বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে পাইলট নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, শিক্ষা সনদ জালসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি।
মঙ্গলবার বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজীক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চে সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এসব সুপারিশ অনুযায়ী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা প্রতিবেদন আকারে আগামী ১৯ মার্চের মধ্যে দাখিল করতে নির্দেশ দেয় আদালত।
এ সময় পাইলট নিয়োগে অনিয়ামের তদন্ত প্রতিবেদন দেখে উষ্মা প্রকাশ করেন দুই বিচারক।
তারা বলেন, “বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতিসহ আম জনতা সবাই এর যাত্রী। এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে লোক দেখানো হলে সেটি মেনে নেওয়া হবে না।”
আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তানভীর আহমেদ। সিভিল এভিয়েশনের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট সাইফুর রশিদ, রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাইনুল হাসান।
আদেশের বিষয়ে তানভীর আহমেদ বলেন, “গত বছর মার্চ মাসে বিমানের পাইলট নিয়োগের অনিয়ম নিয়ে পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ওই প্রতিবেদনযুক্ত করে আমি একটি রিট আবেদন করি। এর শুনানি নিয়ে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয় আদালত।
“সেই নির্দেশনার আলোকে আজ তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করে। যেখানে অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা প্রমাণিত হয়েছে এবং পত্রিকার প্রতিবেদনের সত্যতা পাওয়া গিয়েছে। তবে ঘটনার সত্যতা পেলেও দোষীদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেটি বলা হয়নি। এ কারণে আদালত দোষীদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তাও জানাতে নির্দেশ দিয়েছেন।”
গত বছরের ১ মার্চ দেশের একটি ইংরেজি দৈনিকে পাইলট নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। সেখানে বলা হয়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর উড়োজাহাজ উড্ডয়নের জন্য চুক্তিভিত্তিক পাইলটদের একটি ব্যাচ নিয়োগ দিয়েছিল। নিয়োগের সময় বিমান দাবি করেছিল যে, পাইলট সংকটের কারণে দ্রুত এই নিয়োগ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে হবে।
এর এক বছর পর দেখা যায়, সেসময় নিয়োগ হওয়া ১৪ জন পাইলটের মধ্যে মাত্র পাঁচজন উড়োজাহাজ চালিয়েছেন। বাকিরা আটকে আছেন জাল সনদ, অযোগ্যতা ও লাইসেন্সিং পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে।
অথচ বিমান বাংলাদেশে এদের নিয়োগ হয়েছে মোটা অংকের বেতনে। সেইসঙ্গে প্রশিক্ষণের জন্য খরচ করা হয়েছে বিপুল অর্থ। অপারেশন ম্যানুয়াল অনুযায়ী, বিশ্বের বৃহত্তম যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ বোয়িং ৭৭৭ ওড়াতে ফার্স্ট অফিসারদের কমপক্ষে ৩০০ ঘণ্টার ফ্লাইং অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। কিন্তু নিয়োগপ্রাপ্তদের কারোরই সেই অভিজ্ঞতা ছিল না।
এই প্রতিবেদনের পর সংক্ষুব্ধ হয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন আইনজীবী তানভীর আহমেদ। যার শুনানি শেষে গত বছরের ১৩ আগস্ট হাইকোর্ট বিষয়টি তদন্ত কররে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়।
এরপর আদালতের নির্দেশে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মুহাম্মদ আশরাফ আলী ফারুকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মো. মুকিত-উল- আলম, চিফ অব ফ্লাইট সেইফটি ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ক্যাপ্টেন এনামুল হক তালুকদার।
কমিটি শিক্ষা সনদ জালিয়াতি, নিয়োগে কোনও নীতিমালা না থাকা, বিমানের নিজস্ব পাইলট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকা আবশ্যকের মতো পর্যবেক্ষণসহ ১৬টি সুপারিশ দিয়েছে।
সেখানে বলা হয়েছে, সাধারণত ৭৩৭ এবং ৭৮৭ উড়োজাহাজের নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিতে ‘টাইপ রেটেড’ (বিমানের এক ধরনের সার্টিফিকেশন) চাওয়া হয়। কিন্তু বোয়িং ৭৭৭ এর ক্যাপ্টেন এবং ফার্স্ট অফিসার নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘টাইপ রেটেড’ চাওয়া হয়নি। বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ বলে উল্লেখ করেছে কমিটি।
তৎকালীন চিফ অব ট্রেনিং ক্যাপ্টেন সাজিদ আহমেদের বিরুদ্ধেও পাওয়া গেছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। তার স্ত্রী আবেদনকারী হলেও তিনি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যুক্ত থেকেছেন এবং বিষয়টি কাউকে জানাননি। পরে তার স্ত্রী সাদিয়া আহমেদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষা সনদ জাল প্রমাণিত হয়। ফলে তার সব লাইসেন্স বাতিল করা হয় এবং বেসামরিক বিমান চলাচল আইনে মামলাও করা হয়।
আরেক ফার্স্ট অফিসার আল মেহেদী ইসলাম বেবিচকের চিঠি জাল করে সব বিষয়ে পাস করেছেন বলে একটি চিঠি তৈরি করেন। সেই রেকর্ড পর্যালোচনা না করেই তার দাখিল করা সনদের উপর ভিত্তি করে তাকে প্রশিক্ষণে পাঠানোয় বিমানের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করেছে কমিটি।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সরাসারি ফার্স্ট অফিসার ও ক্যাপ্টেন নিয়োগের জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কোনও স্বতন্ত্র নীতিমালা নেই। বিমানের পাইলট ঘাটতি পূরনের জন্য নিজস্ব পাইলট প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থাকা আবশ্যক বলেও সুপারিশ করেছে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত কমিটি।