হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির আবদুল্লাহিয়ানসহ অন্যান্যদের জন্য ইরান পাঁচ দিনের শোক ঘোষণা করেছে।
কিন্তু ইরানের ইসলামী প্রজাতন্ত্রের ৪৫ বছরের ইতিহাসে অন্যান্য প্রবীণ নেতাদের মৃত্যুতে জনগণকে যতটা শোক প্রকাশ করতে দেখা গেছে, এবার ততটা দেখা যাচ্ছে না। এবারের শোক পালন যেন অনেকটা নিঃশব্দ।
নিহত প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী দুজনের জন্যই প্রার্থনা করার জন্য সরকার অনুগতরা মসজিদ ও বিভিন্ন চত্বরে জড়ো হলেও বেশিরভাগ দোকান-পাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল। এমনকি কর্তৃপক্ষও জনগণকে শোক প্রকাশে বাধ্য করা বা তাদের স্বাভাবিক জীবন-যাত্রাকে ব্যাহত করার সামান্যতম চেষ্টাও করেনি।
রাইসির কট্টরপন্থী সরকার ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে সবচেয়ে বড় সরকারবিরোধী বিক্ষোভ সহিংসভাবে দমন করার এক বছর পরই তার মৃত্যুতে বিরোধীরা এমনকি নিজেদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণের ভিডিও অনলাইনে পোস্ট করেছে।
লায়লা নামে তেহরানের ২১ বছর বয়সী এক ছাত্রী ফোনে রয়টার্সকে বলেছেন, তিনি রাইসির মৃত্যুতে দুঃখিত নন; কারণ রাইসি হিজাবের জন্য নারীদের ওপর দমন-পীড়নের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
লায়লা বলেন, “তবে আমি দুঃখিত এ কারণে যে রাইসির মৃত্যুর পরেও এই সরকারের পতন বা পরিবর্তন হবে না।”
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলেছে, ২০২২ সালে দেশটির কঠোর পোশাক বিধি লঙ্ঘনের দায়ে নীতি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া কুর্দি তরুণী মাশা আমিনির পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর পর বিক্ষোভে কয়েকশ ইরানি নাগরিক নিহত হয়েছিল।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটে কর্তৃপক্ষের ভুল ব্যবস্থাপনার ফলে ধর্মীয় শাসক গোষ্ঠী এবং সমাজের মধ্যে বিভেদ আরও গভীর হয়েছে।
তবে ধর্মীয় শাসকগোষ্ঠীর সমর্থকরা ২০২১ সালে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ভোটে নির্বাচিত ৬৩ বছর বয়সী কট্টরপন্থী আইনবিদ রাইসির প্রশংসা করে কথা বলেছেন।
পবিত্র শিয়া শহর কোমের স্বেচ্ছাসেবী বাসিজ মিলিশিয়ার সদস্য মোহাম্মদ হোসেইন জাররাবি, (২৮) বলেন, “তিনি একজন কঠোর পরিশ্রমী প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমরা যতদিন বেঁচে আছি ততদিন তার উত্তরাধিকার টিকে থাকবে।”
কিন্তু ইরাকে ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) সিনিয়র কমান্ডার কাসেম সোলেইমানির মৃত্যুতে মানুষ যতটা শোক প্রকাশ করেছে ততটা এবার দেখা যায়নি।
কাশেম সোলাইমানির জানাজা ও দাফনে লাখ লাখ মানুষের ঢল নেমেছিল এবং বিভিন্ন শহরে মানুষকে শোকে রাস্তায় নেমে আসতেও দেখা গিয়েছিল। কিন্তু রাইসির জন্য ততটা আবেগ দেখা যাচ্ছে না।
স্বদেশে এবং নির্বাসনে থাকা ইরানের ইসলামি শাসকগোষ্ঠীর বিরোধীদের কাছে ১৯৮০-র দশক থেকেই রাইসি একজন ঘৃণ্য ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন। কারণ ইসলামি বিপ্লবের পর ভিন্নমতাবলম্বীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার ক্ষেত্রে একজন আইনবিদ হিসেবে রাইসি সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
যদিও ইরান কখনোই ওই গণ মৃত্যুদণ্ডের কথা স্বীকার করে না। তবে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, ইসলামি বিপ্লবের পর প্রথম দশকে অন্তত ৫ হাজার বা সম্ভবত আরও বেশি মানুষকে বিপ্লবের বিরোধিতা করায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
সোরান মানসোর্নিয়া নামের এক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রাইসির মৃত্যুর উত্তরাধিকার নিয়ে বিতর্ক করা একটি অনলাইন ফোরামে পোস্ট করেছেন, “আমি মৃত্যুদণ্ডের শিকারদের পরিবারকে অভিনন্দন জানাই।”
তবে, নার্গিস নামের আরেক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী, রাইসির মৃত্যুকে ‘শহীদী মৃত্যু’ বলে শোক প্রকাশ করেছেন।
বেশিরভাগ ইরানি বলেছেন, তারা মনে করেন না, রাইসির মৃত্যুতে দেশের শাসন ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আসবে। কারণ ইসলামি শাসকগোষ্ঠী তার মতো একই রকম কট্টরপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী কাউকেই নতুন প্রেসিডেন্ট বানাবে।
প্রতিশোধের ভয়ে পুরো নাম প্রকাশ না করা রেজা (৪৭) নামে ইয়াজদের কেন্দ্রীয় মরুভূমি শহরের একজন দোকানদার বলেন, “এতে কিছুই যায় আসে না। একজন কট্টরপন্থী মারা গেলে, আরেকজন কট্টরপন্থী ক্ষমতা দখল করে এবং আমাদের দুর্দশা অব্যাহত থাকে।”
রেজা বলেন, “আমরা অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা নিয়ে এত ব্যস্ত যে এই ধরনের খবর নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ারও সময় নেই আমাদের।”
তথ্যসূত্র : রয়টার্স