ইনস্টাগ্রামের শুরুটা হয়েছিল ছবি পোস্ট করার জন্যই। এখন মাসে অন্তত ২০০ কোটি ব্যবহারকারী ঘুরে বেড়ায় ইনস্টাগ্রামে। সুতরাং এর মধ্যে একজন হতে পারেন আপনি কিংবা আপনার আশপাশের যে কেউ।
ইনস্টাগ্রামে রিল দেখতে দেখতে মানুষের মস্তিষ্ক ও হাতের একসঙ্গে চলার বোঝাপড়া হয়ে গেছে মনের অজান্তেই।তার ওপর কোনও মজার রিল দেখার পর মজার মজার মন্তব্য পড়তে কমেন্ট অংশ অবশ্যই স্ক্রল করা চাই।
যদি কোনও রিল বিরক্তিকর লাগে তাহলেও একবার কমেন্ট অংশে ঘুরে আসতে মন চাইবে। কারণ অনেকের মন্তব্য বলে দেবে আমাদের ওই বিরক্তিবোধ ঠিক ছিল কি না।
এমন হরহামেশাই হচ্ছে, সারি সারি মন্তব্যের মাঝে কারও সম্পর্কে না জেনেই কেউ ভালো আবার কেউ কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে বসে আছে।
ইন্টারনেট সুবিধা যত ছড়িয়েছে অনলাইনে অপরিচিত কারো সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়ার চর্চাও তত ছড়িয়ে পড়েছে।
টুইটার অর্থাৎ এখনকার এক্স ভরে গেছে তর্ক ও তামাশা দিয়ে। এক ব্র্যান্ড আরেক ব্র্যান্ডকে দেখে নিচ্ছে এই প্লাটফর্মে। ২০২২ সালে এক্স হ্যান্ডেলে মোবাইলফোন ব্র্যান্ড স্যামসাং লিখেছিল, “লেট আস নো ইট হোয়েন ইট ফোল্ডস।” এই পোস্ট দিয়ে আসলে অ্যাপলকে খোঁচা মারা হয়েছিল।
এক্স প্লাটফর্মে সবাই কে কী টুইট করছে তাই দেখে; কোনও মতের সঙ্গে একমত হয় অথবা দ্বিমত পোষণ করে। কোনও একটি ঘটনা নিয়ে কেমন বোধ করছেন তা সবাইকে জানানোর তাগিদ গড়ে ওঠে ফেইসবুক থেকে। পাশাপাশি ইউটিউবের মন্তব্য ঘরেও এই চর্চা বাড়তে শুরু করে।
এদিকে টিকটক ৩০-৪০ সেকেন্ডের ভিডিও কনটেন্ট পোস্ট করার সুবিধা আসার পর থেকেই সব কিছু দ্রুত বদলে যায়। কারও বন্ধু না হয়েও যে কারও কনটেন্টে মন্তব্য করার সুবিধা দেখিয়ে দেয় টিকটক।
ছবি ও ভিডিও কনটেন্টে মন্তব্য করার সুযোগ এরপর ইনস্টাগ্রামেও চলে আসে। ভারতে টিকটক বন্ধ করা হলেও ইনস্টাগ্রামের কমেন্ট সেকশনে জমতে লাগলো হাজারো কথা।
পণ্যের প্রচারে এই সুযোগ ভালোভাবে কাজে লাগাতে শুরু করল ব্র্যান্ডগুলো।
কমেন্ট সেকশনে ব্র্যান্ডের খেলা
একটি ব্র্যান্ড কীভাবে নিজেকে সেরা জায়গায় নিতে পারে? সহজ উত্তর হচ্ছে, ক্রেতা ও ভোক্তারা যখন ওই ব্র্যান্ডকে নিজের মনে করে।
সোশাল মিডিয়াতে আজকাল কমেন্ট সেকশনে ক্রেতা ও ব্র্যান্ডের মধ্যে আড্ডার আসর জমে যাচ্ছে। কোনও ব্র্যান্ডের কমেন্ট থাকলে ওই রিল হয়ে যাচ্ছে ভাইরাল। আবার ভাইরাল হয়ে বসে আছে এমন কোনও রিলে মন্তব্য করা বিজ্ঞাপনী কৌশল হিসাবে বেছে নিচ্ছে ভারতীয় ব্র্যান্ডগুলো।
ভারতে অনলাইনে খাবার অর্ডার করার ব্র্যান্ড সুইগি, জোম্যাটো, ভাষা শেখার অ্যাপ ও ওয়েবসাইট ডুয়োলিংগো থেকে বিলাসী গাড়ির ব্র্যান্ড অডি, বিএমডব্লিউ পর্যন্ত ভাইরাল রিলে মন্তব্য করার দৌড়ে নেমে গেছে।
এর পেছনে দুটো বড় কারণ আছে। ব্র্যান্ডগুলো বুঝে গেছে ভাইরাল হওয়া অথবা ১৫ সেকেন্ডের বেশি ভিডিওগুলোর নিচের অংশ অবশ্যই মন্তব্যে ভরে উঠবে; আর সেখানেই এসে ব্র্যান্ডের নাম রেখে যেতে হবে।
দ্বিতীয় কারণ হলো, অনেকের মাঝে একটি মন্তব্য করে গেলে ব্র্যান্ডগুলো সবার আলাপের অংশ হয়ে আলাদা জনপ্রিয়তায় থাকছে।
ডুয়োলিংগোর ইনস্টাগ্রাম হ্যান্ডেলে এই ব্র্যান্ডের যে মাসকট রয়েছে তা অনেকের কাছে অদ্ভুত মনে হয়। এ নিয়ে অনেকেই মজা করতে ছাড়েন না। ডুয়োলিংগোর পক্ষ থেকে আবার সেসব মজার বিপরীতে আসে সরস জবাবও।
আবার নামের মিলে ব্রিটিশ পপ স্টার ডুয়া লিপাকে নিয়েও পোস্ট করছে ডুয়োলিংগো।
এসব কৌশলে কী লাভ হলো এই ব্র্যান্ডের?
২০২২ সালে ডুয়োলিংগোর বাজার মূল্য ছিল ২৮৫ কোটি ডলার। আর ২০২৪ সালের অক্টোবর নাগাদ তা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ২২৭ কোটি ডলার।
কমেন্ট সেকশন কেন জনপ্রিয় হচ্ছে?
কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট শ্রেয়া কৌল ইন্ডিয়া টুডে-কে বলেন, “কমেন্ট সেকশনে নিজেকে আড়াল করার সুযোগ রয়েছে; যা কিছুটা সুরক্ষিত বোধ করায়।
“আরেকভাবে বলতে গেলে, মন্তব্যের ঘরে ভিন্ন এক সমাজ গড়ে উঠেছে। তবে এই সমাজ কতটুকু ভালো বা মন্দ তাই দেখার বিষয়।”
মানুষের স্বভাব হচ্ছে কিছু জানলে তারা সেসব কথা আরেকজনকেও বলতে চায়। গল্পের ছলে এসব কথা যেমন বলা হতো, এখন তাই হচ্ছে মন্তব্য ঘরে।
শ্রেয়া মনে করেন, “শুরুতে মনে হতেই পারে, মন্তব্য ঘর থেকে অনেক কিছুই জানা যাচ্ছে। কিন্তু এর উল্টো পিঠে ক্ষতিটাই বেশি।
“কারণ এখানে কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। তাছাড়া এখানে অসত্য তথ্য ছড়ানোরও সুযোগ রয়েছে।”
“আমাদের এখন মত প্রদানের অনেক প্ল্যাটফর্ম আছে; যেখানে কোনোই নজরদারি নেই। এর অর্থ এই সুযোগে অনেক অপপ্রচারকারী গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।”
কমেন্ট সেকশনে যেহেতু সঠিক তথ্য বাছবিচারের বাইরে রয়ে যাচ্ছে, এখানে তাই উল্টোপাল্টা কথাই বেশি হবে।
এখন কমেন্ট সেকশন হয়ে গেছে ট্রল করার ময়দান। ফলে যে কেউ যে কাউকে নিয়ে যা ইচ্ছে লিখে যাচ্ছে। এমনকি ‘বট’ আইডি থেকেও বাজে মন্তব্য করা হয়।
ইংরেজি ‘স্লার’ শব্দটি একটি গালি। নারীরা যখন নিজের মর্জি মতো পোশাক পরার কথা বলে, তখন সাধারণত পুরুষরা এসে মন্তব্যে ইংরেজি অক্ষরে ‘আর’ লিখে যাচ্ছে। এরকম মন্তব্যে আসলে ‘স্লার’ শব্দটিকেই ইঙ্গিত করে নারীকে অপদস্ত করার প্রচেষ্টা রয়েছে।
ভারতীয় ক্রিকেট দলের তারকা অলরাউন্ডার হার্দিক পান্ডিয়া এবং নাতাশা স্ট্যানকোভিচ দম্পতি যখন আলাদা থাকতে শুরু করেন তখন সবাই পুরো ঘৃণা উগড়ে দিলো কমেন্ট সেকশনে। নাতাশার মন্তব্য ঘর ভরে উঠলো সেই ‘আর’ অক্ষরে।
২৪ বছর বয়সী মুসকান আগারওয়াল দিল্লিতে এমবিএ পড়ছেন। তিনি কনটেন্ট ক্রিয়েটর হতে চান। কিন্তু ইন্ডিয়া টুডের কাছে অকপটে মুসকান বললেন বললেন নিজের দ্বিধার কথা; এসব ট্রলের মুখোমুখি হওয়ার সাহস তার নেই।
“লোকজন ছোটখাট বিষয় নিয়ে মন্তব্য করে বসে। একটু ওজন বাড়লে, ঠোঁটে অন্যরকম লিপস্টিক দিলেও তাদের কথা বলা চাই। আমার তাই ভয় হয়, আমি অনলাইনে কিছু পোস্ট করলেই তারা ট্রল করা শুরু করবে।”