা গোয়েন্দা কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেছেন, ইরানের চেয়ে হিজবুল্লাহর হামলার আশঙ্কা এখন বেশি। এমনকি হিজবুল্লাহ ইরানের অনুমোদন ছাড়াই ইসরায়েল হামলা করতে পারে এমন সম্ভাবনাও বেড়েছে।
তবে নেতানিয়াহু ইরান ও হিজবুল্লাহকে একই দেহের দুটি হাত হিসেবে দেখেন।
গত ১৩ এপ্রিলের হামলা ছাড়া ইরান আর কখনও ইসরায়েলের ওপর সরাসরি হামলা করেনি। বিপরীতে হিজবুল্লাহ দীর্ঘদিন ধরেই ইসরায়েলের ওপর প্রায়ই রকেট হামলা করে আসছে। এবার হিজবুল্লাহ শুকুর ও হানিয়া উভয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারে। এজন্য তারা ইসরায়েলের ওপর আগের চেয়ে আরও বড় আকারের হামলা চালাতে পারে।
আর হিজবুল্লাহর হামলার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েল যদি লেবাননে হামলা করে বসে তাহলে ইরানও ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। এই আশঙ্কাই করছে সবাই।
তবে একটা বিষয় পরিষ্কার, জেদ্দা বৈঠক এবং পরোক্ষ কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটা সমঝোতা হচ্ছে। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কোনও যুদ্ধ শুরু করতে ইচ্ছুক নয় বলেই মনে হচ্ছে। তবে হিজবুল্লাহকে ইরান কতটা সংযত রাখতে পারবে সেটা নিশ্চিত নয়।
তথ্যসূত্র: সিএনএন