বাংলাদেশে কোনও ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা হবে না, বলেছিলেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। কিন্তু দুই সপ্তাহ না যেতেই উল্টো কথা বললেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সার্বিক অবস্থায় তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, দেশের অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিতে পারে।
দেশে এখন রাজনীতিতে স্থিরতা নেই। ছাত্র-জনতার এক অভ্যুত্থানে পতন ঘটেছে দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের; যারা দেশকে ‘উন্নয়নের মহাসড়কে’ তোলার দাবি করে আসত।
তারপর অর্থনীতির জগতের মানুষ নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলেও অনিশ্চয়তা কাটেনি। ক্ষোভ-বিক্ষোভ-সংঘাতে এক ধরনের নৈরাজ্যকর অবস্থা বিরাজ করছে দেশে।
এসবের ছাপ অর্থনীতির ওপর পড়াটাই স্বাভাবিক। এরই মধ্যে ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি মুডি’স বাংলাদেশের ঋণমান কমিয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে অর্থনীতি এক ধরনের শঙ্কার মধ্য দিয়েই এগোচ্ছে।
কিন্তু পরিস্থিতি আসলে কতটা নাজুক? সূচকগুলো কী দেখাচ্ছে? উত্তরণের উপায় কী? খোঁজা যাক সেসবের উত্তর।
কী বলেছিলেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গত সোমবার একনেক বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে মন্দার শঙ্কার কথা প্রকাশ করেছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, “রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে, বিশৃঙ্খলার কারণে বেসরকারি খাতে উৎপাদন যা আছে, সেখানে স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। গার্মেন্ট খাতে স্থবিরতা আছে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ নাইই, তার ওপর সুদের হার অনেক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে করে উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হচ্ছেন না নতুন বিনিয়োগের ব্যাপারে। সেক্ষেত্রে বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না।
“মূল্যস্ফীতির হার বেশি। জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনকে ব্যাহত করছে। গ্রামগঞ্জের দোকানপাটে বেচাকেনা কম হচ্ছে। মানুষের আয়-ব্যয় সঙ্কুচিত হয়েছে।”
এ অবস্থায় সরকারি উন্নয়ন ব্যয়ও যদি না বাড়ে, তাহলে অর্থনীতিতে মন্দা অবস্থা তৈরি হবে, বলেছিলেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
অর্থনীতিবিদ হিসাবে তার এই বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গেই নিচ্ছে সবাই।
অথচ তার আগে গত ১১ নভেম্বর দৈনিক বণিক বার্তা আয়োজিত তৃতীয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুর বলেছিলেন, দেশে কোনও ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা হবে না।
“আমরা কি শ্রীলঙ্কা হয়ে গেছি, অবশ্যই না। আমাদের প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়নি; অর্থনীতিও ধসে পড়েনি। হতে পারত, কিন্তু হয়নি। এ বিষয়ে একধরনের উপলব্ধি থাকতে হবে যে বাংলাদেশ মন্দা এড়াতে পেরেছে।”
মন্দা কখন হয়?
স্বাভাবিকভাবে একটি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল থাকলে দেশের অর্থনীতির আকারও বাড়তে থাকে। দেশের উৎপাদিত পণ্য ও সেবার মূল্য অর্থাৎ মোট দেশজ উৎপাদন বাড়ে, মানুষের আয়ও বাড়ে। কিন্তু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হলে পণ্য ও সেবার মূল্য কমে যায়, অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সূচক হয় নিম্নমুখী। তখনই মন্দায় পড়ে কোনও দেশ।
মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি), শিল্প উৎপাদন, চাকরির বাজারসহ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক সম্প্রসারণের বদলে সঙ্কুচিত হওয়ার লক্ষণ দেখা দিলেই মন্দার শঙ্কাটি জেগে ওঠে।
ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনসের মতে, আয় ও ব্যয়ের ধারাবাহিকতার ওপরই একটি অর্থনীতি নির্ভরশীল। মানুষ আয়ের নিশ্চয়তার ওপর ভিত্তি করেই ব্যয় করে। এই নিশ্চয়তায় কোনও ধরনের ব্যত্যয় হলেই অর্থনীতিতে ঝাঁকুনি লাগে।
তাই অর্থনীতির সংকট শেষ পর্যন্ত মন্দায় উপনীত হবে কি না, তা অনেকাংশে মানুষের মানসিক অবস্থার ওপরও নির্ভরশীল। অর্থনীতিতে বিদ্যমান সংকট বা আশু সংকট নিয়ে দুর্ভাবনা যদি সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যয় সংকোচনের প্রবণতা তৈরি করে, তবে তা অর্থনীতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
মন্দা যেমন স্থানিক হয়, তেমন বৈশ্বিকও হয়ে থাকে। গোটা বিশ্ব গত শতকের ৩০ এর দশকে পড়েছিল মন্দায়, যাকে ১৯২৯ এর মহামন্দা বলা হয়।
অর্থনীতির তত্ত্ব অনুসারে, মন্দা মানেই হলো মানুষের ভোগব্যয় কমে যাওয়া। মহামন্দার সময় যা দেখা গিয়েছিল। আয় কমে যাওয়ার কারণে তখন মানুষের সঞ্চয় হয়ে পড়েছিল ঋণাত্মক।
২০০৮ সালের দিকেও আরেকটি মন্দার কবলে পড়েছিল বিশ্ব অর্থনীতি।
বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে যেমন কোনও দেশের অর্থনীতি মন্দায় পড়তে পারে, আবার অভ্যন্তরীণ কারণে কোনও তা ঘটতে পারে।
তবে বিশ্ব অর্থনীতিতে এখন মন্দার কোনও আভাস নেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা বড় দেশগুলো কাটিয়ে উঠেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ২ দশমিক ৬ শতাংশ। যেখানে ২০২২ সালের জুনে তা ৯ দশমিক ১ শতাংশে উঠেছিল। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের অর্থনীতিতে ধীরগতি থাকলেও সংকটের কোনও শঙ্কা নেই।
এই দুই দেশের অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। অর্থনীতির আকারের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।
বাংলাদেশের অর্থনীতির এখন কী হাল?
দেড় যুগ আগের বিশ্ব মন্দার ঢেউ বাংলাদেশে তেমন একটা লাগেনি। কোভিড মহামারী ও ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কাও অনেকটা সামলে ওঠা যাচ্ছিল। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর এখন নানামুখী চাপে অর্থনীতি।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় ছাড়া অর্থনীতির অন্য সব সূচকই এখন নিম্নমূখী। সরকারি হিসাবেই সার্বিক মূল্যস্ফীতি ১১ শতাংশের কাছাকাছি। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ নেমে এসেছে ১৮ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে আছে। মূখ থুবড়ে পড়েছে বেসরকারি বিনিয়োগ।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী
সার্বিক অর্থনীতির গতিশীলতা পরিমাপক জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে নেতিবাচক প্রবণতা।
সরকারের প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, এপ্রিল-জুন সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। এই অঙ্ক ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চার প্রান্তিকের মধ্যে সবচেয়ে কম এবং আগের অর্থবছরের একই প্রান্তিকের প্রায় অর্ধেক।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, গত অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) শিল্প, সেবা ও কৃষি—সব খাতের প্রবৃদ্ধিই কমেছে।
বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও (এডিবি) বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে।
কয়েকদিন আগে বিশ্ব ব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে, বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশে নেমে আসবে। আইএমএফ বলেছে, ৪ দশমিক ৫ শতাংশ হবে। এডিবি বলেছে, ৫ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ। পতনের আগে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ধরেছিল শেখ হাসিনা সরকার।
বিনিয়োগে খরা
অস্বাভাবিকভাবে সরকার পরিবর্তনের পর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নে দেখা যাচ্ছে কচ্ছপ গতি। অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) এডিপিতে বরাদ্দের মাত্র ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। বাস্তবায়নের এই হার ১৫ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
সাধারণত অর্থবছরের প্রথমদিকে এডিপির ব্যয়ের পরিমাণ কম থাকে। তবে এবার রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এবার আরও বেশি কম হয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকার চলতি অর্থবছরে এডিপিতে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৮৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা বরাদ্দ রেখে বাজেট পাস করেছিল। সেই সরকারের নেওয়া অনেক প্রকল্পে অর্থছাড় কমিয়ে দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি বিনিয়োগের হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ৩০ কোটি ডলারের নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে দেশে।
এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ শতাংশ কম। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এই তিন মাসে ৩৫ কোটি ৩০ লাখ ডলারের নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল।
মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে নীতি সুদহার বাড়িয়েই চলছে বাংলাদেশ ব্যাংক; তা উঠেছে ১০ শতাংশে।
ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগ করছেন না।
রাষ্ট্রক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর বড় ব্যবসায়ীদের কয়েকজন এখন কারাগারে। কেউ কেউ বিদেশে পালিয়ে গেছে।
এই পরিস্থিতিতে দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশে নেমে এসেছে; যা তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
নতুন বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান নির্দেশক মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি তলানিতে নেমেছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমছে।
মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি মানে নতুন শিল্প, তার মানে নতুন কর্মসংস্থান। কিন্তু এখন শিল্প স্থাপনের নতুন উদ্যোগ ও ব্যবসা সম্প্রসারণ স্থবির হয়ে আছে।
অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পণ্য আমদানির এলসি (ঋণপত্র) খোলাও কমেছে। এই তিন মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য মোট ১ হাজার ৫৫৯ কোটি ১১ লাখ (১৫.৫৯ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। এলসি নিস্পত্তির হারও কমেছে ২ দশমিক ৪০ শতাংশ।
রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি
অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সরকারের রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে দেখা গেছে, এই তিন মাসে সার্বিকভাবে শুল্ক ও কর আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ২৫ হাজার ৫৯৭ কোটি টাকা।
জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর কোনো মাসেই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি এনবিআর।
অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এনবিআরের মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৯৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে আদায় হয়েছে ৭০ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সব মিলিয়ে ৭৫ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকার শুল্ক-কর আদায় হয়েছিল।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। শতাংশ হিসাবে এই তিন মাসে রাজস্ব আদায় কমেছে ৬ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ।
অথচ প্রায় ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে শেষ হয়েছিল গত ২০২৩-২৪ অর্থবছর।
মূল্যস্ফীতি উদ্বেগজনক পর্যায়ে
হালে অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক হচ্ছে মূল্যস্ফীতি। সরকারি হিসাবে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। অক্টোবর মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
আগের মাস সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ। গত জুলাই মাসে অবশ্য খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল, যা ছিল গত ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
গত কয়েক মাস ধরেই দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে রয়েছে। এটি বিশেষ করে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষকে বেশি ভোগাচ্ছে।
মানুষ চায়, বাজারে গিয়ে যেন একটু স্বস্তি মেলে, কিন্তু ঘটছে তার উল্টো। ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ায় ক্রেতার নাভিঃশ্বাস উঠেছে। দেশের একটি বড় সংখ্যক মানুষের থালায় উঠছে না মাছ-মাংস, এমনকি ডিমও। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণে কঠোর কোনও ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে গত সেপ্টেম্বরের চেয়ে অক্টোবরে আরও বেড়েছে মূল্যস্ফীতি।
গত অক্টোবর মাসে ডিমের মূল্যবৃদ্ধি বেশ আলোচনায় ছিল। একপর্যায়ে ডিমের ডজন ১৭০-১৮০ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। শাকসবজির দামও বেশ চড়া ছিল। তখন বিশেষ করে পেঁয়াজের দামও বেশ বৃদ্ধি পায়। চালের দামও ছিল বাড়তি।
দেড় বছর ধরে দেশে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, আটা, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, ডিম, মুরগি, গরুর মাংস, শাকসবজি, মসলাসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে। এতে সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা বেশি চাপে পড়েছে।
আয় বৃদ্ধির তুলনায় মূল্যস্ফীতি বেশি বেড়ে গেলে গরিব ও মধ্যবিত্তের সংসার চালাতে ভোগান্তি বাড়ে। এমনিতেই বাজারের জিনিসপত্রের দাম বেশ চড়া। তার সঙ্গে চিকিৎসা, পরিবহনসহ খাদ্যবহির্ভূত খাতেও খরচ বেড়ে গেছে। সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতির এ চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন মানুষ।
বিবিএসের হিসাব অনুসারে, অক্টোবর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে। সেটিও আবারও ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে উঠেছে।
গত সেপ্টেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে নেমেছিল। তার আগের মাস আগস্টে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। তারও আগে জুলাই মাসে দেশে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা গত এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ।
রেমিটেন্স-রপ্তানি আয় বাড়লেও রিজার্ভ পতন থামছে না
রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়লেও রিজার্ভের পতন ঠেকানো যাচ্ছে না। গত ১২ নভেম্বর আকুর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ নামে ২৪ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।
১৮ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার ‘তাৎক্ষণিক ব্যবহারযোগ্য’ রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হবে।
অথচ এই রিজার্ভ উঠতে উঠতে ৫০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি উঠে গিয়েছিল। ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় যে পতনের শুরু হয়, তা আর থামছেই না।
রেমিটেন্স বা প্রবাসী আয় এখন কিছুটা ভালো অবস্থায় আছে। অর্থবছরের পঞ্চম মাস নভেম্বরের প্রথম ২৩ দিনেই প্রায় পৌনে ২ বিলিয়ন (২৭৩ কোটি) ডলার রেমিটেন্স এসেছে। অক্টোবরে এসেছিল ২৩৯ কোটি ৫১ লাখ (২.৪০ বিলিয়ন) ডলার।
অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৮৯৪ কোটি (৮.৯৪ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি।
অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার আয় এসেছে, গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ২০ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি।
অর্থবছরের চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) রপ্তানি আয় বেড়েছে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। এই চার মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে মোট আয় হয়েছে ১৫ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে আয় হয়েছিল ১৪ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।
তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “পোশাক শিল্পের অস্থিরতা আমাদের আরেক চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেড়েই চলেছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। ক্যাপিটাল মেশিনারি, শিল্পের কাঁচামাল আমদানিসহ সব কিছুর আমদানিই কমে গেছে।”
সার্বিক পরিস্থিতি দেখে হতাশার সুরে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, “বিনিয়োগ নেই; কর্মসংস্থান হচ্ছে না। সর্বত্র অনিশ্চয়তা-অস্থিরতা; কোথাও স্বস্তি নেই।। দিন যত যাচ্ছে, পরিস্থিতি ততই খারাপের দিকে যাচ্ছে।
“এমনটা চলতে থাকলে আমাদের কপালে কী আছে কে জানে? আমাদের পরিণতি শ্রীলঙ্কার মতো হবে কি না, তাই বা কে জানে?”
বিদেশি ঋণের চেয়ে পরিশোধ বেশি
বিশ্ব ব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে ড. ইউনূসের সরকার মোটা অঙ্কের ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। কিন্তু সেই ঋণের এক ডলারও এখনও দেশে আসেনি।
এরই মধ্যে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তিন মাস (প্রথম প্রান্তিক, জুলাই-সেপ্টেম্বর) পার হয়ে গছে। এই তিন মাসে বিদেশি ঋণ প্রাপ্তির অবস্থা খুবই খারাপ; যে ঋণ পাওয়া গেছে, তার চেয়ে আগে নেওয়া ঋণের সুদ-আসল বাবদ অনেক বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, এই তিন মাসে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে মাত্র ৮৪ কোটি ৬১ লাখ ডলারের ঋণ সহায়তা পেয়েছে বাংলাদেশ। এর বিপরীতে আগে পাওয়া ঋণের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ১১২ কোটি ৬৫ লাখ (১.১৩ বিলিয়ন) ডলার।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে যতো ঋণ-সহায়তা পাওয়া গেছে তার চেয়ে ২৮ কোটি ডলারের বেশি পরিশোধ করা হয়েছে।
লক্ষণ স্পষ্ট, উত্তরণে কী করণীয়?
বিনিয়োগ যখন কমে যায়, তখন অর্থনীতি গতিশীল রাখতে সরকারের বিনিয়েগ বাড়াতে হয়, এটাই সহজ সমাধান। উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদও সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু সরকারের তৎপরতায় তেমন কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
সার্বিক পরিস্থিতিতে মন্দার লক্ষণ ফুটে উঠছে, তা বলছেন বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনও।
তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “দিন যত যাচ্ছে, অবস্থা ততই খারাপের দিকে যাচ্ছে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। সংঘাত-নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে সবার মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে ছোট ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ী, কেউই ঠিকমতো ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারছেন না।
“এমন অবস্থা চলতে থাকলে অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিতেই পারে। লক্ষণ সেটাই মনে হচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। বন্যার কারণে আমন উৎপাদন ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। শাক-সবজিসহ অন্যান কৃষি উৎপাদনও কমেছে। রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় ছাড়া অর্থনীতির অন্য সব সূচকের অবস্থা খুবই খারাপ। চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক ধারায় থাকবে কি না, সেটা নিয়েই এখন সংশয় দেখা দিয়েছে।”
এমন পরিস্থিতিতে করণীয় কী- জানতে চাইলে জাহিদ হোসেন বলেন, “সবার আগে সব মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। আর দ্রুততর সময়ের মধ্যে এটা করতে হবে। দেশে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি করতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে; স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
“আর যে কাজটি করতে হবে, সেটা হলো মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে। শুধু সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের বাস্তবতায় কঠিন। এর পাশাপাশি পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো বা উৎপাদন খরচ কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যা বাজারে দাম কমাতে সাহায্য করবে।”
অর্থনীতিকে স্বস্তি দিতে দেশে বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ চাইছেন ব্যবসায়ীরা। সেজন্য তারা বলছেন, নির্বাচনের মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল সরকার আনতে হবে, তাহলে অনিশ্চয়তা কাটবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। অনিশ্চিত অবস্থায় কেউ বিনিয়োগ করতে চাইবে না।
তাদের কথায় সমর্থন দিয়ে অর্থনীতিবিদ জাহিদও বলেন, “অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণেই দেশে এখন সরকারি-বেসরকারি কোনও বিনিয়োগই হচ্ছে না। এতে কর্মসংস্থান হবে না। সে কারণে জরুরিভিত্তিতে দেশে বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।”