দুইশ বছরের বেশি সময় ধরে রাজধানীর মর্যাদা নিয়ে আছে যে শহর, সেই তেহরান থেকে রাজধানী সরিয়ে নিতে চাইছেন ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান।
গত মে মাসে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর পর জুলাইয়ে ইরানের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন মাসুদ পেজেশকিয়ান, যিনি একজন উদার ও সংস্কারবাদী রাজনীতিক হিসাবে পরিচিত।
গত শনিবার এক বক্তৃতায় পেজেশকিয়ান বলেন, রাজধানী তেহরান থেকে ইরানের দক্ষিণ উপকূলের কাছাকাছি একটি শহরে স্থানান্তর করা উচিৎ।
তেহরান ইরানের উত্তরাঞ্চলীয় শহর। জনসংখ্যার দিক দিয়ে এটি শুধু ইরানই নয়, পশ্চিম এশিয়ার বৃহত্তম নগরী। মিশরের কায়রোর পর মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় নগরী তেহরান।
কাস্পিয়ান সাগর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের তেহরান কাজার শাসনকালে ১৭৮৬ সালে প্রথম রাজধানীর মর্যাদা পায়। তখনকার শাহ আগা মোহাম্মদ খান শহরটিকে রাজধানী বানিয়েছিলেন।
তারপর অনেক শাহন গড়িয়ে গত শতকের সত্তরের দশকে ইসলামী বিপ্লবের পরও তেহরনেই রাজধানী থেকে যায়।
মূল শহরটিতে এখন প্রায় ৯৪ লাখ মানুষের বাস। তবে আশপাশের শহরতলীর এলাকাগুলো মিলিয়ে তেহরানের মোট বাসিন্দা প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ।
ঐতিহাসিক এই নগরী এখন আর রাজধানীর ভার বহন করতে পারছে না বলে মনে করছেন পেজেশকিয়ান।
তার মতে, তেহরানের বিভিন্ন সমস্যা চরমে উঠায় এখন আর শহরটির উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া অর্থহীন।
আড়াই হাজার বর্গকিলোমিটারের তেহরান এখন পানি ঘাটতি, বায়ু দূষণে জর্জরিত। নতুন বাসিন্দা নেওয়ার সক্ষমতাও হারিয়েছে।
পেজেশকিয়ান বলছেন, দেশের রাজধানী হিসাবে তেহরান এমন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, যার কোনও সমাধান এই মুহূর্তে সরকারের কাছে নেই। তাই সর্বোত্তম উপায় হবে দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র স্থানান্তর করা।
তিনি বলেন, “চাপ কমাতে শুধু বাড়তি বাসিন্দাদের তেহরান থেকে সরে যেতে বললেই হবে না। প্রথমে আমাদের নিজেদের সরে যেতে হবে, যাতে জনগণ আমাদের অনুসরণ করে।”
পারস্য উপসাগরের কাছাকাছি একটি নতুন রাজধানী খোঁজার অর্থনৈতিক কারণও দেখান তিনি। কারণ সেখান দিয়েই মূল বাণিজ্য পথগুলো গেছে।
পেজেশকিয়ান বলেন, “বর্তমান ধারা অব্যাহত রেখে দেশের আরও উন্নয়ন অসম্ভব। এখন আমরা দেশের দক্ষিণ ও সমুদ্র এলাকা থেকে কাঁচামাল কেন্দ্রে নিয়ে আসি, এরপর পণ্যে পরিণত করি। কিন্তু রপ্তানির জন্য ফের দক্ষিণেই ফেরত পাঠাতে হয়।
“এতে আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছি। ফলে দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রকে দক্ষিণে এবং সমুদ্রের কাছাকাছি স্থানান্তর করা ছাড়া আমাদের আর কোনও বিকল্প নেই।”
তবে পেজেশকিয়ানের পরিকল্পনার বিপরীত মতও আছে। তেহরানের কোনও উপযুক্ত বিকল্প নেই বলে মনে করেন ১৯৯০ এর দশকে এই নগরীর মেয়রের দায়িত্ব পালনকারী গোলাম হোসেন কারবাচি।
“আপনি কোথায় যেতে চান”- প্রশ্নটি রেখে তিনি সতর্কবার্তা দেন এভাবে, বিশ্বের অনেক দেশ রাজধানী স্থানান্তর করে অর্থ হারিয়েছে এবং নতুন রাজধানীও পরে একটি সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে।
রাজধানী তেহরানের বাইরে সরানোর কথা পেজেশকিয়ানই প্রথম তুলেছেন, বিষয়টি এমন নয়। ২০০৫-২০১৩ সালের মধ্যে প্রেসিডেন্ট থাকা মাহমুদ আহমাদিনেজাদও একই প্রস্তাব করেছিলেন।
তখন পার্লামেন্টে রাজধানী স্থানান্তরের জন্য একটি বিশেষ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাবও পাস হয়েছিল। তবে রাজধানী স্থানান্তরের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আর আসেনি।
পরিবেশ দূষণ, যানজট এবং ভূমিকম্পের ঝুঁকির উল্লেখ করে তখন রাজধানী স্থানান্তরের কথা বলা হয়েছিল।
ভৌগলিকভাবে ইরান কয়েকটি ফল্টলাইন বা চ্যুতির উপর অবস্থিত এবং প্রতিদিন গড়ে একটি করে হালকা ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
তবে অর্থনৈতিকভাবে ব্যয়বহুল হওয়া এবং রাজনীতিক কারণে তখন আর বিষয়টি সামনে এগোয়নি।
১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগেও রাজধানী তেহরান থেকে সরিয়ে নেওয়ার কথা উঠেছিল।
তৎকালীন শাহকে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শকরা রাজধানী স্থানান্তর করতে বলেছিলেন এই কারণে যে তেহরান সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমান্তের খুব কাছে ছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় রুশ এবং ব্রিটিশ বাহিনী দেশটির কিছু অংশ দখল করে নিলে ইরান সরকার অস্থায়ীভাবে রাজধানী স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে আদেশটি কখনই কার্যকর করা হয়নি।
তথ্যসূত্র : আরটি, আল জাজিরা