পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার পর নিজেদের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে সম্মত হয়েছে ইরান ও পাকিস্তান। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেদের মধ্যে সরাসরি ফোনালাপে এই ঐকমত্যে পৌঁছেছেন বলে জানিয়েছে ইসলামাবাদ।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুক্রবার রাতে এক বিবৃতিতে বলেছে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জলিল আব্বাস জিলানি ও ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আব্দুল্লাহিয়ান ফোনে কথা বলেছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “সন্ত্রাসবাদ দমন এবং পারস্পরিক উদ্বেগের অন্যান্য দিকগুলো নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে সহযোগিতা ও ঘনিষ্ঠ সমন্বয় জোরদারে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী একমত হয়েছেন। এসময় তারা উত্তেজনা কমাতেও সম্মত হয়েছেন।”
এতে আরও বলা হয়, “দুই দেশের রাষ্ট্রদূতদেরও স্ব স্ব কর্মস্থলে পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।”
ইরানের হামলার পর গত বুধবার পাকিস্তান ইরান থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতকে ফিরিয়ে আনে এবং ইরানের রাষ্ট্রদূতকেও ইসলামাবাদে আসতে নিষেধ করে দেয়। ইরানের রাষ্ট্রদূত সেসময় নিজ দেশে ভ্রমণে ছিলেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেনি দেশ দুটি।
গাজায় ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধ এবং লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হুতিদের হামলায় সহিংসতা ও রক্তপাতে জর্জরিত মধ্যপ্রাচ্য। তার মধ্যেই এই সংঘর্ষে জড়িয়েছিল ইরান ও পাকিস্তান। গত সপ্তাহে দেশ দুটির পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় অন্তত ১১ জন নিহত হয়।
প্রথমে ইরান পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের সীমান্তবর্তী শহর পাঞ্জগুরে গত মঙ্গলবার রাতে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালায়। এতে দুই শিশু নিহত হয়। এরপর গত বৃহস্পতিবার ভোরে ইরানের সিস্তান ও বেলুচিস্তান প্রদেশের এক গ্রামে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় পাকিস্তান। ওই হামলায় ৪ শিশুসহ ৯ জন নিহত হয়।
দেশ দুটির এই পাল্টাপাল্টি হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বাড়ার শঙ্কা জাগে আন্তর্জাতিক মহলে। তবে ইরান ও পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে আলোচনার মধ্য দিয়ে সেই উদ্বেগ কিছুটা কমিয়ে এনেছে। এই হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ভারত উদ্বেগ জানিয়েছিল। ইরান ও পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন উভয় পক্ষকেই সংযম দেখিয়ে আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা কমানোর পরামর্শ দেয়।
সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব জানান দিতেই ইরানের হামলা?
ইরান বলেছে, তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল জইশ আল-আদেল নামের একটি ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’। এটি ইরানের সিস্তান-বেলুচিস্তান ভিত্তিক একটি সুন্নি সশস্ত্র সংগঠন। সংগঠনটি প্রায়ই ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালায়।
অন্যদিকে পাকিস্তানও বলছে, তারাও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ওপরই হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, দেশটির বিচ্ছিন্নতাবাদী বেলুচ সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে। পাকিস্তান যাদের বেলুচ সন্ত্রাসী বলছে, তারা মূলত দেশটির বেলুচিস্তান প্রদেশের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী।
পাকিস্তানে হামলার আগে সোমবার রাতে ইরাক-সিরিয়ায়ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ইরাকের ইরবিল শহরে ১১টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি)। ইরবিল ইরাকের আধা-স্বায়ত্বশাসিত কুর্দিস্তান অঞ্চলের রাজধানী।
ইরানের দাবি, ইরবিলে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের কার্যালয় রয়েছে। সেটিকে লক্ষ্য করেই তারা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। তবে কুর্দি সরকার বলেছে, ইরানের হামলায় চারজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে বিশিষ্ট কুর্দি ব্যবসায়ী পেশরা দিজায়ে ও তার ১১ মাসের মেয়েও রয়েছে।
সোমবার রাতে আইআরজিসি সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ ইদলিবেও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ইরানের দাবি, ইসলামিক স্টেটসহ (আইএস) আরও কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ঘাঁটিতে এই হামলা চালানো হয়েছে।
এসব হামলায় ইরান দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। বিবিসি বলছে, ইরান হয়তো নিজের সামরিক শক্তি প্রদর্শনেই হামলাগুলো চালিয়েছে।
বৃহস্পতিবার বিবিসির এক বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনে বলা হয়, একসঙ্গে প্রতিবেশী তিন দেশে হামলার মাধ্যমে ইরান মূলত নিজের ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা প্রদর্শন করতে চাইছে।
বিবিসির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, “ইরাক, সিরিয়া ও পাকিস্তানি ভূখণ্ডে হামলার মাধ্যমে ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী (আইআরজিসি) দেখাতে চায় যে, তারা একটি প্রধান আঞ্চলিক সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।”
“আইআরজিসি প্রকাশ্যে বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সব সামরিক ঘাঁটিসহ ইসরায়েলের তেল আবিব ও হাইফার সেনা ঘাঁটিগুলোও তার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় রয়েছে।”
যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ভারতের অবস্থান
মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তিন দেশের সার্বভৌম সীমান্ত লঙ্ঘনের দায়ে ইরানের কড়া সমালোচনা করে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, “আমি মনে করি ইরান ভণ্ডামি করছে। কারণ, ইরান একদিকে এই অঞ্চলে সন্ত্রাসীদের আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। আর অন্যদিকে, দাবি করছে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার জন্যই তারা অন্য দেশে হামলা চালাচ্ছে।”
তবে অন্য দেশে হামলা চালানোর জন্য ইরানের সমালোচনা করলেও যুক্তরাষ্ট্র নিজেও সম্প্রতি এমন হামলা চালিয়েছে। লোহিত সাগরে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক জাহাজে হামলার জবাবে, ইয়েমেনের হুতিদের ওপর চার দফা বিমান হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাজ্যও ওই হামলায় অংশগ্রহণ করে।
চীন অবশ্য নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়। দেশটি উভয় পক্ষকেই সংযম দেখানোর আহ্বান জানায়। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, “উত্তেজনা বাড়বে এমন পদক্ষেপ এড়াতে এবং যৌথভাবে এই অঞ্চলকে শান্তিপূর্ণ রাখতে আমরা দুই পক্ষকেই আহ্বান জানাচ্ছি।”
পাকিস্তান ও ইরান উভয় দেশের সঙ্গেই চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভসহ (বিআরআই) পাকিস্তানে বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে দেশটির। আর ইরান থেকে দেশটি আমদানি করে বিশাল পরিমাণ তেল। এ কারণেই সম্ভবত দেশটির এই নিরপেক্ষ অবস্থান।
রাশিয়াও উভয়পক্ষকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখানোর আহ্বান জানায়। দেশটির পক্ষ থেকে বলা হয়, পাকিস্তান ও ইরানকে অবশ্যই উত্তেজনা কমাতে হবে এবং কূটনীতির পথ অনুসরণ করতে হবে। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যে, ইরান-পাকিস্তান সীমান্ত এলাকায় সাম্প্রতিক দিনগুলোতে উত্তেজনা বাড়ছে। আমরা উভয় পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম দেখানোর এবং উদ্ভূত সমস্যা রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে সমাধানের আহ্বান জানাই।”
ভারতও কিছুটা নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়। ভারত সন্ত্রাসবাদের প্রতি তার শূন্য সহনশীলতার কথা জানিয়ে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনাকে পাকিস্তান ও ইরানের বিষয় বলে মন্তব্য করে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, “এটি ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যকার একটি বিষয়। আমাদের উদ্বেগ সন্ত্রাসবাদ নিয়ে। সন্ত্রাসবাদের প্রতি আমাদের কোনও সহনশীলতা নেই। এ ব্যাপারে আমরা আপোষহীন। তবে কোনও দেশ আত্মরক্ষার জন্য যে পদক্ষেপ নেয় তা কেন নেয় সেটাও আমরা বুঝি।”
সীমান্তে উত্তেজনার অবসান নিয়ে সন্দেহ
ইরান ও পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি হামলার পর উত্তেজনা কমাতে দেশ দুটি সম্মত হলেও এই দুই দেশের সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনার অবসান নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক উইলসন সেন্টারের গবেষক বাকির সাজ্জাদ সৈয়দ।
আল জাজিরাকে তিনি বলেন, “শুধু পাকিস্তানের প্রতিশোধের মধ্য দিয়েই উত্তেজনা শেষ হওয়ার ব্যাপারে আমার সন্দেহ রয়েছে।”
“যে অবিশ্বাসের কারণে দেশ দুটি সীমান্তের দুপাশের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে পরস্পরকে অভিযান চালাতে দেয়নি তা আরও বাড়বে। এছাড়া সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে দমন না করার ফলে দুটি প্রদেশেই ফের জঙ্গিবাদ-সহিংসতা বাড়ার সম্ভাবনাও দেখছি আমি।”